ক্যানসারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অনেক অগ্রগতি হয়েছে বটে, কিন্তু রোগীর চিকিৎসা কতটা কার্যকর হবে, তার পূর্বাভাষ দেওয়া কঠিন৷ জার্মানির বিজ্ঞানীরা এমন এক কম্পিউটার মডেল তৈরি করছেন, যার সাহায্যে ওষুধের কার্যকারিতা বোঝা সম্ভব হবে৷
বিজ্ঞাপন
ফুসফুসে ক্যানসার হলে চিকিৎসা হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেমোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়৷ তবে সেই প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত সব ওষুধ কতটা কার্যকর হবে, আগে থেকে তা বলা অত্যন্ত কঠিন৷ কারণ সব রোগীর ক্ষেত্রে একই প্রভাব দেখা যায় না৷
ভবিষ্যতে এই পূর্বাভাষ আরও উন্নত করে তোলার চেষ্টা চলছে৷ অধ্যাপক হাইকে ভালেস ও তাঁর গবেষকদল মানুষের ফুসফুসের টিউমার কোষ নিয়ে কাজ করছেন৷ সেগুলি শুকরের পাকস্থলী অথবা ছুঁচোর ফুসফুসে ‘কাল্টিভেট' করা হয়৷ গবেষকরা ছোট আকারে মানুষের ফুসফুসের নকল তৈরি করছেন, যার উচ্চতা মাত্র এক সেন্টিমিটার৷ শূকরের পাকস্থলির একটা টুকরো থেকে তার সব নিজস্ব কোষ দূর করা হয়৷ সেটিকে কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করে তাতে মানুষের টিউমার ও ফুসফুসের কোষ বসানো হয়৷
এটি ফুসফুসের এক সহজ থ্রিডি মডেল, যার মাধ্যমে ওষুধের প্রভাব ‘সিমুলেট' বা নকল করা হয়৷ ভ্যুরৎসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের অধ্যাপক হাইকে ভালেস বলেন, ‘‘এই পরীক্ষা ব্যবস্থার বড় সুবিধা হলো, আমরা জন্তু-জানোয়ার নয়, মানুষের কোষ নিয়ে কাজ করছি৷ সুস্থ ও অসুস্থ কোষ একসঙ্গে কাল্টিভেট করতে পারি৷ ওষুধ সুস্থ কোষের কতটা ক্ষতি করতে পারে এবং কত দক্ষভাবে অসুস্থ কোষ মেরে ফেলতে পারে, তা আন্দাজ করতে পারি৷''
এই প্রক্রিয়া অবশ্য সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না৷ ছুঁচোর ফুসফুসের মডেল আরও জটিল প্রশ্নের জবাব দিতে পারে৷ এ ক্ষেত্রেও ছুঁচোর নিজস্ব কোষ সরিয়ে মানুষের টিউমার ও ফুসফুসের কোষ লাগানো হয়৷
একটি পাম্প নিয়মিত উচ্চ ও নিম্ন চাপ সৃষ্টি করে ও ফুসফুসে বাতাস ঢুকিয়ে দেয়৷ অর্থাৎ আসল ফুসফুসেরই প্রায় নিখুঁত নকল করা হয়৷ রক্তবাহী শিরা ফুসফুসে পুষ্টি জোগায়৷ মানুষের শরীরের মতোই চলে সবকিছু৷
ক্যানসারকে দূরে রাখার ৯ উপায়
ক্যানসারের মতো অসুখকে শুধু ভাগ্যের লিখন বলা যায়না৷ কারণ টিউমার হওয়ার কারণগুলো গবেষকরা খুব ভালো করেই জানেন৷ ক্যানসারের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে প্রত্যেকেই কিছু করতে পারেন৷
ছবি: Getty Images
ভাগ্য নিজের হাতেই
‘আপনার ক্যানসার ধরা পড়েছে’ এমন দুঃসংবাদ শোনার জন্য কেউ কখনো অপেক্ষা করেনা৷ তবে একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে হয়তো ক্যানসার রোগীর সংখ্যা অর্ধেক হতে পারে৷ ক্যানসার রোগীর প্রতি পাঁচজনের একজনই হচ্ছে ধূমপায়ী৷ বিষাক্ত তামাকের ধোঁয়া যে শুধু ফুসফুসের ক্যানসারের জন্যই দায়ী তা নয়, ধূমপান অন্যান্য ক্যানসারের হওয়ারও একটি কারণ৷ তবে ধূমপান ক্যানসার হওয়ার একমাত্র কারণ নয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অতিরিক্ত ওজন মৃত্যুর কারণও হতে পারে
ক্যানসার হওয়ার নানা কারণের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে অতিরিক্ত ওজন এবং ইনসুলিনের মাত্রা বেশি থাকা৷ ইনসুলিনের মাত্রা বেশি হলে তা কিডনি, গলব্লাডার, খাদ্যনালীর ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়৷ শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত মোটা মহিলাদের শরীরের মেদের কারণে খুব সহজে জরায়ু এবং স্তন ক্যানসার হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলসেমি নয়, সোফা থেকে উঠে পড়ুন!
যারা সারাক্ষণ শুয়ে বসে থাকেন অর্থাৎ হাঁটা-চলা কম করেন, তাদের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি৷ দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে ব্যায়াম বা খেলাধুলা টিউমার হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে৷ শারীরিক কার্যকলাপ ইনসুলিনের মাত্রা কমায় এবং পাশাপাশি মোটা হওয়াও রোধ করে৷ শরীরচর্চা বলতে যে সব সময় ফিটনেস সেন্টারে যাওয়া বোঝায় তা কিন্তু নয়৷ যে কোনো ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি বা সাইকেল চালানোও হতে পারে৷
ছবি: Fotolia/runzelkorn
অ্যালকোহলকে না করুন
অ্যালকোহল বা মাদককে ক্যানসার উত্তেজক হিসেবে ধরা হয়ে থাকে৷ বিশেষ করে অ্যালকোহল পানে মুখের ভেতর, গলা এবং পাকস্থলীর নালীতে টিউমার ছড়ানোকে প্রভাবিত করে৷ তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে ধূমপান এবং মদ্যপান যদি একসাথে করা হয়৷ এই দুটো একসাথে হয়ে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় ১০০ ভাগ৷ তবে বলা হয়ে থাকে প্রতিদিন একগ্লাস ওয়াইন স্বাস্থ্যের জন্য ভালো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পশুর মাংস খাওয়া এড়িয়ে চলাই ভালো
রেড-মিট বা গরু বা ভেড়ার মতো প্রাণীর মাংস ক্যানসার হতে সহায়তা করে৷ তবে এর আসল কারণ ঠিক কী তা এখনও খুঁজে বের করা যায়নি৷ দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় এটুকু জানা গেছে যে রেড-মিটের সাথে ক্যানসারের সম্পৃক্ততা রয়েছে৷ শুকরের মাংসের তুলনায় গরুর মাংস খাওয়া বেশি বিপজ্জনক৷ অন্যদিকে মাছ খেলে হয় ঠিক তার উল্টোটা, অর্থাৎ মাছ খেলে ক্যানসার হওয়া থেকে দূরে থাকা যায়৷
ছবি: Fotolia
ফাস্টফুডকে না বলুন!
ফাস্টফুড বা রেডিমেড খাবার সব সময়ই যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সে কথা কম বেশি সবাই জানি৷ অন্যদিকে বেশি বেশি সবজি এবং ফলমূল ক্যানসার রোধে সাহায্য করে৷ দীর্ঘ গবেষণায় অবশ্য গবেষকরা দেখেছেন যে স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে মাত্র দশ শতাংশ ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বেশি রোদ, বেশি ক্ষতি
সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি মানুষের ত্বকের অনেক পরিবর্তন করে৷ তবে সানক্রিম সূর্যের বিকিরণ থেকে ত্বককে রক্ষা করে ঠিকই, তবে তারও সময়সীমা রয়েছে৷ ত্বক যখন পুড়ে যায়, ধরে নিতে হবে যে ত্বকে অনেক বেশি সূর্যের কিরণ লেগে গেছে৷
ছবি: dapd
আধুনিক ওষুধ থেকে ক্যানসার
এক্সরে রশ্মি জেনোটাইপের ক্ষতির কারণ, তবে সাধারণ এক্সরেতে তেমন ক্ষতি হয়না৷ সে রকম প্রয়োজন না হলে কম্পিউটার-টোমোগ্রাফি না করাই ভালো৷ আবার অন্যদিকে এমআরআই কিন্তু মোটেই শরীরে জন্য ক্ষতিকারক নয়৷ ভালো খবর যে, প্লেন ভ্রমণ থেকে ক্যানসার হবার কোনো আশঙ্কা থাকেনা৷
ছবি: picture alliance/Klaus Rose
ইনফেকশনের মাধ্যমে ক্যানসার
হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস লিভার কোষের ক্ষতি করতে পারে৷ ছবিতে যে ব্যাকটেরিয়া দেখা যাচ্ছে সেটা পাকস্থলী নষ্ট করে দিয়ে সেখানে ক্যানসারের জন্ম দিতে পারে৷ তবে বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখতে টিকা বা অ্যান্টিবায়োটিকও নেয়া যেতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
কৃত্রিম ফুসফুসের জন্য টিউমার কোষ আসে রোগীদের কাছ থেকে৷ অর্থাৎ কাগজে-কলমে প্রত্যেক রোগীর জন্যই ফুসফুসের আলাদা মডেল তৈরি করা সম্ভব৷ সেই অনুযায়ী চিকিৎসার রূপরেখাও তৈরি করা সম্ভব৷ অধ্যাপক ভালেস বলেন, ‘‘বড় আকারে অসংখ্য মানুষের জন্য এই প্রক্রিয়া সৃষ্টি করা সম্ভব নয়৷ এটি অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ৷ তাই পরের ধাপে এই কোষগুলি আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে৷ তারপর টিউমার রোগীদের একাধিক গ্রুপে ভাগ করতে হবে৷ ভবিষ্যতে হয়ত ১০ট়ি গ্রুপ সৃষ্টি হবে, যার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া যাবে৷''
ভবিষ্যতে হয়ত এমন পূর্বাভাষ শুধু কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমেই সম্ভব হবে৷ পরীক্ষার সময় কোনো একটি ওষুধ টিউমার কোষগুলি মেরে ফলতে পারলে গবষকরা সংশ্লিষ্ট মেটাবলিজম প্রক্রিয়া ফুটিয়ে তুলে সেটি কম্পিউটার মডেলে ভরে দিতে পারবেন৷ অধ্যাপক ভালেস বলেন, ‘‘আমরা টিউমার টেস্ট সিস্টেম থেকে তথ্য নিয়ে কম্পিউটার মডেলে ভরে দেই৷ দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে কম্পিউটার মডেল তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের রোগীদের জন্য পূর্বাভাষ দেওয়া যাবে৷ কোনো ওষুধ কাজ করবে কিনা, বায়োলজিকাল পরীক্ষা ছাড়াই তা বলা যাবে৷''
এই মিনি-ফুসফুসের মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে বিফল বা অকার্যকর কেমোথেরাপি এড়ানো সম্ভব হবে৷ বিজ্ঞানীদের আশা, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই ফুসফুসের প্রথম মডেল কাজে লাগিয়ে বাস্তবে রোগীদের চিকিৎসা করা সম্ভব হবে৷