ক্যানসারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি ঘটছে৷ আলট্রাসাউন্ড রশ্মির মাধ্যমে অস্ত্রোপচার ছাড়াই প্যানক্রিয়াটিক ও যকৃতের ক্যানসারের টিউমার ধ্বংস করার পরীক্ষা চলছে জার্মানিতে৷ এখনো পর্যন্ত এতে যথেষ্ট সাফল্য পাওয়া গেছে৷
বিজ্ঞাপন
মানফ্রেড বুল প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারে ভুগছেন৷ তাও আবার ‘অ্যাডভান্সড' পর্যায়ে৷ দু'সপ্তাহ আগে টিউমার কেটে বাদ দেওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু ডাক্তার অপারেশন থামিয়ে দিয়েছিলেন৷ কারণ টিউমারটি পেটের গুরুত্বপূর্ণ ‘ভেসেল'-গুলির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল৷ এই অবস্থায় টিউমার কাটার চেষ্টা করলে ধমনী ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ বন বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক হলগার স্ট্রুংক বলেন, ‘‘এই প্যানক্রিয়াটিক টিউমার সাধারণত বেশ দেরিতে ধরা পড়ে, কারণ সেগুলি দেরিতে গোলমাল বাঁধায়৷ ‘কালার ডপলার এফেক্ট' ব্যবহার করে আমি দেখতে পারছি, এই টিউমার কীভাবে ভেসেল-এর চারপাশে বেড়ে উঠছে৷ ফলে টিউমার অপারেশন করা আর সম্ভব নয়, কারণ ভেসেল অপারেশন করা যায় না৷ অন্যান্য প্রক্রিয়ার তুলনায় ভেসেল খুব বেশি সমস্যা সৃষ্টি করে না৷''
অধ্যাপক স্ট্রুংক বেশ নিশ্চিত যে, তিনি নতুন ও পরীক্ষামূলক এক আলট্রাসাউন্ড চিকিৎসার মাধ্যমে ৭৪ বছর বয়স্ক এই রোগীকে সাহায্য করতে পারবেন৷ এই প্রক্রিয়ায় উত্তাপের সাহায্যে টিউমার টিস্যু নিখুতভাবে নষ্ট করা হয়৷
আতস কাচ যেমন সূর্যের আলো কেন্দ্রীভূত করে, ট্রান্সডিউসার হেড-ও ঠিক সে ভাবে আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গ কেন্দ্রীভূত করে৷ এক পরীক্ষায় সেই বিপুল শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, যা পরে টিউমার টিস্যুতে প্রয়োগ করা হবে৷ অধ্যাপক স্ট্রুংক বলেন, ‘‘আমরা টিউমার ধ্বংস করতে চাই৷ এর জন্য প্রায় ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা চাই৷ এর মাধ্যমে সীমিত এই পরিসরে টিউমার ধ্বংস করা যায়৷ আশেপাশেও উত্তাপ ও শক্তি ছড়িয়ে পড়ে বটে, কিন্তু তার মাত্রা এত কম যে কিছুই হয় না৷''
প্রথম দিন মানফ্রেড বুল-এর টিউমার চিকিৎসার মহড়া হয়েছে৷ এর মাধ্যমে ডাক্তাররা জানতে চেয়েছিলেন, কীভাবে তাঁরা আলট্রাসাউন্ড রশ্মির মাধ্যমে টিউমার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন৷ এবার রোগীকে জলের মধ্যে রাখা ট্রান্সডিউসার হেড-এর ঠিক উপরে আনতে হবে৷ ট্রান্সডিউসার হেড টিউমারের লাইভ ছবিও দেখায়৷ পরে সেটি দিয়েই আলট্রাসাউন্ড রশ্মি নিক্ষেপ করে টিউমার ধ্বংস করা হয়৷ অধ্যাপক স্ট্রুংক বলেন, ‘‘নীচে ট্রান্সডিউসার হেড, আছে জল এবং ত্বক৷ ফলে সবকিছু আমাদের নজরেই থাকছে৷ রোগী কীভাবে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে, কোথায় নিচ্ছে, তাও দেখতে পাই৷ কোথাও কিছু নড়ে গেলে হাত দিয়ে ট্রান্সডিউসার হেড অ্যাডজাস্ট করতে হয়৷ এই ছোট্ট সবুজ জায়গায় টিউমারের চিকিৎসা হয়, সেটি ধ্বংস করা হয়৷''
ক্যানসারকে দূরে রাখার ৯ উপায়
ক্যানসারের মতো অসুখকে শুধু ভাগ্যের লিখন বলা যায়না৷ কারণ টিউমার হওয়ার কারণগুলো গবেষকরা খুব ভালো করেই জানেন৷ ক্যানসারের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে প্রত্যেকেই কিছু করতে পারেন৷
ছবি: Getty Images
ভাগ্য নিজের হাতেই
‘আপনার ক্যানসার ধরা পড়েছে’ এমন দুঃসংবাদ শোনার জন্য কেউ কখনো অপেক্ষা করেনা৷ তবে একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে হয়তো ক্যানসার রোগীর সংখ্যা অর্ধেক হতে পারে৷ ক্যানসার রোগীর প্রতি পাঁচজনের একজনই হচ্ছে ধূমপায়ী৷ বিষাক্ত তামাকের ধোঁয়া যে শুধু ফুসফুসের ক্যানসারের জন্যই দায়ী তা নয়, ধূমপান অন্যান্য ক্যানসারের হওয়ারও একটি কারণ৷ তবে ধূমপান ক্যানসার হওয়ার একমাত্র কারণ নয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অতিরিক্ত ওজন মৃত্যুর কারণও হতে পারে
ক্যানসার হওয়ার নানা কারণের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে অতিরিক্ত ওজন এবং ইনসুলিনের মাত্রা বেশি থাকা৷ ইনসুলিনের মাত্রা বেশি হলে তা কিডনি, গলব্লাডার, খাদ্যনালীর ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়৷ শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত মোটা মহিলাদের শরীরের মেদের কারণে খুব সহজে জরায়ু এবং স্তন ক্যানসার হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলসেমি নয়, সোফা থেকে উঠে পড়ুন!
যারা সারাক্ষণ শুয়ে বসে থাকেন অর্থাৎ হাঁটা-চলা কম করেন, তাদের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি৷ দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে ব্যায়াম বা খেলাধুলা টিউমার হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে৷ শারীরিক কার্যকলাপ ইনসুলিনের মাত্রা কমায় এবং পাশাপাশি মোটা হওয়াও রোধ করে৷ শরীরচর্চা বলতে যে সব সময় ফিটনেস সেন্টারে যাওয়া বোঝায় তা কিন্তু নয়৷ যে কোনো ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি বা সাইকেল চালানোও হতে পারে৷
ছবি: Fotolia/runzelkorn
অ্যালকোহলকে না করুন
অ্যালকোহল বা মাদককে ক্যানসার উত্তেজক হিসেবে ধরা হয়ে থাকে৷ বিশেষ করে অ্যালকোহল পানে মুখের ভেতর, গলা এবং পাকস্থলীর নালীতে টিউমার ছড়ানোকে প্রভাবিত করে৷ তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে ধূমপান এবং মদ্যপান যদি একসাথে করা হয়৷ এই দুটো একসাথে হয়ে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় ১০০ ভাগ৷ তবে বলা হয়ে থাকে প্রতিদিন একগ্লাস ওয়াইন স্বাস্থ্যের জন্য ভালো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পশুর মাংস খাওয়া এড়িয়ে চলাই ভালো
রেড-মিট বা গরু বা ভেড়ার মতো প্রাণীর মাংস ক্যানসার হতে সহায়তা করে৷ তবে এর আসল কারণ ঠিক কী তা এখনও খুঁজে বের করা যায়নি৷ দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় এটুকু জানা গেছে যে রেড-মিটের সাথে ক্যানসারের সম্পৃক্ততা রয়েছে৷ শুকরের মাংসের তুলনায় গরুর মাংস খাওয়া বেশি বিপজ্জনক৷ অন্যদিকে মাছ খেলে হয় ঠিক তার উল্টোটা, অর্থাৎ মাছ খেলে ক্যানসার হওয়া থেকে দূরে থাকা যায়৷
ছবি: Fotolia
ফাস্টফুডকে না বলুন!
ফাস্টফুড বা রেডিমেড খাবার সব সময়ই যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সে কথা কম বেশি সবাই জানি৷ অন্যদিকে বেশি বেশি সবজি এবং ফলমূল ক্যানসার রোধে সাহায্য করে৷ দীর্ঘ গবেষণায় অবশ্য গবেষকরা দেখেছেন যে স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে মাত্র দশ শতাংশ ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বেশি রোদ, বেশি ক্ষতি
সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি মানুষের ত্বকের অনেক পরিবর্তন করে৷ তবে সানক্রিম সূর্যের বিকিরণ থেকে ত্বককে রক্ষা করে ঠিকই, তবে তারও সময়সীমা রয়েছে৷ ত্বক যখন পুড়ে যায়, ধরে নিতে হবে যে ত্বকে অনেক বেশি সূর্যের কিরণ লেগে গেছে৷
ছবি: dapd
আধুনিক ওষুধ থেকে ক্যানসার
এক্সরে রশ্মি জেনোটাইপের ক্ষতির কারণ, তবে সাধারণ এক্সরেতে তেমন ক্ষতি হয়না৷ সে রকম প্রয়োজন না হলে কম্পিউটার-টোমোগ্রাফি না করাই ভালো৷ আবার অন্যদিকে এমআরআই কিন্তু মোটেই শরীরে জন্য ক্ষতিকারক নয়৷ ভালো খবর যে, প্লেন ভ্রমণ থেকে ক্যানসার হবার কোনো আশঙ্কা থাকেনা৷
ছবি: picture alliance/Klaus Rose
ইনফেকশনের মাধ্যমে ক্যানসার
হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস লিভার কোষের ক্ষতি করতে পারে৷ ছবিতে যে ব্যাকটেরিয়া দেখা যাচ্ছে সেটা পাকস্থলী নষ্ট করে দিয়ে সেখানে ক্যানসারের জন্ম দিতে পারে৷ তবে বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখতে টিকা বা অ্যান্টিবায়োটিকও নেয়া যেতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
পরের চিকিৎসার জন্য অপারেটর মনিটরের পর্দায় টিউমারের আকার লক্ষ্য করেন এবং সেই অনুযায়ী নির্দিষ্ট ক্যানসার টিস্যুর দিকে লক্ষ্য করে আলট্রাসাউন্ড রশ্মি নিক্ষেপ করেন৷ এভাবে ধীরে ধীরে টিউমার নষ্ট করা হয়৷ সিমুলেশন বা মহড়া শেষ হবার পর মানফ্রেড বুল-এর আশা বেড়ে গেল৷ তিন দিন পর এই চিকিৎসা কাজে দেবে বলে তিনি আশা করছেন৷ রোগীর শরীরে কোনো অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়ে না৷ স্ক্যালপেল বা ক্ষতিকারক বিকিরণ ছাড়াই এই প্রক্রিয়া কাজ করে৷
নতুন এই চিকিৎসা যে সফলভাবে ক্যানসার টিউমার দূর করতে পারে, সেটা যকৃত ক্যানসারের এক টিউমারের ক্ষেত্রেই দেখা গেল৷ কয়েক সপ্তাহ আগে এক রোগীর উপর এই চিকিৎসা প্রয়োগ করা হয়েছিল৷ অধ্যাপক স্ট্রুংক বলেন, ‘‘টিউমারের মধ্যে যে অংশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, আগে তার মধ্যে রক্ত ঢুকে গিয়েছিল৷ চিকিৎসার পর ছবিতে সেটি কালো দেখাচ্ছে৷ অন্য একটি জায়গায় রক্ত সরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ এবার শরীরই টিউমার ত্যাগ করবে এবং সেটি তখন ছোট হয়ে যাবে বলে আমাদের আশা৷''
প্যানক্রিয়াটিক ও যকৃতের ক্যানসারের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপির সঙ্গে আলট্রাসাউন্ড চিকিৎসার সমন্বয় করা হয়, যাতে ক্যানসার কোষগুলি শরীরে ছড়িয়ে পড়তে না পারে৷ অর্থাৎ অ্যাডভান্স স্টেজ-এ টিউমার দূর করতে আলট্রাসাউন্ড চিকিৎসা অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক ও অত্যন্ত কার্যকর প্রক্রিয়া৷ তবে জার্মানিতে এই চিকিৎসার সাফল্য প্রমাণ করতে আরও দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষার প্রয়োজন৷