মাঠে খেলা অনিয়মিত৷ সাফল্য আরো অনিয়মিত৷ ক্রিকেটের জাতীয় দল বাদে অন্য খেলাগুলোর দর্শক নেই৷ যে ক্লাব সংস্কৃতির উপর বেঁচে থাকে দেশের ক্রীড়াঙ্গন, তাতে পচন বেশ আগেই৷ দুঃসহ দীর্ঘকাল ধরে তাই ধুঁকছিল বাংলাদেশের ক্রীড়া-ক্লাবগুলো৷
বিজ্ঞাপন
তবু তো টিকে ছিল৷ কিন্তু এবারের যে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি, তাতে ক্লাবগুলোর অস্তিত্বই সংকটের মুখে৷ আগামী মৌসুমে খেলা মাঠে গড়াবে কিনা, তা নিয়ে এখন ঘোর সংশয়৷
ঢাকার ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এবং কলাবাগান ক্রীড়া চক্র খেলাধুলার কারণে সংবাদ শিরোনামে আসে না বহুকাল৷ এবার পুরো দেশ কাঁপিয়ে গণমাধ্যমে ক্লাবগুলোর সরব উপস্থিতি৷ আর সেটি কী ন্যাক্কারজনক কারণে! আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেখানে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছে ক্যাসিনোর বিপুল সরঞ্জাম৷ এরপর অভিযান ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা স্পোর্টি ক্লাব এমনকি মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে পর্যন্ত৷ এখানেই শেষ নয়৷ চট্টগ্রামের আবাহনী লিমিটেড, মোহামেডান ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবেও চলে একই রকম অভিযান৷
তাতে প্রমাণ মেলে, ক্লাবগুলো মাঠের খেলা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছিল জুয়ার আখড়া৷ আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, ক্রীড়া ক্লাবগুলোর এই ক্যাসিনো ক্লাবে রূপান্তর সংগঠকদের প্রশ্রয়ে; তাঁদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে৷
অভিযানে আলোচনায় ক্যাসিনো
বাংলাদেশে ক্যাসিনোয় মদ, জুয়া চলছে অনেক দিন ধরে৷ তবে বুধবার যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেপ্তার হবার পর ক্যাসিনোই হয়ে গেছে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’৷ বাংলাদেশে ক্যাসিনোের বিস্তারের ইতিহাস নিয়েই এই ছবিঘর...
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
ক্লাবে ক্লাবে মদ, জুয়া
আয়ের উৎস হিসেবে বাংলাদেশের অনেক ফুটবল ক্লাবে ‘হাউজি’ খেলা শুরু হয় আশির দশকের দিকে৷ তবে নব্বইয়ের দশকে জুয়ার আসরও জমে ওঠে৷ গত কয়েক বছরে তা আরো ভয়াবহ মাত্রা পায়৷ ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের অনেক ক্লাবেই গড়ে ওঠে ক্যাসিনো৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
প্রতিবেদনে ক্যাসিনো
জাতীয় দৈনিকে ক্যাসিনো নিয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রতিবেদন নজরে আসে ২০১৩ সালে৷ প্রথম আলো-র সেই প্রতিবেদনে তখন বলা হয়, ‘‘বছরের পর বছর ধরে ক্লাবগুলোতে নিপুণ, চড়চড়ি, ডায়েস, ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, রেমি, ফ্ল্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের তাস খেলা বা কথিত ‘ইনডোর গেমস’-এর নামে জুয়া খেলা চলছে৷’’
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
এগিয়ে থাকা ঢাকার কিছু ক্লাব
ছয় বছর আগে প্রথম আলো’র সেই প্রতিবেদনে ঢাকার ক্লাবগুলোর মধ্যে ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ক্লাব প্যাভিলিয়ন ফকিরাপুল, আরামবাগ ক্লাব, দিলকুশা ক্লাব, ডিটিএস ক্লাব, আজাদ বয়েজ ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, বিজি প্রেস স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি ক্রীড়াচক্র বিমানবন্দর কমান্ড-এর নাম এসেছিল৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
ঢাকার বাইরেও...
বগুড়ার রহমান নগর ক্রিকেট ক্লাব, নোয়াখালীর শহীদ শাহ আলম স্মৃতি সংসদ হলরুম, সোনাইমুড়ী, চাঁদপুরের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভাই ভাই স্পোর্টিং ক্লাব, ফ্রিডম ফাইটার (৫ নম্বর গুপ্তি ইউনিয়ন পরিষদ), নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় বর্ণালী সংসদ, বরিশালের সেতুবন্ধন ক্লাব ও লাইব্রেরি, চট্টগ্রামের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদেও তখন থেকেই নিয়মিত জুয়ার আড্ডা বসছে বলে জানা যায়৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
আরো প্রতিবেদন
২০১৭ সালে দৈনিক বণিক বার্তা ‘অবৈধ তবু বড় হচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ তাতে তুলে ধরা হয় ক্লাবভিত্তিক রেস্টুরেন্টগুলোতেও পশ্চিমা ধাঁচের অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা জমে ওঠার তথ্য৷ বলা হয়, প্রশিক্ষিত জুয়াড়ি আনা হচ্ছে বিদেশ থেকে, তাঁদের কাজে লাগিয়ে ক্লাবগুলোতে প্রতি রাতে বসানো হচ্ছে জুয়ার আসর৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
বিচ্ছিন্ন অভিযান
এরপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনি দু-একটি ক্লাবে অভিযান চালালেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, বরং ক্যাসিনোর বিস্তার আরো বেড়েছে৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এক বৈঠকে দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নেতাদের কঠোর সমালোচনা করেন৷ আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী সেই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে৷ আরেকজন এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন৷ এসব বন্ধ না করলে যেভাবে জঙ্গি দমন করা হয়েছে, একইভাবে তাদেরকেও দমন করা হবে৷
ছবি: DW
যুবলীগের ৬০টি ক্যাসিনো?
প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর যুবলীগ নেতারা ৬০টি জুয়ার আখড়া বা ক্যাসিনো চালাচ্ছেন বলে কয়েকটি সংবাদপত্র জানায়৷ এরপরই ক্যাসিনোতে অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনি৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
যুবলীগ নেতা আটক
ঢাকার ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে অবৈধভাবে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে বুধবার যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে র্যাব৷ গুলশান ২ নম্বরের ৫৯ নম্বর সড়কের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ একই দিনে ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযান চালিয়ে দুই নারীকর্মীসহ ১৪২ জনকে আটক ও ২৪ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
অভিযান চলছে
শুক্রবার যুবলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে ঠিকাদারি চালিয়ে আসা গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা, অস্ত্র ও মদ উদ্ধার করে র্যাব৷ বুধবার ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের পাশাপাশি ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, বঙ্গবন্ধু এভিনিউর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এবং বনানীর আহমেদ টাওয়ারের একটি ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র্যাব৷ এ পর্যন্ত ১৮২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
মোহামেডান, ভিক্টোরিয়াতেও ক্যাসিনো!
রোববার ঢাকার মতিঝিলে চারটি ক্লাবে অভিযান চালায় পুলিশ৷ ভিক্টোরিয়া ক্লাব থেকে জুয়া খেলার নয়টি বোর্ড, এক লাখ টাকা, জুয়ায় ব্যবহৃত চিপস ও মদ পাওয়া গেছে। দুটো রুলেট টেবিল, নয়টি বোর্ড, বিপুল পরিমান কার্ড পাওয়া গেছে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে৷ এছাড়া আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবেও বাকারা ও রুলেট টেবিলসহ বিভিন্ন জুয়ার সরঞ্জাম পেয়েছে পুলিশ। এর আগে শনিবার চট্টগ্রামে ক্লাবগুলোতে অভিযান চালিয়েছে র্যাব৷
ছবি: bdnews24.com
ক্যাসিনোতে রাজনীতির প্রভাব
ক্যাসিনো প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ও অন্য দলের নেতাদের নামও উঠে এসেছে৷ ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা এবং ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন আর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী সাব্বির সাধারণ সম্পাদক৷ রাশেদ খান মেননের দাবি, ক্লাবে যে ক্যাসিনো চলছে তা তিনি জানতেন না৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
12 ছবি1 | 12
খেলোয়াড়-কোচ-সংগঠক হিসেবে ক্লাবের সঙ্গে নিজের জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন ফুটবলের গোলাম সারোয়ার টিপু৷ বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন, ‘‘আমার বয়স এখন ৭৫ বছর৷ এর মধ্যে ৫০-৬০ বছর তো খেলার সঙ্গে, ক্লাবের সঙ্গেই কাটিয়ে দিলাম৷ এই দীর্ঘ সময়ে সামগ্রিক অর্থে বাংলাদেশের ক্লাবগুলো এমন সংকটে কখনো পড়েছে বলে আমার মনে পড়ে না৷’’ তাঁর পরিচয়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের নামও এ কেলেঙ্কারিতে যোগ হওয়ায় ক্ষুব্ধ টিপু, ‘‘আমি আবাহনীতে খেলেছি৷ ওদের প্রথম লিগ চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক ছিলাম৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবার কাছে আমি ‘মোহামেডানের টিপু’৷ এখন তো সেই পরিচয় সংকটেই পড়ে গেছি৷ মোহামেডানের টিপু পরিচয়টা দিতে এখন আমি লজ্জিত বোধ করছি; অপমানিত বোধ করছি৷’’
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন কাজে উল্টো ক্রোধ জানিয়েছেন চট্টগ্রামের এক ক্লাব কর্মকর্তা৷ ক্লাবগুলোর নিজস্ব আয়ের কোনো জায়গা নেই, অনুদানের ভিত্তিতে তা পরিচালিত হয় বলে জানিয়েছেন৷ ক্যাসিনো বা জুয়াবোর্ডের অর্থ থেকে খেলোয়াড়দের টাকা দেয়া হয় বলেও বুঝিয়ে দেন প্রচ্ছন্নে৷ কিন্তু সেটি তো আর ক্রীড়াক্লাবে ক্যাসিনো চালানোর বৈধতার ছাড়পত্র হতে পারে না৷ আর এখানকার অর্থের কত শতাংশ খেলোয়াড়রা পান; বিপরীতে কিভাবে ফুলেফেঁপে ওঠেন ভুঁইফোঁড় ক্লাব কর্মকর্তারা৷ সেটিও কারো অজানা নয়৷
ক্লাবগুলোর নিজস্ব আয় নেই; সত্যি৷ অনুদানের ভিত্তিতে ক্লাবগুলো চলে; সত্যি৷ কিন্তু বাংলাদেশে এ বাস্তবতা তো চিরকালীন৷ তবু কি অতীতে নিবেদিতপ্রাণ সংগঠকরা নিজেদের মতো অর্থ সংস্থান করে ভালোবাসার ক্লাব চালাননি? তেমনই এক উদাহরণ দেন গোলাম সারোয়ার টিপু, ‘‘আমাদের সময়ের সংগঠকরা বউয়ের গয়না বিক্রি করে ক্লাব চালাতেন৷ আমার মনে আছে, মোহামেডান ক্লাব একবার অর্থ সংকটে পড়ল৷ আমান ভাই নামের এক সংগঠক ফুটবলের দলবদলের সময় নিজের গাড়ি বিক্রি করে দিলেন খেলোয়াড় কেনার জন্য৷ এখন তো এটি গাঁজাখুরি গল্পের মতো শোনাবে৷ কারণ, এখনকার সংগঠকরা ক্লাবকে ব্যবহার করে বিপুল বিত্তশালী হয়ে উঠছেন৷ নিজেদের আর্থিক লাভের জন্য, লোভের জন্য এখানে ক্যাসিনো পর্যন্ত চালাতেন, ভাবা যায়!’’
৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্লাব সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি৷ ক্যাসিনো-কাণ্ডে তিনিও ভীষণ বিব্রত৷ অবৈধ অর্থের মালিকদের ক্লাবে প্রবেশকে এর কারণ হিসেবে দেখেন তিনি, ‘‘আগে ক্লাবের কার্ডরুমে কার্ড খেলা হতো৷ সেটি নির্দোষ বিনোদন৷ ক্লাব সদস্যরাই অংশ নিতেন কেবল৷ সেখান থেকে অল্প যে কিছু টাকা উঠত, তা দিয়ে ক্লাবের বল কেনা কিংবা চা-নাস্তা কেনার মতো টুকটাক কাজে ব্যয় হতো৷ পরবর্তীতে ক্লাবের খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় এখানে প্রবেশ করেন কালো টাকার মালিকরা৷ ক্লাবের সুনাম ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেন তারা৷ সেটি করতে করতে এভাবে যে ক্যাসিনোর সংস্কৃতিতে ঢুকে যাবে ক্লাবগুলো, তা কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না৷’’
কোন দেশে কত বেশি ক্যাসিনো
বিশ্বজুড়ে বড় ধরনের ব্যবসা চলে ক্যাসিনো নির্ভর গ্যাম্বলিং বা জুয়াকে ঘিরে৷ চীনের মূল ভূখণ্ড আর মুসলিম কিছু দেশ ছাড়া পর্যটন নির্ভর অর্থনীতির প্রায় সব দেশ আর বড় শহরগুলোতেই আছে ক্যাসিনোর রমরমা আয়োজন৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/F. Fell
যুক্তরাষ্ট্র সবার উপরে
ক্যাসিনোর কথা উঠলে প্রথমেই আসবে যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসের নাম, নেভাদায় যার অবস্থান৷ ৩৬০ টি ক্যাসিনোর অস্তিত্ব শুধু এই এক অঙ্গরাজ্যেই৷ ইউটাহ, হাওয়াই আর আলাস্কা ছাড়া ক্যাসিনো আছে দেশটির বাকি সব রাজ্যেই৷ সব মিলিয়ে ১৯৫৪ টি ক্যাসিনো চালু আছে যুক্তরাষ্ট্রে, আছে ৯ লাখের উপর স্লট মেশিন৷ ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান আর বছরে ৭০ বিলিয়ন ডলার আয়ের জোগান দেয় সেখানকার এই শিল্প৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/F. Fell
জুয়া ভালোবাসে ক্যানাডার মানুষ
সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্যাসিনো আছে ক্যানাডাতে৷ জনগণকে ক্যাসিনোর মালিকানা আর পরিচালনার প্রথম অনুমতি দিয়েছে উদারমনা দেশটি৷ তাতে সেখানে মোট ক্যাসিনোর সংখ্যা ২১৯ টিতে দাঁড়িয়েছে৷ সবচেয়ে বেশি ৭৩ টি আছে অন্টারিওতে৷ এরপর তালিকায় আছে আলবার্টা আর ব্রিটিশ কলম্বিয়া৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশটির ৭৬ ভাগ মানুষই কোনো-না -কোনো জুয়ার সাথে জড়িত৷ বছরে সাড়ে ১৫ বিলয়ন ডলার লেনদেন হয় এর মাধ্যমে৷
ছবি: imago/imagebroker
মেক্সিকোতে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত
২০৬ টি ক্যসিনো আছে উত্তর আমেরিকার আরেক দেশ মেক্সিকোতে৷ গেম পরিচালনায় এর কোনোটিরই নিজস্ব কোনো প্রোগ্রাম নেই, গোটাটাই কেন্দ্রীয় সার্ভারের মাধ্যমে পরিচালিত৷ কোডারে, বিগ বোলা আর ইমোশন— এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের দখলে অবশ্য মেক্সিকোর ক্যাসিনো শিল্পের বড় অংশটাই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J.Mendez
অতীতের আবহে ফ্রান্স
উত্তর অ্যামেরিকার দেশগুলোকে বাদ দিলে সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্যাসিনো ফ্রান্সে৷ বলতে গেলে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ক্যাসিনোগুলোর দেখা মিলবে এই দেশটিতেই৷ তবে অ্যামেরিকার মতো জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও ঐতিহাসিক দিক থেকে এসব খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ যেমন, ১৯১২ সালে চালু হওয়া ক্যাসিনো ব্যারিয়ো দাভিলা৷ সব মিলিয়ে ১৮১ টি ক্যাসিনো চালু আছে ফ্রান্সে৷ এর পরের অবস্থানটি নেদারল্যান্ডসের, ১৬৬ টি আছে সেখানে৷
ছবি: JOHN GURZINSKI/AFP/Getty Images
কথায় কথায় বাজি ব্রিটিশদের
রাজপ্রাসাদ থেকে শুরু করে রাজপথ, বাজি যদি জুয়ার মধ্যে পড়ে তাহলে ব্রিটিশদের চেয়ে এগিয়ে আর কেউ নেই৷ শুধু লন্ডনেই হাজারের উপর বেটিং শপ আছে৷ ২০ লাখের বেশি ব্রিটিশ অনলাইনে জুয়া খেলে৷ এর বাইরে মেফেয়ার আর পিকাডিলির মতো খ্যাতনামা ক্যাসিনোতো আছেই৷ সব মিলিয়ে সংখ্যাটি ১৫৮৷
ছবি: picture-alliance/prismaonline
ম্যাকাও মানেই ক্যাসিনো
সংখ্যায় বেশি না হলে নামিদামি ক্যাসিনোর দিক থেকে লাস ভেগাসের পরেই আসে চীনের স্বায়ত্ত্বশাসিত অঙ্গরাজ্য ম্যাকাওয়ের নাম৷ বলতে গেলে সেখানকার অর্থনীতিই এই শিল্প নির্ভর৷ যুক্তরাষ্ট্রের উইনস্টারের পর বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো ভেনিটিয়ানের অবস্থানও এখানে৷ সিটি অব ড্রিমস, পন্টে সিক্সটিন, স্যান্ডস, এমজিএম গ্র্যান্ডও আছে দশের ভিতরে৷ মাত্র অর্ধশত ক্যাসিনোই ম্যাকাওয়ের সরকারের ৮০ ভাগ রাজস্বের যোগান দেয়৷
ছবি: AP
আছে মুসলিম অধ্যুষিত দেশেও
বিশ্বের অনেক মুসলমান প্রধান দেশেও বৈধ ক্যাসিনো আছে৷ সবচেয়ে বেশি ১৭ টি আছে মিশরে, যার ১৪ টি শুধু রাজধানী কায়রোতেই৷ ৯ টি আছে তুরস্কে৷ আফ্রিকার মরক্কোতে আছে সাতটি৷ এছাড়াও মধ্যাপ্রাচ্যের আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, আরব আমিরাত আর এশিয়ার মালয়েশিয়াতেও ক্যাসিনোর অনুমোদন আছে৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/F. Hall
দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশে
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২১টি ক্যাসিনো আছে ভারতে৷ গোয়ার পানাজি, গ্যাংটক, মুম্বাইসহ মোট ১১ টি শহরে সেগুলোর অবস্থান৷ ৫ টি ক্যাসিনো আছে শ্রীলঙ্কায়, যার সবগুলোই রাজধানী কলম্বোয়৷ এছাড়া ১১ টি ক্যাসিনো আছে নেপালে আর ৫ টি মিয়ানমারে৷
ছবি: Imago/ITAR-TASS
8 ছবি1 | 8
সাম্প্রতিক এ কেলেঙ্কারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন৷ কিভাবে? হাহাকার ছড়ানো কণ্ঠে গোলাম সারোয়ার টিপু বলেন, ‘‘দেখুন, বাংলাদেশে ক্রিকেট বাদে অন্য সব খেলার খেলোয়াড় এখন কমে গেছে৷ তবু তো কিছু ছেলে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢাকায় ফুটবল খেলতে আসে, ক্রিকেট খেলতে আসে, হকি খেলতে আসে৷ খুলনা থেকে, কুমিল্লা থেকে, নীলফামারি থেকে যে ছেলেটি খেলার স্বপ্ন নিয়ে ক্লাবতাঁবুতে এসে ওঠে, সে কী পরিবেশ পাচ্ছে? পাচ্ছে জুয়ার পরিবেশ; ক্যাসিনোর পরিবেশ৷ ওখানেই তো সব শেষ৷ মা-বাবারা কেন তাঁদের সন্তানকে এমন পরিবেশে পাঠাবেন?’’
নির্দিষ্ট কোনো আয়ের উৎস না থাকা বাংলাদেশের ক্রীড়া-ক্লাবগুলো চলে অনুদানের ভিত্তিতে৷ ক্যাসিনো-কাণ্ড প্রকাশ্য হওয়ায় এবার সে জায়গা সংকুচিত হবে; সামগ্রিক অর্থেই তাই দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ঘোর দুর্দিনের আশঙ্কা টিপুর, ‘‘এতদিন আমাদের ক্লাবগুলোর ক্রীড়ায় সাফল্য ছিল না৷ এবার যোগ হলো বদনাম৷ এখনো যে অল্পসংখ্যক নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক রয়েছেন, তারা কি ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে এ বদনামের ভাগীদার হতে চাইবেন? চাইবেন না৷ বসুন্ধরার মতো বড় প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু ক্লাব চালায়৷ অমন বড় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নতুন করে ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে এই ক্যাসিনো-লজ্জার ভাগ হতে চাইবে? চাইবে না৷ আগামী মৌসুমে ক্লাবগুলো তাই কিভাবে ফুটবল-হকি-ক্রিকেটসহ সব খেলার দল গঠন করবে, সেটি ভেবে পাচ্ছি না৷ খেলা মাঠে গড়ায় কিনা, তা নিয়েও আমার সন্দেহ৷’’
তবে এই ঘোর অন্ধকারেও সম্ভাবনার সূর্যরশ্মি দেখছেন আবাহনী ক্লাবের সংগঠক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি, ‘‘সময়টা অবশ্যই খারাপ৷ তবে এই খারাপ থেকে ভালো কিছুও হতে পারে৷ ক্লাবগুলোর আয়ের নির্দিষ্ট জায়গা তৈরি করতে হবে৷ সরকার, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় মিলে সেটি করা সম্ভব৷ তাহলে কালো টাকার মালিকরা এখানে আসতে পারবেন না৷ ক্লাবগুলো যদি বিত্তশালী কালো টাকার মালিকদের হাতে জিম্মি না হয়ে সত্যিকার সংগঠকদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে এ দুঃসময় কেটে যাবে৷’’
আর তা যদি না হয়, তাহলে বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনের জন্য অপেক্ষা করছে প্রলম্বিত দুঃস্বপ্ন৷