সবার জন্য ঢালাও ওষুধ বা চিকিৎসার বদলে রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সমাধানসূত্র ক্যানসারের মতো রোগ সারাতে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে৷ টিউমার দমন করতে এমন টিকা তৈরির কাজে অগ্রগতি ঘটছে৷
বিজ্ঞাপন
নির্দিষ্ট ব্যক্তির শরীরে নির্দিষ্ট টিউমারের জন্য আলাদা করে টিকা – তাও আবার দ্রুত, কার্যকর এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন৷ ক্যানসার মোকাবিলায় মেসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তি এমনই প্রতিশ্রুতি বয়ে আনছে৷
হামবুর্গ শহরের এক হাসপাতালের টিউমার সেন্টার সেই প্রযুক্তির জন্য অপেক্ষা করছে৷ ডিয়র্ক আর্নল্ড ও তার সহকর্মীরা কয়েক মাসের মধ্যেই সেই লক্ষ্যে এক ক্লিনিকাল স্টাডি শুরু করবেন৷ ইউরোপের অন্য কয়েকটি কেন্দ্রেও সেই পরীক্ষা চালানো হবে৷ প্রো. আর্নল্ড বলেন, ‘‘প্রতিপক্ষ, অর্থাৎ টিউমারের বিরুদ্ধে নিজস্ব ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে লড়াই করার জন্য ইমিউন সিস্টেমকে প্রস্তুত করে তোলা আধুনিক প্রচেষ্টার মধ্যে পড়ে৷''
সমস্যা হলো, আক্রান্ত টিউমার বহু বছর ধরে মানুষের ইমিউন সিস্টেমকে ফাঁকি দিতে পারে৷ ছদ্মবেশ ধারণ করে শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতার সামনে সেটি নিজেকে শত্রু হিসেবে চিনতে দেয় না৷ অথবা সেই প্রতিরোধ শক্তি এতই দুর্বল যে ক্যানসার কোষগুলিকে দমিয়ে রাখার ক্ষমতা নেই৷ ফলে টিউমার বিনা বাধায় বেড়ে উঠতে পারে৷
অপারেশনের মাধ্যমে টিউমার এবং মেটাস্টেসেস অপসারণ করা সম্ভব৷ কিন্তু নতুন করে টিউমারের মাথাচাড়া দেবার ঝুঁকি এড়াতে আরো কিছু পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে৷ এই ঝুঁকি ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক ডিয়র্ক আর্নল্ড বলেন, ‘‘এমনকি বিশ্বের সেরা সার্জেনের ক্ষমতাও এ ক্ষেত্রে সীমিত৷ শরীরের কোনো এক অংশে টিউমার কোষ লুকিয়ে থাকলে, বংশবৃদ্ধি না করলে সেটি সহজে শনাক্ত করা যায় না৷ রোগের বায়োলজিও তিনি বদলাতে পারেন না৷ বায়োলজির অর্থ, ঘুমন্ত টিউমার কোষ অনেক সময় ধরে টিকে থাকতে পারে৷ তারপর ঘুম থেকে উঠে সেটি বংশবৃদ্ধি করতে পারে৷''
শিশুদের মস্তিষ্কে ক্যান্সার: গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য
শিশুদের যেসব ক্যান্সার হয়, তাদের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মস্তিষ্কে ক্যান্সার৷ জার্মানির এক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ এই রোগ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়েছেন৷ দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Hase
শিশুদের ক্যান্সার তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থান
শিশু-কিশোরদের যত ধরনের ক্যান্সার হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সার, এরপরে সবচেয়ে বেশি হয় ব্রেইন ক্যান্সার৷ জার্মান ব্রেইন টিউমার অ্যাসোসিয়েশন বলছে, যেসব শিশুদের ক্যান্সার হয় তাদের মধ্যে ২৫ ভাগ মস্তিষ্ক ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত৷
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Hase
ছেলেদের ক্যান্সারের হার বেশি
সাড়ে ছয় বছরের শিশুদের মধ্যে এ ধরনের ক্যান্সারের হার বেশি৷ এছাড়া মেয়ে শিশুদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে এ ধরনের ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা বেশি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Warmuth
লক্ষণ
ব্রেইন টিউমারের সাধারণ লক্ষণগুলো হল: মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি, দৃষ্টি বিভ্রান্তি, ভারসাম্যে সমস্যা এবং যেকোন জিনিসের সামঞ্জস্য করতে সমস্যা৷ তবে মস্তিষ্কে স্থান ভেদে লক্ষণ ভিন্ন হয়৷
ছবি: picture alliance / Frank Rumpenhorst
নির্ণয়
এমআরআই এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের ছবি তুলে চিহ্নিত করা হয় কোথায় টিউমার আছে৷ এটা ক্যান্সার কিনা সেটা জানার জন্য বায়োপ্সি করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. P. Kasper
মস্তিষ্কে টিউমারের ধরন
শিশুদের মধ্যে অ্যাস্ট্রোসাইটোমা ধরনের টিউমারটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়৷ প্রাথমিক অবস্থায় সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এটিকে অপসারণ করা গেলে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার সুযোগ থাকে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই টিউমারকে ‘গ্রেড ১’ হিসেবে ক্যাটাগরি করেছে৷ এরপর গ্রেড-২ ও গ্রেড -৩ এ আছে এপেনডাইমোমা৷ গ্রেড-৪ এ আছে মেডুলোব্লাস্টোমা৷ এই দুই ধরনের ক্যান্সার শিশুদের মধ্যে কমই দেখা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R.Vennenbernd
চিকিৎসা
টিউমার কত বড় বা মস্তিষ্কের কোথায় এর অবস্থান সে অনুযায়ী অস্ত্রোপচার, রেডিও থেরাপি, কেমোথেরাপি বা এগুলোর সমন্বয়ে চিকিৎসা করা হয়৷ হাইডেলবার্গের হোপ চিলড্রেনস ক্যান্সার সেন্টারের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টিয়ান পাটলার জানান, শিশুদের এক দুইবারের বেশি রেডিও থেরাপি দেয়া সম্ভব নয়, তখন কেমোথেরাপি দিতে হয়৷ এটা নিতে শিশুদের ভীষণ কষ্ট হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. P. Kasper
ঝুঁকি
মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারে বেশ ঝুঁকি রয়েছে৷ সফলভাবে অস্ত্রোপচার না হলে সারাজীবনের জন্য মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে৷
ছবি: DW/S. K. Dey
জীবন সংশয়
মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশে টিউমার হলে অস্ত্রোপচার বেশ কঠিন হয়ে পড়ে৷ বিশেষ করে কথা বলঅ এবং চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের যে অংশ এবং ব্রেইন স্টেম৷ অস্ত্রোপচারের সময় এগুলোর কোনটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে জীবন সংশয় দেখা দিতে পারে৷
ছবি: DW/S. K. Dey
ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয়
কোন শিশুর ক্যান্সার হওয়া মানেই তার মৃত্যু নিশ্চিত এমন নয়৷ টিউমার সফলভাবে অপসারণ করা গেলে ৭৫ ভাগ সম্ভাবনা থাকে পুরোপুরি সেরে ওঠার৷ খারাপ ধরনের টিউমারের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা ৪০ ভাগ৷
ছবি: Colourbox
ফিরে আসা
কিছু ক্ষেত্রে অপারেশনের কয়েক বছর পর এপেনডাইমোমা টিউমার ফিরে আসে৷ এ কারণ হতে পারে কোন কোষ রয়ে গিয়েছিল৷ সেক্ষেত্রে আবারও অস্ত্রোপচার করে টিউমারের প্রতিটি কোষ সরিয়ে ফেলতে হয়, যা বেশ কঠিন কাজ৷
ছবি: picture-alliance/ZB/W. Grubitzsch
শিশুরা মানসিকভাবে শক্ত
জার্মানির ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুরা মানসিকভাবে বেশ সাহসী৷ ভবিষ্যতে কি হবে তা না ভেবে হাসিমুখে তারা চিকিৎসার প্রতিটি ধাপে অংশ নেয়৷ তবে শিশুদের ক্যান্সার চিকিৎসায় সফলতার হার অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন জার্মান চিকিৎসকেরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
11 ছবি1 | 11
নতুন মেসেঞ্জার আরএনএ টিকার মাধ্যমে নিজস্ব ইমিউন সিস্টেমকে এতটা শক্তিশালী করে তোলার চেষ্টা চলছে, যাতে সেটি নিজস্ব ক্ষমতায় টিউমারের মোকাবিলা করতে পারে৷ প্রচলিত টিকার মতো এ ক্ষেত্রে শত্রুর মৃত অংশবিশেষ শরীরে প্রবেশ করানো হয় না৷ তার বদলে টিউমারের নির্দিষ্ট প্রোটিনের কাঠামো ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে পেশির কোষের মধ্যে চালান করা হয়৷
সেই কাঠামোর নির্দেশাবলী অনুযায়ী শরীর নিজস্ব ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে টিউমারের বিল্ডিং ব্লক তৈরি করে৷ শরীরের ইমিউন সিস্টেম তখন সেটিকে বহিরাগত হিসেবে শনাক্ত করে অ্যান্টিবডির জন্ম দেয়৷ প্রতিপক্ষকে চিনে নিয়ে সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়৷ জার্মান ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রের নিল্স হালামা বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে উৎপাদন প্রক্রিয়া বদলে দেওয়া হয়৷ ল্যাব অথবা জটিল প্রযুক্তির মাধ্যমে নয়, গোটা প্রক্রিয়া বরং রোগীর শরীরের মধ্যে স্থানান্তরিত করে সেখানেই উৎপাদন করা হয়৷ ফলে শরীর সেটি ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারে এবং ইমিউন সিস্টেমও সেটি একইভাবে চিনতে পারে৷''
প্রসাধনী থেকে ক্যানসার হতে পারে, সাবধান!
প্রতিটি নারীই কম-বেশি প্রসাধনী ব্যবহার করে থাকেন৷ তবে প্রসাধনীর কিছু রাসায়নিক উপাদান নারীর জন্য খুবই বিপজ্জনক হতে পারে৷ ছবিঘর থেকে জেনে নিন বিস্তারিত৷
ছবি: Fotolia
মহিলাদের যৌন হরমোনকে প্রভাবিত করতে পারে
বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রীতে থাকা রাসায়নিক পদার্থ বা কেমিক্যালস৷ যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের করা এক সমীক্ষা থেকে এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে৷
ছবি: Reuters/B. McDermid
প্রস্রাবে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ
১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সি মোট ১৪৩ জন নারীর ৫০০ বারের প্রস্রাব নিয়ে করা হয় গবেষণাটি, যার মধ্যে ছিল আলট্রা ভয়োলেট ফিল্টার, অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল প্রিজারভেটিভস, বিসফেনল এ, এবং ক্লোলোফেনলস৷
ছবি: picture alliance/empics/J. Green
ইস্ট্রজেন হরমোন
আলট্রা ভায়োলেট ফিল্টার এবং ফেনোলস ,ফোলিক স্ট্রিমুলেশন হরমোন এবং লুইটিনিজিং হরমোনের মাত্রা কমায় ঠিকই, তবে প্যারাবেস হরমোন এবং ডিম্বাশয়ের উত্পাদিত প্রধান হরমোন ইস্ট্রজেনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়৷
ছবি: picture-alliance/BSIP/S. Alice
স্তন ক্যানসার
প্রসাধনীর কিছু কেমিক্যালস স্তন ক্যানসারের মতো এস্ট্রোজেন-নির্ভর রোগগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে বলে জানান গবেষকরা৷
ছবি: Colourbox
সতর্কতা
সেজন্য প্রসাধন সামগ্রীগুলোতে কী কী রাসায়নিক দ্রব্য বা উপাদান থাকে তা প্রসাধনী কেনা এবং ব্যবহারের আগে দেখে নেয়া উচিত বলে জানান গবেষকরা ৷
ছবি: Tim Boyles/Getty Images
5 ছবি1 | 5
সেইসঙ্গে গবেষকরা আশা করছেন যে, টিকার মাধ্যমে ইমিউন সিস্টেম আগে থেকেই রক্তে টিউমার কোষ চিহ্নিত করতে পারবে৷ ফলে অন্য কোথাও মেটাস্টেসেস তৈরির সময়ই থাকবে না৷ প্রোফেসর আর্নল্ড বলেন, ‘‘নিজস্ব ইমিউন সিস্টেমের মাধ্যমে টিউমারের অতি কম পরিমাণ অবশিষ্ট অংশ হয় নিয়ন্ত্রণে রাখা কিংবা ধ্বংস করাই হলো লক্ষ্য৷ এভাবে নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে৷''
জার্মানির মাইনৎস শহরের বায়োনটেক কোম্পানি মেসেঞ্জার আরএনএ টিকা তৈরির কাজ করছে৷ সেই কোম্পানির কোভিড-১৯ টিকাও একই প্রযুক্তির ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে৷
জার্মানির ট্যুবিঙেন শহরের কিয়োরভ্যাক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না কোম্পানিও মেসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তি কাজে লাগাচ্ছে৷ করোনা ভাইরাস ও ক্যানসার মোকাবিলার ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি যথেষ্ট কার্যকর হতে পারে৷ টিউমার রোগীদের জন্য ভবিষ্যতে আলাদা করে দ্রুত টিকা তৈরি করাই এই উদ্যোগের লক্ষ্য৷ নিল্স হালামা মনে করেন, ‘‘এটা সত্যি এক মাইলফলক৷ কারণ আমরা মাস অথবা বছর নয়, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে টিকা তৈরির কথা বলছি৷ ফলে তাৎপর্য এবং সম্ভাব্য কার্যকারিতার বিচারে সম্পূর্ণ নতুন এক ক্ষেত্র খুলে যাচ্ছে৷''
কয়েক বছরের মধ্যে এই উদ্যোগের সুফল পাওয়ার কথা৷ ক্যানসারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে নতুন এই প্রযুক্তি জোরালো হাতিয়ার হয়ে উঠবে বলে গোটা বিশ্বের টিউমার বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন৷