শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্যি, ক্যানসারে আক্রান্ত টিউমার সেল বা ক্যানসারের কোষ ধ্বংস করবে ভাইরাস৷ এটা কতটা কার্যকর সেটা নিয়েই কাজ করছেন জার্মান বিজ্ঞানীরা৷ তাঁদেরই একজন জানিয়েছেন ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এই নতুন তথ্য৷
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞানীরা এই প্রক্রিয়াকে বলছেন ‘অনকোলাইসিস'৷ অর্থাৎ ভাইরাসগুলো ক্যানসার কোষের ভেতর প্রবেশ করে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে এবং ওসব কোষকে ধ্বংস করে দেয়৷ অনকোলাইসিসকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন ট্যুবিঙ্গেন ইউনিভার্সিটি মেডিকেল ক্লিনিক উলরিশ লাওয়ের৷
তবে এটা যে সম্প্রতি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে তা কিন্তু নয়৷ লাওয়ের ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, অন্তত একশ বছর আগে থেকে এই প্রক্রিয়াটা পর্যবেক্ষণ করছেন বিজ্ঞানীরা৷ দেখা গেছে, যেসব ক্যানসার রোগীর দেহে ভাইরাসের প্রবল সংক্রমণ হয়, তাদের ক্যানসার কোষগুলোর বিস্তার বন্ধ হয়ে যায় এবং টিউমার ছোট হতে থাকে৷ এমনকি কয়েকটি রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে ক্যানসার কোষ পুরোই নির্মূল হয়েছে৷
এই প্রক্রিয়ায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ট্যুবিঙ্গেন ক্লিনিক এবং পল এরলিচ ইনস্টিটিউট একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে৷ তারা একটি ‘অনকোলাইটিস্ট মিজেলস ভ্যাকসিন' আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন৷ জার্মান শিক্ষা এবং গবেষণা মন্ত্রণালয় এই প্রকল্পের অর্থায়ন করছে৷
ক্যানসারকে দূরে রাখার ৯ উপায়
ক্যানসারের মতো অসুখকে শুধু ভাগ্যের লিখন বলা যায়না৷ কারণ টিউমার হওয়ার কারণগুলো গবেষকরা খুব ভালো করেই জানেন৷ ক্যানসারের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে প্রত্যেকেই কিছু করতে পারেন৷
ছবি: Getty Images
ভাগ্য নিজের হাতেই
‘আপনার ক্যানসার ধরা পড়েছে’ এমন দুঃসংবাদ শোনার জন্য কেউ কখনো অপেক্ষা করেনা৷ তবে একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে হয়তো ক্যানসার রোগীর সংখ্যা অর্ধেক হতে পারে৷ ক্যানসার রোগীর প্রতি পাঁচজনের একজনই হচ্ছে ধূমপায়ী৷ বিষাক্ত তামাকের ধোঁয়া যে শুধু ফুসফুসের ক্যানসারের জন্যই দায়ী তা নয়, ধূমপান অন্যান্য ক্যানসারের হওয়ারও একটি কারণ৷ তবে ধূমপান ক্যানসার হওয়ার একমাত্র কারণ নয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অতিরিক্ত ওজন মৃত্যুর কারণও হতে পারে
ক্যানসার হওয়ার নানা কারণের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে অতিরিক্ত ওজন এবং ইনসুলিনের মাত্রা বেশি থাকা৷ ইনসুলিনের মাত্রা বেশি হলে তা কিডনি, গলব্লাডার, খাদ্যনালীর ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়৷ শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত মোটা মহিলাদের শরীরের মেদের কারণে খুব সহজে জরায়ু এবং স্তন ক্যানসার হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলসেমি নয়, সোফা থেকে উঠে পড়ুন!
যারা সারাক্ষণ শুয়ে বসে থাকেন অর্থাৎ হাঁটা-চলা কম করেন, তাদের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি৷ দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে ব্যায়াম বা খেলাধুলা টিউমার হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে৷ শারীরিক কার্যকলাপ ইনসুলিনের মাত্রা কমায় এবং পাশাপাশি মোটা হওয়াও রোধ করে৷ শরীরচর্চা বলতে যে সব সময় ফিটনেস সেন্টারে যাওয়া বোঝায় তা কিন্তু নয়৷ যে কোনো ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি বা সাইকেল চালানোও হতে পারে৷
ছবি: Fotolia/runzelkorn
অ্যালকোহলকে না করুন
অ্যালকোহল বা মাদককে ক্যানসার উত্তেজক হিসেবে ধরা হয়ে থাকে৷ বিশেষ করে অ্যালকোহল পানে মুখের ভেতর, গলা এবং পাকস্থলীর নালীতে টিউমার ছড়ানোকে প্রভাবিত করে৷ তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে ধূমপান এবং মদ্যপান যদি একসাথে করা হয়৷ এই দুটো একসাথে হয়ে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় ১০০ ভাগ৷ তবে বলা হয়ে থাকে প্রতিদিন একগ্লাস ওয়াইন স্বাস্থ্যের জন্য ভালো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পশুর মাংস খাওয়া এড়িয়ে চলাই ভালো
রেড-মিট বা গরু বা ভেড়ার মতো প্রাণীর মাংস ক্যানসার হতে সহায়তা করে৷ তবে এর আসল কারণ ঠিক কী তা এখনও খুঁজে বের করা যায়নি৷ দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় এটুকু জানা গেছে যে রেড-মিটের সাথে ক্যানসারের সম্পৃক্ততা রয়েছে৷ শুকরের মাংসের তুলনায় গরুর মাংস খাওয়া বেশি বিপজ্জনক৷ অন্যদিকে মাছ খেলে হয় ঠিক তার উল্টোটা, অর্থাৎ মাছ খেলে ক্যানসার হওয়া থেকে দূরে থাকা যায়৷
ছবি: Fotolia
ফাস্টফুডকে না বলুন!
ফাস্টফুড বা রেডিমেড খাবার সব সময়ই যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সে কথা কম বেশি সবাই জানি৷ অন্যদিকে বেশি বেশি সবজি এবং ফলমূল ক্যানসার রোধে সাহায্য করে৷ দীর্ঘ গবেষণায় অবশ্য গবেষকরা দেখেছেন যে স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে মাত্র দশ শতাংশ ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বেশি রোদ, বেশি ক্ষতি
সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি মানুষের ত্বকের অনেক পরিবর্তন করে৷ তবে সানক্রিম সূর্যের বিকিরণ থেকে ত্বককে রক্ষা করে ঠিকই, তবে তারও সময়সীমা রয়েছে৷ ত্বক যখন পুড়ে যায়, ধরে নিতে হবে যে ত্বকে অনেক বেশি সূর্যের কিরণ লেগে গেছে৷
ছবি: dapd
আধুনিক ওষুধ থেকে ক্যানসার
এক্সরে রশ্মি জেনোটাইপের ক্ষতির কারণ, তবে সাধারণ এক্সরেতে তেমন ক্ষতি হয়না৷ সে রকম প্রয়োজন না হলে কম্পিউটার-টোমোগ্রাফি না করাই ভালো৷ আবার অন্যদিকে এমআরআই কিন্তু মোটেই শরীরে জন্য ক্ষতিকারক নয়৷ ভালো খবর যে, প্লেন ভ্রমণ থেকে ক্যানসার হবার কোনো আশঙ্কা থাকেনা৷
ছবি: picture alliance/Klaus Rose
ইনফেকশনের মাধ্যমে ক্যানসার
হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস লিভার কোষের ক্ষতি করতে পারে৷ ছবিতে যে ব্যাকটেরিয়া দেখা যাচ্ছে সেটা পাকস্থলী নষ্ট করে দিয়ে সেখানে ক্যানসারের জন্ম দিতে পারে৷ তবে বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখতে টিকা বা অ্যান্টিবায়োটিকও নেয়া যেতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
লাওয়ের জানালেন, তারাই প্রথমবারের মতো ভাইরাসকে রূপান্তরের চেষ্টা করেছেন যেন একটি টিউমার কোষগুলোকে আক্রমণ করে৷ অনকোলাইটিক ভাইরাসগুলো সেইভাবে রূপান্তর করা হবে যাতে তারা ক্যানসার কোষগুলোকে আক্রমণ করে এবং তাদের মেরে ফেলে৷
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা জীনগত প্রকৌশলের মাধ্যমে ভাইরাসকে রূপান্তর করা সম্ভব বলে জানালেন লাওয়ের৷ বিজ্ঞানীরা বেশিরভাগ ভাইরাসের জীনগত গঠন পর্যবেক্ষণ করে রূপান্তরের চেষ্টা করছেন৷ ভাইরাসটি রূপান্তরের পর রোগীর দেহে প্রবেশ করিয়ে এরপর রক্ত পরীক্ষা করা হয়৷ তখন দেখা হয়, ভাইরাসটি আসলেই রোগীর দেহে সংক্রমিত হয়েছে কিনা আর সেটা কতদিন রোগীর দেহে অবস্থান করছে৷
লাওয়ের জানান, রূপান্তরের আসল কাজটা হলো ভাইরাসগুলো কত দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে এবং ক্যানসার কোষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷ তবে যেসব ক্যানসার রোগী ছোটবেলায় মিসেল ভ্যাকসিন বা বসন্তের টিকা নিয়ে থাকেন, তাঁদের এক ধরনের সমস্যা দেখা দেয় বলে জানালেন বিজ্ঞানী৷ তিনি বলেন, যদি ভ্যাকসিন দেয়া থাকে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সম্ভাবনা থাকে ভাইরাস দেহে প্রবেশ করা মাত্র ক্যানসার কোষকে আক্রমণের আগেই তাকে আটকে দেয় ভ্যাকসিন৷
যেসব রোগীকে অনকোলাইটিক চিকিৎসা দেয়া হবে, খুবই স্বাভাবিক যে তাঁরা রেডিয়েশন থেরাপি এবং কেমোথেরাপির মধ্য দিয়ে যাবেন৷ তাই বিজ্ঞানীরা এটাও পর্যবেক্ষণ করছেন ভাইরাস দেহে প্রবেশ করালে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে কিনা৷ লাওয়ের বললেন, যেহেতু তাঁরা প্রকল্পের একেবারে প্রথম ধাপে রয়েছেন তাই এখনোই এ সম্পর্কে বলাটা কঠিন৷
তবে ক্যানসার চিকিৎসার পরবর্তীতে ভাইরাসটি রোগীর দেহে থেকে যায় কিনা, বা যেসব চিকিৎসক এই প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট বা পরিবারের সদস্যদের সংক্রমণের সম্ভাবনা আছে কিনা, সেসবও পর্যবেক্ষণ করছেন তাঁরা৷
ট্যুবিঙ্গেন ক্লিনিকের অ্যাবডোমিনাল ক্যানসার রোগীদের দেহে ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে৷ সেখানে রোগীদের তলপেটে সরাসরি ভাইরাস ভ্যাকসিন প্রবেশ করানো হয়, যাতে ভাইরাসটি খুব দ্রুত ক্যানসার কোষের সংস্পর্শে আসে৷ তবে লাওয়ের বেশ আশাবাদী৷ তাঁর ধারণা, ভবিষ্যতে ‘অনকোলাইসিস' ক্যানসারের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে৷