ক্যান্সারের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য দেবব্রত
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বিশ্ব ক্যান্সার দিবস৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে জানিয়েছে, দশ জনের মধ্যে একজন ভারতীয় নিজেদের জীবদ্দশায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হবেন এবং ১৫ জনের মধ্যে একজন ভারতীয়র এই রোগে মৃত্যু ঘটবে৷ ক্যান্সার মোকাবিলায় ডাব্লুএইচও জরুরী পদক্ষেপ নেওয়ার লক্ষ্যেই এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে৷ কিন্তু ক্যানসার আক্রান্ত মানুষ লড়াইয়ের আগেই বেঁচে থাকার উদ্যম হারিয়ে ফেলেন৷ তাঁদের কাছে ডাক্তার দেবব্রত মণ্ডল এক অনুপ্রেরণার নাম৷ তিনবার ক্যান্সারকে হারিয়ে নিজে এখনও লড়ছেন ক্যান্সারের সঙ্গে৷
কলকাতার এনআরএস কলেজে বাঁকুড়ার দেবব্রত ১৯৭৮-এ যখন পঞ্চম বর্ষের ছাত্র, তখন টেস্টিকুলার টিউমার ধরা পড়ে৷ সেই ২৬ বছর বয়স থেকে এক তরুণের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু৷ আজও সেই যুদ্ধ চলছে৷ শিয়ালদহের বহুতলে বসে ডয়চে ভেলেকে ডাক্তার মন্ডল শোনান সেই লড়াইয়ের কথা৷ টেস্টিকুলার টিউমার বাদ দেওয়ার পর ১৯৭৯ সালে তাঁকে যেতে হয়েছিল মুম্বাই৷ সেখানে রেডিওথেরাপি চলে৷ প্রবীণ চিকিৎসক বলেন, ‘‘আইআইটির হোস্টেলে থাকতাম৷ সেখান থেকে টাটা মেডিকেল সেন্টারে যেতাম রেডিওথেরাপির জন্য৷ বমি হত, রাস্তায় বসে পড়তাম৷ কেউ সহানুভূতি দেখাত না৷''
এই থেরাপি চলার পর দুর্বল হয়ে পড়েন দেবব্রত৷ কিছুই খেতে পারতেন না৷ এই অবস্থাতেও কলকাতায় ফিরে ডাক্তারির ফাইনাল পরীক্ষা দিলেন ও পাশ করলেন৷ টিউমার বাদ পড়লেও আশঙ্কা ছিল, ক্যান্সার তখনও রয়ে গিয়েছে শরীরে৷ দু'বছর কোনো সমস্যা হয়নি৷ কিন্তু, ১৯৮০ সালে হঠাৎ বাঁ পা ফুলে গেল দেবব্রতর৷ সকলে অনুমান করলেন, ক্যান্সার পায়ে ছড়িয়েছে৷ তখন শুধু মাদ্রাজে (চেন্নাই) সিটি স্ক্যান হত৷ একাই রওনা দিলেন দক্ষিণ ভারতে৷ দেবব্রত বলেন, ‘‘মাদ্রাজ মেলে সফর করার সময় মনে হল, আমি আর বাঁচব না৷ ক্যান্সার এবার আর আমাকে রেহাই দেবে না৷ শুধু শুধু টাকা খরচ করে কী হবে৷ তাই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলাম৷'' এর পরের বিবরণ রোমহর্ষক৷ ডাক্তার মণ্ডল বলেন, ‘‘অক্টোবর-নভেম্বর মাস৷ খুব ঠান্ডা৷ আপার বাঙ্ক থেকে নেমে এলাম৷ মাদ্রাজ মেলের দরজা খুলতেই হু হু করে হাওয়া ঢুকছে৷ ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেওয়ার মুখে কী যেন মনে হল৷ ভাবলাম, দেখি না রিপোর্টে কী বেরোয়৷ যদি ক্যান্সার ধরা পড়ে, তাহলে ফেরার পথে ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেব৷''
সেবার ক্যান্সার থেকে রেহাই পান দেবব্রত৷ তারপর দীর্ঘদিন জীবনের ছন্দ ফিরে পেয়েছিলেন৷ নিজের কলেজের জুনিয়র সুতপা ঘোষকে বিয়ে করেন৷ চাকরি করেন বিআর সিং হাসপাতাল, শিয়ালদহ ইএসআই হাসপাতালে৷ একটি কন্যা সন্তানের পিতা হন৷ স্বাভাবিক জীবনে আবার ধাক্কা ২০০৮ সালে৷ ফের টিউমার ধরা পড়ল৷ এবার প্যারোটিড গ্ল্যান্ডে৷ সেটাও কেটে বাদ দেওয়া হল৷ বায়োপসি রিপোর্ট ক্যান্সারের সম্ভাবনা নাকচ করল না৷ ধাক্কা লাগলেও জীবন থমকে যায়নি৷ সামলে নিয়েছিলেন মৃত্যুঞ্জয়ী চিকিৎসক৷
কিন্তু, ২০১৪ সালে ক্যান্সার প্রবল পরাক্রমে ফিরে এল৷ এবার আক্রান্ত ফুসফুস৷ দেবব্রত বলেন, ‘‘বাঁদিকের ফুসফুসে টিউমার ধরা পড়ে৷ আবার কেমোথেরাপি নিতে হয়৷ অপারেশনে ফুসফুসের একাংশ বাদ পড়ে৷ ক্যান্সার অনেকটা অ্যাডভান্স, স্টেজ ফোর-বি৷ রোজ কেমোথেরাপির ওষুধ খেতে হয়৷'' এর পরেও কাজ থামেনি চিকিৎসকের৷ একাধিক নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত তিনি৷ নিয়মিত সেখানে গিয়ে অস্ত্রোপচার করেন৷ নিজের চেম্বারে বসেন সপ্তাহে তিনদিন৷ তাঁর এই লড়াইয়ে সহযোদ্ধা স্ত্রী সুতপা৷ তিনি বলেন, ‘‘ওর অসাধারণ মনের জোর৷ এই ক্যান্সার ধরা পড়ায় আমি একটু দুর্বল হয়ে পড়ি৷ কিন্তু, ওকে দেখে সাহস ফিরে পেয়েছি৷''
শিয়ালদা ইএসআই-এর ‘পেইন ম্যানেজমেন্ট' বিভাগের কোর্স ডিরেক্টর চিকিৎসক সুব্রত গোস্বামী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যাঁদের পজিটিভ আউটলুক থাকে, তাঁরা কোনো যুদ্ধেই হেরে যান না৷ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুযায়ী, মনের জোর থাকলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে যায়৷ উপশম চিকিৎসার থেরাপি এটাই৷ দেবব্রতদা এই থেরাপিই নিজের উপর চালিয়েছেন৷ এটা শিক্ষণীয়৷''