এক দৈনিকের খবর অনুযায়ী, এক এমপি বলেছেন, ‘‘পাঁচজনকে ক্রসফায়ার দিয়েছি, ১৪ জনের লিস্ট করেছি৷'' তবে ডয়চে ভেলের কাছে তাঁর দাবি, ‘‘ক্রসফয়ারে দিয়েছে পুলিশ৷ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হয়েছে, অপারেশন ক্লিনহার্টও ভালো ফল দিয়েছে৷''
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের ট্যাবলয়েড দৈনিক ‘মানবজমিনকে' এক সাক্ষাৎকারে সাভারের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ডা. এনামুর রহমান বলেছিলেন, ‘‘সাভারে অনেক ক্যাডার আর মাস্তান ছিল৷ এখন সব পানি হয়ে গেছে৷ কারও ‘টু' শব্দ করার সাহস নেই৷ পাঁচজনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছি, আরো ১৪ জনের লিস্ট করেছি৷ এখন সব ঠান্ডা৷ লিস্ট করার পর যে দু'একজন ছিল তারা আমার পা ধরে বলেছে, আমাকে জানে মাইরেন না৷ আমরা ভালো হয়ে যাবো৷''
কিন্তু ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে ডা. এনামুরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমি ঠিক ওভাবে বলিনি৷ ওরা ঘুরিয়ে লিখেছে৷ আমি বলেছি, পুলিশ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে৷ আরো ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তালিকা হচ্ছে৷ এ সব কারণে সাভারের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হয়েছে৷''
ডা. এনামুর রহমান
এই ব্যবস্থার মানে কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ক্রসফায়ার? আমি তো ক্রসফায়ার দেই না৷ এটা দেয় পুলিশ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ তাদের ওপর হামলা হয়, তারাও জবাব দেয়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘অপারেশন ক্লিনহার্ট এবং এখন যে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে (ক্রসফায়ার) তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে৷ মানুষ ভালো আছে৷''
সাভারে ক্রসফায়ারের জন্য ১৪ জনের তালিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘সন্ত্রাসী এবং মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা হয়েছে৷ যাদের বিরুদ্ধে আটটির বেশি মামলা আছে, তারাই এই তালিকায় আছে৷''
তাহলে তাদেরও কি ক্রসফায়ারে দেয়া হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷''
কাজী সোহাগ
তাঁর কথায়, ‘‘ওই পাঁচজনকে গত চার বছরে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে৷ তারা সন্ত্রাসী এবং বহু মামলার আসমি৷''
দু-একজন আপনার হাত-পা ধরে ক্রসফায়ার থেকে নাকি রেহাইও পেয়েছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এমন কথা আমি কোথাও বলিনি৷ এটা ডাহা মিথ্যা কথা৷''
এদিকে মানবজমিনে প্রকাশিত প্রতিবদেনের প্রদিবেদক কাজী সোহাগ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এমপি ডা. এনামুর রহমান আমাকে যা বলেছেন, তাই উদ্ধৃত করা হয়েছে৷ তাঁর কথার রেকর্ডিং আমার কাছে আছে৷ তাঁর অনুমতি নিয়েই তাঁর সাক্ষাৎকার রেকর্ড করা হয়৷ গোপনে ধারণ করা হয়নি৷''
কাজী সোহাগ বলেন, ‘‘আমি ক্রসফায়ার নিয়ে কোনো প্রশ্ন তাঁকে করিনি৷ তিনি নিজেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বলতে গিয়ে পাঁচজনকে ক্রসফায়ারে দেয়ার কথা বলেছেন৷ বলেছেন ১৪ জনের তালিকা করার কথাও৷ তাঁর কথা হুবহু উদ্ধৃত করা হয়েছে আমাদের পত্রিকায়৷''
সংসদ সদস্য এনামুর রহমান এখনো (বুধবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত) কোনো প্রতিবাদ পাঠনননি বলে জানান কাজী সোহাগ৷
তৌহিদ জং মুরাদ
রানা প্লাজা ধসের পর ডা. এনামুর রহমান সাভারে তাঁর নিজম্ব ক্লিনিক এনাম মেডিক্যালে আহতদের চিকিৎসা দিয়ে আলোচনায় আসেন এবং প্রশংসিত হন৷ এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হন তিনি৷ এর আগে সাভারের সংসদ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগেরই তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদ৷
ডা. এনামুরের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করলে সাভারের সরকার দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা কোনো সুস্থ মানুষের কথা না৷ কোনো সুস্থ মানুষ এটা বলতে পারেন না৷ এটা তো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ার৷ জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাদের কাজ হলো জনগণের নিরাপত্তা দেয়া৷''
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কি তালিকা করে ক্রসফায়ারে দেয়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আই ডোন্ট থিংক সো৷''
বন্ধু, আপনার কী মনে হয়? ক্রসফায়ারে দেয় এমপি, না পুলিশ? জানান নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’