ফ্রান্সের ক্যালে জঙ্গলে এখনো বহু শরণার্থী বাস করছে৷ করোনা মহামারী যাদের জীবন আরো কঠিন করে তুলেছে৷ সুপারমার্কেটগুলোতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না৷ প্রতিনিয়ত পুলিশ তাদের তাঁবু কেড়ে নিচ্ছে৷
ফ্রান্সের ক্যালেতে শরণার্থীদের তাঁবুছবি: DW/L. Louis
বিজ্ঞাপন
ক্যালে ও ডানকেখহ জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া এই শরণার্থীরা যেকোনো উপায়ে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করতে চায়৷
জঙ্গলের সবুজ ঘাসের উপর ছোট ছোট তাঁবুতে বাস শরণার্থীদের৷ পুলিশ ভ্যান আসলে কুখ্যাত এই শরণার্থী ক্যাম্পে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়৷ সেই ২০১৮ সালের অগাস্ট থেকে প্রতি দুইদিন অন্তর অন্তর পুলিশ এই ক্যাম্পে হাজির হয় এবং শরণার্থীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে৷ পুলিশ দেখলেই নিজেদের তাঁবু তুলে জঙ্গলের গভীরে চলে যায় শরণার্থীরা৷ পুলিশ চলে গেলে ফিরে আসে নিজের জায়গায়৷
করোনা ভাইরাস মহামারীর বিস্তার রোধে দেশ লকডাউন করে দেয়া হলেও ক্যালেতে এ নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি৷
ইরিত্রিয়া থেকে আসা ২৮ বছরের এক শরণার্থী বলেন, ‘‘পুলিশ আমাদের মানুষই মনে করে না৷ যদি তারা আসার পর আপনি উঠে না পড়েন তবে তারা তাঁবু কেড়ে নেয়৷ তখন ত্রাণকর্মীদের কাছে আবার তাঁবু চাইতে হয়, যেটা পেতে এক সপ্তাহের বেশি পার হয়ে যায়৷’’
পুলিশ জীবননাশের হুমকিও দেয় বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন শরণার্থী৷ তাদের অভিযোগ, পুলিশ তাদের পিটিয়েছে, টিয়ার গ্যাসের শেল ছুড়েছে এবং ‘বানর’ ও ‘কুকুর’ বলে গালি দিয়েছে৷
সাগর পথে এখনো ইউরোপে ঢুকছেন বাংলাদেশিরা
ভূমধ্যসাগর থেকে শরণার্থীদের উদ্ধার করা জাহাজ ওশান ভাইকিংসে কিছুদিন কাটিয়েছেন ডয়চে ভেলের সাংবাদিক মিওদ্রাক জরিচ৷ সেখানে তিনি অন্যান্য দেশের শরণার্থীদের সঙ্গে বাংলাদেশিদেরও দেখেছেন৷
ছবি: DW/M. Soric
ওশান ভাইকিংয়ে চড়ে সমুদ্রে
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝির দিকে ওশান ভাইকিংসের ক্রুদের দুই সপ্তাহের সঙ্গী হই আমি৷ জাহাজটিতে থাকা একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে আমি লিবীয় উপকূলে ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স এবং এসওএস মেডিট্রেনির কার্যক্রম একেবারে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি৷ দেখেছি, সাগর থেকে উদ্ধার করা বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশের শরণার্থীদের অবস্থাও৷
ছবি: DW/M. Soric
সবসময় সাগরে চোখ
লিবিয়া উপকূলে থাকাকালে আমি দেখেছি, ওশান ভাইকিংসে অবস্থানরত ক্রু এবং মানবাধিকার কর্মীরা সবসময় সমুদ্রের দিকে চোখ রাখতেন৷ ভূমধ্যসাগরে এই জাহাজের ভেসে বেড়ানোর উদ্দেশ্য একটাই আর তা হচ্ছে, ইউরোপে আসার পথে সাগরে দুর্ঘটনায় পড়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা৷
ছবি: DW/M. Soric
উদ্ধার তৎপরতা
আমাদের মিশনের প্রথম দিনেই লিবিয়া উপকূল থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে সাগরে ভাসতে থাকা দু’টি নৌকা থেকে জরুরি সাহায্যের আকুতি শুনতে পাই৷ মানবাধীকার কর্মীরা অশান্ত সাগরের মাঝেই উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত সব মানুষকে জাহাজে তুলে আনতে সক্ষম হন৷
ছবি: DW/M. Soric
ইউরোপে আসতে মরিয়া তারা
সমুদ্র থেকে ওশান ভাইকিংসে তুলে আনা অধিকাংশ অভিবাসনপ্রত্যাশীই পুরুষ৷ দুই সপ্তাহের মিশনে আমরা অনেক বাংলাদেশি এবং মরোক্কানকে দেখেছি৷ এছাড়া সাব-সাহারান দেশগুলো থেকে আসা মানুষও ছিল৷ তারা ইউরোপে পৌঁছাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেন৷ তবে, উদ্ধারের পর তাদেরকে বেশ ভারমুক্ত মনে হয়,কেননা, তারা তখন নিশ্চিত হন যে আর লিবিয়ায়ফিরে যেতে হবে না৷
ছবি: DW/M. Soric
ইউরোপে নতুন জীবন
ওশান ভাইকিংসে ওঠার পর শরণার্থীরা তাদের মানসিক অস্থিরতা থেকে কিছুটা মুক্তি পান এবং ভবিষ্যৎনিয়ে ইতিবাচক ভাবনার সুযোগ পান৷ যে মহাদেশে পৌঁছাতে ঘরবাড়ি, পরিবার ছেড়ে এসেছেন তারা,শীঘ্রই সেখানে প্রবেশের সুযোগ হবে তাদের৷ আমি মাঝে মাঝে তাদের ভাবনা বোঝার চেষ্টা করি৷ তারা কি অতীত নিয়ে ভাবেন, নাকি ভবিষ্যৎ নিয়ে?
ছবি: DW/M. Soric
জীবন বাঁচাতে বদ্ধপরিকর এরিক কনিন্সবের্গার
আমি এখানে ক্রুদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি৷ ১৪টির বেশি দেশের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি এবং ধর্ম থেকে আসা মানুষদের নিয়ে গড়া এই দলের একটাই উদ্দেশ্য – অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জীবন বাঁচানো৷ অতীতে তারা যা- করুক না কেন এই জাহাজের ডেক কিংবা বাথরুম পরিষ্কার করাতেও তাদের কোনো আপত্তি নেই, কথাগুলো বলেন এরিক কনিন্সবের্গার৷ দু’বছর আগেও তিনি ছিলেন একজন অভিনেতা৷
ছবি: DW/M. Soric
উদ্ধারকর্মী ইলিনা এন্গেলোভা
‘‘আমি অন্য কোথাও কাজ করার কথা কল্পনাও করতে পারি ,’’ বলেন ইলিনা এন্গেলোভা৷ ওশান ভাইকিংস জাহাজের মানবিক সহায়তা বিষয়ক কর্মকর্তা তিনি৷ তরুণ এই বেলজিয়ান সেই দলের সদস্য,যারা একসময় প্রায় নিশ্চিত ডুবতে বসা ২৭৪ শরণার্থীকে উদ্ধারে সক্ষম হয়েছিলেন৷ বর্তমানে শরণার্থীদের উদ্ধারের পর জাহাজে তাদের দেখভালের দায়িত্ব তাঁর৷
ছবি: DW/M. Soric
এক নিরাপদ স্বর্গ
অভিবাসীদের জাহাজে তোলার পর খাদ্য, পানীয় জল, এক ব্যাগ কাপড় এবং একটি কম্বল দেয়া হয়৷ আমি যখন জাহাজে ছিলাম,তখন অভিবাসীদের এই কন্টেইনারগুলোতে থাকতে দেখেছি৷
ছবি: DW/M. Soric
জাহাজে সাময়িক আবাস
অভিবাসীদের ইটালিতে নিয়ে আসার পর জাহাজে থাকা তাদের সাময়িক আবাসন দেখার সুযোগ দেয়া হয় আমাকে৷ অভিবাসীদের স্ট্রেস দূর করতে সহায়তার উদ্দেশ্যে সেখানে একটি বক্সিং রিং তৈরি করে দিয়েছেন ক্রুরা৷ আর সেখানকার দেয়ালে অভিবাসীরা ছবি এঁকেছেন, ক্রুদের ধন্যবাদ দিয়ে নানা বার্তা লিখেছেন৷
ছবি: DW/M. Soric
বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে
ওশান ভাইকিং ত্যাগ করার আগে উদ্ধারকৃত অভিবাসীরা সেটির দেয়ালে স্বাক্ষর দিয়ে গেছেন৷ এখানে বাংলাদেশ থেকে আসা একজন তারিখ লিখেছেন ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২০৷ কেউ কেউ আবার ধন্যবাদসূচক নানা বার্তা এবং প্রাথনাও লিখেছেন৷ তাদেরকে সিসিলি বন্দর থেকে কোথায় নেয়া হবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷
ছবি: DW/M. Soric
জাহাজে চিকিৎসক
ইতালি কর্তৃপক্ষ সিসিলিতে ওশান ভাইকিং জাহাজটিকে কোয়ারেন্টাইন করেছে৷ তারা আশঙ্কা করছে যে, শরণার্থীরা করোনা ভাইরাস নিয়ে আসতে পারে৷ জাহাজে অবস্থানরত চিকিৎসক ড. স্টেফান কে. হল আমাদের তাপমাত্রা এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন৷ ২০১৩ সাল থেকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে আসা এই মার্কিন নাগরিক এর আগে দক্ষিণ সুদান, মিয়ানমার, বাংলাদেশ এবং সিরিয়ায় ছিলেন৷
ছবি: DW/M. Soric
আশা এবং হতাশা
এই শরণার্থী শিশুরা আইভরি কোস্ট থেকে এসেছেন৷ তাদের অভিভাবকরা কোথায় তা জানা যায়নি৷ ওশান ভাইকিংয়ের উদ্ধারকারীরা উদ্ধারের পর তাদের খেলনা দিয়েছেন৷ তবে, এই শিশুরা খুব দ্রুতই হতাশ হয়ে পড়েছিল৷ কারণ, তারা জাহাজত্যাগের সময় ইতালীয় কর্তৃপক্ষ করোনা ভাইরাসের ভয়ে তাদের কাছ থেকে খেলনাগুলো নিয়ে গেছে৷
ছবি: DW/M. Soric
জাহাজে সুস্থ থাকা
ইতালীয় উপকূলে বেশ কয়েকদিন ঝড়ের সঙ্গে লড়ার পর দেশটির কর্তৃপক্ষ আমাদের সিসিলিতে নোঙ্গরের অনুমতি দেয়৷ কিন্তু করোনভাইরাস আতঙ্কের কারণে আমি এবং ক্রুরা জাহাজ থেকে নামার অনুমতি পাইনি৷বলা হয়েছে, আমাদের এভাবেই দু’সপ্তাহ কাটাতে হবে৷ এই সময়টায় সুস্থ থাকার জন্য ক্রুদের কেউ কেউ এরকম জিম তৈরি করেছে৷
ছবি: DW/M. Soric
জাহাজের নায়ক
কোয়েরেন্টাইনে থাকাকালে আমি বেশ কয়েকজন ক্রুর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছি৷ তাদের মধ্যে নায়ক হচ্ছেন টঙ্গুই৷ ৩৮ বছর বয়সি এই ফরাসি যত মানুষকে উদ্ধার করেছেন তা অন্য কোনো ক্রু করতে পারেননি৷ কারো কারো হিসেবে এই মানুষটা দশ হাজারের বেশি শরণার্থীকে ডুবে মরা থেকে বাঁচিয়েছেন৷
ছবি: DW/M. Soric
একটি বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি
এই চমৎকার হাসিটা দিয়ে মিরিয়াম উইলিস জাহাজের সবার মন জয় করে নেন৷ যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজের এই বাসিন্দা শরণার্থীদের খাদ্য, পানীয়, পোশাক, ঘুমানোর স্থান থেকে গোসল অবধি সবকিছুর দেখভাল করেন৷
ছবি: DW/M. Soric
জীবন বাঁচাতেও খরচ আছে
তবে, মানুষ জীবন বাঁচানোর এই অভিযান অর্থের বিবেচনায় মোটেই সস্তা নয়৷ জাহাজটিতে প্রতিদিন চৌদ্দ হাজার ইউরো খরচ হয়৷ এই খরচের মধ্যে জাহাজের ভাড়াও অন্তর্ভূক্ত আছে৷ উদ্ধারকারীদের জন্য নতুন লাইফবোট এবং অন্যান্য সামগ্রী প্রয়োজন৷ কিন্তু অর্থের অভাবে সেগুলো কেনা যাচ্ছে না৷
ছবি: DW/M. Soric
16 ছবি1 | 16
লকডাউনে শরণার্থীদের চলাফেরাও অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে৷ তাদের মূল শহরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না৷ সুপারমার্কেটে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে পুলিশ৷ লোকাল বাসও তোদের তোলা বন্ধ করে দিয়েছে৷
এ বিষয়ে নগরীর ডেপুটি মেয়র ফিলিপ মিনয়ঁনেট বলেন, "বাসগুলোতে আর দলবেঁধে শরণার্থীদের উঠতে দেওয়া হচ্ছে না৷ তবে তারা আলাদা উঠতে বাধা নেই, বিশেষ করে যেসব বাস হাসপাতালের দিকে যায় সেগুলোতে৷
‘‘ক্যাম্পে তিন জনের করোনা ভাইরাস পজেটিভ হওয়ার পর আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ নাহলে অন্যরা বাসে উঠতে চাইছিল না৷’’
ক্যাম্পে শুধু তিনজন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত এমনটা বলা কঠিন৷ ত্রাণকর্মীরা জানান, সেখানে আরো বেশ কয়েকজনের শরীরে করোন ভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ দেখা গেছে৷ কিন্তু তারা পরীক্ষা করাতে পারেনি৷ সেখানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা অসম্ভব৷ পুরো ক্যাম্প আবর্জনায় পূর্ণ৷ তাদের মাস্ক বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিছুই নেই৷
ডিসেম্বরে ক্যালেতে আসা ২০ বছরের নোয়েল বলেন, ‘‘মহামারীর শুরু থেকেই আমাদের সুরক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি৷ আমাদের এখানে ফেলে রাখা হয়েছে৷ আমরা এখানে আটকে গেছি৷ কয়েকজনকে আশ্রয় শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ কিন্তু সেখানে চারজনকে একটি রুমে থাকতে হয়-এটা অবৈধ৷ তাই অনেকে চলে এসেছে৷ এমনকি অনেকে দুইদিন ধরে হেঁটে এখানে ফেরত এসেছে৷’’
আশ্রয় শিবিরগুলোর অবস্থাও ভালো নয়৷ করোনাকালে সেখানে কর্মীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ এদিকে, ধারণ ক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ শরণার্থী থাকছে৷ টান পড়েছে ত্রাণ সাহায্যেও৷
ক্যালের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মিশেল তুহনেয়াঁ বলেন, মেডিকেল টিম নিয়মিত শরণার্থীদের পরীক্ষা করছে৷
‘‘এছাড়া আমরা ৭১৫ জন শরণার্থীকে আশ্রয় শিবিরে যেতে বলেছি৷ যেখানে তারা চিকিৎসা পাবে৷ ৩৫৩ জন সেখানে এরইমধ্যে চলে গেছে৷ নিয়মানুযায়ী দুইদিন পরপর আমাদের জঙ্গলে অভিযান চালাতেই হবে, যতদিন অবৈধ শরণার্থী সেখানে থাকবে৷ তাদের সেখানে বসত গড়া থেকে আটকাতে হবে৷ এটা ঠিক না ভুল তা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না৷ আমাদের বিচার বিভাগ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷’’
ত্রাণকর্মীরা জানান, সেখানে প্রায় ১২শ শরণার্থী রয়েছে৷ সরকারি হিসাবের থেকে প্রায় দ্বিগুণ৷ এতজনের জন্য মাত্র ছয়টি টয়লেট৷ যেখানে হাত ধোয়ার জন্য এমনকি সাবান পর্যন্ত নেই৷ সরকারের তাদের জন্য আরেকটু বেশি কিছু করা উচিত৷