যারা ক্রনিক ব্যথায় ভোগেন, ডাক্তারদের পক্ষে তাদের সমস্যা বোঝা খুবই কঠিন৷ গবেষকরা এমন ব্যথা চিহ্নিত করে তার চিকিৎসা খোঁজার ক্ষেত্রে অগ্রসর হচ্ছেন৷ সরাসরি ব্যথার উৎস ও বিকাশ পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা অনেক জ্ঞান অর্জন করছেন৷
বিজ্ঞাপন
শরীরে ব্যথা জীবন দুর্বিষহ করে দুলতে পারে৷ অথচ তার উৎস অনেক সময়ে অজানা থেকে যায়, বিশেষ করে ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার ক্ষেত্রে৷ এমন অবস্থায় বেশিরভাগ মানুষ হন্যে হয়ে এক ডাক্তার ছেড়ে অন্য ডাক্তারের কাছে ছোটেন৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেউই সাহায্য করতে পারে না৷
শরীরে চোট পেলে সতর্কবাণী হিসেবে ব্যথা অনুভব করা অত্যন্ত জরুরি৷ কিন্তু ক্রনিক ব্যথার ক্ষেত্রে সেই প্রয়োজন থাকে না৷ সেই ব্যথা শরীরকে সুরক্ষা দেয় না, বরং ক্ষতি করে৷ এ যেন ত্রুটিপূর্ণ অ্যালার্ম ব্যবস্থার ভুল সংকেত৷
হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়েররোহিণী কুনার এই ‘ভুল’ ব্যথার উৎস খোঁজার চেষ্টা করছেন৷ আমাদের মস্তিষ্কে কোন প্রক্রিয়া কোনো ব্যথাকে স্থায়ী করে তোলে, তা অনেককাল ধরে অজানা ছিল৷ প্রো. কুনার বলেন, ‘‘কাঠামোগত পরিবর্তন না ক্রিয়াগত পরিবর্তন ব্যথার সঙ্গে জড়িত, তখন সেই প্রশ্ন উঠলো৷ অর্থাৎ কোনো স্নায়ু বা মস্তিষ্কের কোনো কোষ সক্রিয় হয়ে উঠেছে, না ব্যথার নতুন কোনো যাত্রাপথ বা স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে নতুন কোনো স্পন্দন দেখা যাচ্ছে?’’
হাঁটু ও কোমরের ব্যথায় যা করণীয়
বয়স বাড়ার সাথে সাথে শুরু হয় হাঁটু ও কোমরসহ শরীরের নানা জায়গায়, নানারকম ব্যথা৷ এ সব ব্যথাকে দূরে রাখতে কী করবেন তা জেনে নিন একজন জার্মান অর্থপেডিক্সের কাছ থেকে৷
ছবি: picture-alliance/chromorange
অবাক হলেও সত্যি
জার্মানিতে হাঁটু ও কোমরের ব্যথায় ভুগছেন অন্তত ৫০ লাখ মানুষ৷ মিউনিখ শহরের অর্থপেডিক্স ডা. কনরাড শয়ারার জানান, ‘‘শুনতে অবাক লাগলেও ব্যথাকে দূরে রাখার সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে হাঁটা-চলা এবং শরীর দুলিয়ে নৃত্য করা৷ কারণ একমাত্র শরীরকে ঠিকমতো সচল রাখলেই এ অসুখ কাছে ঘেষতে পারে না৷’’
ব্যথা শুরুর প্রথম লক্ষণ
শারীরিক কোনো পরিশ্রম বা ব্যায়াম না করলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরে তার প্রভাব পড়ে, ব্যথাও হয়৷ অনেকের অবশ্য কম বয়সেও এ সব ব্যথা হয়ে থাকে৷ হাঁটা-চলা করার সময় শরীরে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে কোমর এবং হাঁটু দু’টোয়৷ ডা. শয়ারার জানান, এই দু’টো অঙ্গে যখন ব্যথা অনুভব হয় তখন অনেকেরই হাঁটা-চলার আগ্রহ কমে যায়৷ আর এটাই হচ্ছে ব্যথা শুরুর প্রথম লক্ষণ৷
ছবি: Fotolia/Edler von Rabenstein
নিয়মিত ব্যায়াম
‘‘হাঁটা-চলা বন্ধ করলেই ব্যথা কমে যাবে – এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা৷ বরং নিয়মিত হাঁটা-হাঁটি এবং বিশেষ কিছু ব্যায়াম করে ব্যথা কমানো সম্ভব৷’’ বলেন ডা. কনরাড শয়ারার৷ তাছাড়া জোড়ে হাঁটার সময় পেশিতে চাপ পড়ে, যা পেশির জন্য খুবই ভালো৷ তবে এতে দুর্ঘটনা ঘটার কিছুটা ভয় থাকে৷ এক্ষেত্রে হাতে লাঠি বা ‘স্টিক’ থাকলে হাঁটু ও নিতম্বে চাপ খানিকটা কম পড়ে৷
ছবি: Fotolia/Kalle Kolodziej
নাচ ব্যথা কমায়
গান মনের দুঃখ-কষ্ট ও চাপ কমিয়ে দিয়ে মেজাজ ভালো করে৷ আর গানের সাথে ইচ্ছেমতো নাচলে কমে শরীরের ব্যথা৷ কারণ নাচার সময় শিরা এবং কোমরের ব্যথা কমে যায়৷ নাচ শুরুর পর পরই হাঁটু বা নিতম্বে ব্যথা হতে পারে৷ কিন্তু তখন না থেমে গিয়ে নিয়মিত ‘নাচ’ চালিয়ে যান৷ একসময় দেখবেন ‘ব্যথা’ উধাও!
ছবি: Colourbox
সাইকেল চালান
বাতের ব্যথা অথবা ‘রিউম্যাটিক পেইন’-এর জন্য সাইকেল চালানো খুবই উপকারি৷ আর রাস্তায় সাইকেল চালানো সম্ভব না হলে বাড়িতে, অর্থাৎ ‘হোমট্রেইনার’-এর মাধ্যমে সাইকেল চালাতে পারেন৷ তবে লক্ষ্য রাখবেন যেন পা দু’টোকে বেশি বড় বা ফাঁক করতে না হয়৷
ছবি: picture-alliance/ dpa/dpaweb
5 ছবি1 | 5
কোষে পরিবর্তন ও মস্তিষ্কে নতুন স্নায়ুর সংযোগ ক্রনিক ব্যথার কারণ হতে পারে৷ হাতেনাতে তার প্রমাণ পেতে রোহিণী কুনার ও তাঁর টিমকে সবার আগে ব্যথার আবির্ভাব পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে৷ প্রফেসর রোহিণী কুনার বলেন, ‘‘আমরা এমন পদ্ধতির খোঁজ চালিয়েছি, যার সাহায্যে আমরা কোনো অক্ষত জীবের ব্যথার গতিপথ দেখতে পারি৷ অর্থাৎ ঠিক যেন জানালা দিয়ে মস্তিষ্কে উঁকি মেরে দেখতে পারি, কীভাবে স্নায়ুকোষগুলির মধ্যে আদানপ্রদান ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে৷’’
এক মাল্টি-ফোটন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে গবেষকরা সরাসরি কোষের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন৷ রোহিণী কুনার ও তাঁর সহকর্মীরা বেশ কয়েক মাস ধরে ক্রনিক ব্যথায় ভোগা ইঁদুরের মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছেন৷ দেখা গেল, কাঠামোর সত্যি পরিবর্তন ঘটছে৷ নতুন সিন্যাপ্স তৈরি হচ্ছে, যা দুর্বল স্পন্দন পেলেও মস্তিষ্কে ব্যথার সংকেত পাঠিয়ে দিচ্ছে৷ এই অতি সংবেদনশীল স্নায়ুতন্ত্র ব্যথার বোধ দীর্ঘ সময়ের জন্য জীইয়ে রাখে৷ প্রো. কুনার বলেন, ‘‘যে স্পন্দন ব্যথা সৃষ্টি করে এবং যে সেটা করে না, ক্রনিক ব্যথার রোগীরা তার মধ্যে তফাত করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন৷ ফলে ত্বকে সাধারণ স্পর্শ পেলেই ব্যথা লাগতে পারে৷ যে কোনো স্টিমুলাসেই ব্যথা সৃষ্টি হতে পারে৷’’
স্নায়ুর এই পরিবর্তিত ট্র্যাক কি ক্রনিক ব্যথার চিকিৎসার চাবিকাঠি হতে পারে?
‘অপ্টোজেনেটিক্স’ নামের এক নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে গবেষকরা প্রথমবার ব্যথার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে পারছেন৷ আলোর প্রতি সংবেদনশীল প্রোটিন, যাকে পরিবর্তিত স্নায়ুর তন্তুর মধ্যে ব্যথার জন্য দায়ী বলে মনে করা হতো, সেটিকে আলো জ্বালিয়ে বা নিভিয়ে চালু বা বন্ধ করা সম্ভব৷ বিষয়টি আলোর সুইচের মতো৷
প্রো. রোহিণী কুনার ত্রুটিপূর্ণ ব্যথার উত্থান প্রতিরোধ করতে চান৷ ওষুধ বিশেষজ্ঞরা ক্রনিক ব্যথার চিকিৎসার জন্য সুনির্দিষ্ট ওষুধ তৈরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন৷ ফলে ভবিষ্যতে অনেক রোগীকে ফলহীন চিকিৎসা ও কড়া ব্যথার ওষুধের উপর নির্ভর করতে হবে না বলে আশা করা হচ্ছে৷
নানা ব্যথা লাঘবের ১০ উপায়
আজ মাথা ব্যথা তো কাল পেট ব্যথা কিংবা কান ব্যথা অথবা দাঁত ব্যথা৷ বাতের ব্যথাও আছে অনেকের৷ আর মনের ব্যথা তো লেগেই আছে৷ তাই সহজ উপায়ে এ সব ব্যথাকে দূরে রাখার উপায় জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Lars Zahner/colourbox
মন ব্যথা?
হাসি কিন্তু মন ভালো করে দেয়! সুন্দর জামা-কাপড় পরে এক টুকরো চকলেট মুখে দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে পড়ুন৷ হাসুন বা হাসি হাসি মুখ করে থাকুন৷ কারণ ‘হাসি আর অনুভূতি’ একে-অপরের ওপর প্রভাব ফেলে৷ তবে জোর করে হাসলে কিন্তু হবে না৷ এই তথ্য জানা গেছে জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট আম মাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এক গবেষণা থেকে৷
যোগব্যায়াম
সপ্তাহে দু’দিন যোগব্যায়াম বা ইয়োগা হাড়ের জয়েন্টের ব্যথা, ঘাড় ব্যথা ইত্যাদি কমায়৷ একটি সমীক্ষার ফলাফলে এ তথ্য জানা গেছে৷ তথ্যটি প্রকাশ করে ‘জার্নাল অফ রয়মাটোলজি’ ম্যাগাজিন থেকে৷ দেখা যা, যাঁরা ইয়োগা করেননি তাঁদের তুলনায় যাঁরা নিয়মিত যোগব্যায়াম করেছেন, তাঁরা শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভালো বোধ করেন৷
ছবি: Colourbox/D.Vietrov
শিশুদের অপারেশনের ব্যথায়
শিশুদের যে কোনো অপারেশনের পর মা-বাবাকে পাশে পেলে ওদের ব্যথা অনেকটাই কমে যায় বলে জানা গেছে ক্যানাডার হালিফাক্স-এর ডালহাউসি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এক গবেষণা থেকে৷ গবেষকরা জানান, অপারেশনের পর, অর্থাৎ শিশুরা জ্ঞান ফিরে মা-বাবাকে দেখলেই তা শিশুদের ব্যথার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে৷
ছবি: Getty Images/AFP
কান ব্যথায় পেঁয়াজ ও অলিভ অয়েল
পেঁয়াজে থাকা সংক্রমণ দমনকারী পদার্থ কানের ব্যথা বা সংক্রমণে কমাতে বেশ উপকারী৷ পেঁয়াজ ছোট ছোট করে কেটে গরম করার পর একটি পরিষ্কার কাপড়ে ঢেলে পুটলি বানিয়ে যেখানে ব্যথা, সেখানে আধঘণ্টা ধরে রাখুন৷ অথবা গরম অলিভ ওয়েলে একটা ছোট নরম কাপড় ভিজিয়ে সেটা কানের ঠিক পেছনে কয়েক মিনিট চাপ দিয়ে রাখুন৷ এই দু’টো উপায়ই কান ব্যথা কমাতে বেশ সাহায্য করে৷
ছবি: Christian Jung - Fotolia.com
বাতের ব্যথায় গোলমরিচ
ভালোভাবে গরম করা একমুঠো গোলমরিচ একটি কাপড়ে নিয়ে তা ব্যথার জায়গায় কিছুক্ষণ ধরে রাখলে বাতের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে৷ তবে ‘‘বাতের ব্যথায় ফিজিওথেরাপি, হাঁটাচলা, ব্যায়াম খুবই জরুরি৷’’ এ কথা বলেন জার্মান বাত বিশেষজ্ঞ ড. ইয়োহানেস পেটার হাস৷
ছবি: picture alliance/Arco Images GmbH
মাসিকের ব্যথা কমাতে
পিরিয়ডের ব্যথায় গরম পানির সেঁক, অর্থাৎ ‘হট ওয়াটার ব্যাগ’ বেশ উপকার করে৷ তলপেট, কোমর ও উরুতে হট ওয়াটার ব্যাগটি খানিক্ষণ ধরে রাখলে বেশ আরাম হয়৷ মাসিকের কারণে মাথা ধরা বা শরীর খারাপ লাগার ভাব কমাতে নাকের সামনে মাঝে মাঝে পুদিনা পাতা ধরে রাখলে খানিকটা ‘ফ্রেশ’ বা তাজা বোধ হয়৷
ছবি: Fotolia/Picture-Factory
মাথা ব্যথা
গরম পানি দিয়ে ভালোভাবে গোসল করার পর, বেশি করে আদা দিয়ে চা তৈরি করুন এবং ধীরে ধীরে তা পান করুন৷ আদা রক্তের প্রবাহকে ঠিক রাখে৷ শুধু তাই নয়, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হলে বমিভাবও হয়৷ আদা ঐ ভাব কমাতে দ্রুত সাহায্য করে৷ তাছাড়া এক গ্লাস গরম পানিতে অর্ধেক লেবুর রস ঢেলে পান করতে পারেন৷ তারপর বাকি অর্ধেক লেবু কপালে ঘষতে পারেন, অবশ্যই ভালো লাগবে৷
ছবি: Colourbox
জটিল মাথা ব্যথা ‘মাইগ্রেন’
জার্মানিতে মাথা ব্যথায় ভোগেন প্রায় ৮০ লাখ মানুষ৷ তার মধ্যে জটিল ব্যথা বা মাইগ্রেনে ভোগা রোগীর সংখ্যা শতকরা ১০ জন৷ ‘‘আমি আমার মাইগ্রেনের রোগীদের সপ্তাহে তিনদিন ব্যায়াম, মুক্ত বাতাসে হাঁটাচলা, সময়মতো খাওয়া-দাওয়া, যথেষ্ট ঘুম, কম কাজের চাপ ও যথেষ্ট পানি পান করার কথা বলি৷’’ – এই পরামর্শ জার্মানির মাথাব্যথা ও মাইগ্রেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার চার্লি গাউল-এর৷
ছবি: Colourbox/L Dolgachov
কোমর ব্যথা
কোমর ব্যথায় নিজে থেকে কিছু না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়াই শ্রেয়৷ তবে নারীদের ক্ষেত্রে কোমর ব্যথায় হাই হিল একেবারেই পরা উচিত নয়৷
ছবি: Fotolia/Peter Atkins
গলা ব্যথায়
ঋতু পরিবর্তন মানেই গলা ব্যথা৷ তাই এ সময় একটু সাবধানে থাকা উচিত৷ গলা ব্যথায় আদার রস, মধু ও লেবুর রস বেশ উপকারী৷ এছাড়া গলা ব্যথায় লবঙ্গের ব্যবহার বহুদিনের৷ লবঙ্গ অ্যান্টি-ব্যক্টেরিয়াল, তাই গলা ব্যথা শুরু হলেই লবঙ্গ চিবোতে থাকুন, ব্যথা কমে যাবে৷