গত দুই বছরে কক্সবাজার এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৩৩ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে৷ পুলিশের দাবি, নিহত রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিল৷
বিজ্ঞাপন
তবে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস বলেছে নিহতরা রোহিঙ্গা কিনা সে বিষয়টি নিশ্চিত নয়৷ কারণ তারা নিহত হয়েছেন ক্যাম্পের বাইরে৷
সর্বশেষ রবিবার ভোর রাতে টেকনাফের হ্নীলা জাদিমুরা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন রোহিঙ্গা নূর মোহাম্মদ৷ গত ২২ আগস্ট যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক হত্যা মামলার আসামি ছিলেন তিনি৷ টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমর দাস বলেন, ‘‘নূর মোহাম্মদ একটি সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের নেতা৷ তাকে আটকের পর ওই এলাকায় অস্ত্র উদ্ধারে গিয়েছিল পুলিশ৷ এসময় তার সহযোগীরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হয়৷ এই ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন৷ আর ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র, ১৮ রাউন্ড গুলি, ২০ রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে৷''
এর আগে গত ২৩ আগস্ট একই এলকায় ওমর ফারুক হত্যা মামলার আরো দুই আসামি রোহিঙ্গা শরনার্থী মোহাম্মদ শাহ ও মোহাম্মদ শুক্কুর পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়৷ তারাও ডাকাত দলের সদস্য বলে দাবি করেছে পুলিশ৷
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার পর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় তারা: মো. ইকবাল হোসেন
কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত দুই বছরে ৩৩জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘নিহতরা হত্যা, ডাকাতি, মাদক পাচার, অপহরণ, চাঁদাবাজী ও মুক্তিপণ আদায়ের মত অপরাধে জড়িত ছিল৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার পর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় তারা৷ প্রতিটি ঘটনায়ই মামলা হয়েছে এবং তদন্ত চলছে৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে বেশ কিছু সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র গড়ে উঠছে৷ তাদের কাছে অবৈধ অস্ত্র আছে৷ তারা ক্যাম্পে এবং আশেপাশের এলাকায় নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে৷’’
কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, দুই বছরে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি'র সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া ছাড়াও নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে আরো ৪৩ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী নিহত হয়েছেন৷ এ দুবছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চারশ' ৭১টি মামলা হয়েছে৷ এসব মামলায় আসামির সংখ্যা এক হাজার ৮৮ জন৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো মাদক সংক্রান্ত মামলা৷ যার সংখ্যা দুশ'৷ তাছাড়া মানব পাচারের অভিযোগে চারটি মামলাসহ অস্ত্র, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, নারী নির্যাতন, অপহরণ ও পুলিশের ওপর হামলার মামলা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে৷
তবে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস-এর সাধারণ সম্পাদক সাঈদ উল্লাহ ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন, ‘‘যারা ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে তারা রোহিঙ্গা কিনা আমরা জানিনা৷ তারা যে রোহিঙ্গা শরনার্থী এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি৷ কারণ যারা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে তাদের কেউ ক্যাম্পের বাসিন্দা নয়৷ তারা ডাকাত এবং সন্ত্রাসী৷ রোহিঙ্গারা শরনার্থী ক্যাম্পে থাকেন৷ ক্যাম্পের বাইরে কে কোথায় কি করে তা আমাদের জানা নেই৷’’
ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কম: সাঈদ উল্লাহ
তিনি বলেন, ‘‘তবে কিছু রোহিঙ্গা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে৷ ক্যাম্পের মধ্যেও কিছু অপরাধের ঘটনা ঘটছে৷ এত মানুষ যেখানে থাকেন সেখানে কিছু অপরাধ হওয়াতো স্বাভাবিক৷'' তাঁর দাবি, রাখাইনে থাকার সময়ের চেয়ে কক্সবাজারের ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা অনেক কম৷
কক্সবাজারের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাস্পে এখন সব মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থীর রয়েছে৷ এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট-এর পর থেকে এসেছে আট লাখ৷ এসব ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নয়টি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে৷ মোতায়েন করা হয়েছে ১১শ' পুলিশ ফোর্স৷
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন জানান, ‘‘আমরা এখন পরিস্থিতি মোকাবেলায় ক্যাম্পগুলোর চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার প্রস্তাব করেছি৷ অননুমোদিত মোবাইল সিম বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি৷’’
৫ কোটি ১০ লাখ শরণার্থীর কথা
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক মানবাধিকার সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, বিশ্বে এ মুহূর্তে অন্তত ৫ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ কোনো-না-কোনো কারণে দেশছাড়া, অর্থাৎ শরণার্থী৷ তাঁদের নিয়েই আজকের ছবিঘর৷
ছবি: Reuters/D. Whiteside
শরণার্থী কারা?
ইউএনএইচসিআর-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, কেউ যদি জাতি, ধর্ম, গোষ্ঠী বা কোনো শ্রেণিগত বৈষম্য কিংবা কোনো মতপার্থক্যের কারণে ভীত হয়ে নিজের ঘর বা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, তাহলে তিনি শরণার্থী৷ প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া মানুষদেরও শরণার্থী হিসেবে গণ্য করে ইউএনএইচসিআর৷ ছবির এই শিশু তুরস্কে আশ্রয় নেয়া সিরীয় শরণার্থী৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Kilic
সহিংসতার কারণে গৃহহারা
ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিবেদন বলছে, এ মুহূর্তে বিশ্বের কমপক্ষে ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষ সহিংসতার কারণে শরণার্থী৷ সহিংসতা বা বিরোধের কারণে ঘর ছেড়ে নিজের দেশেরই অন্য কোথাও আশ্রয় নেয়া মানুষদেরও রাখা হয়েছে এই হিসেবে৷ ওপরের ছবির মানুষগুলো আফ্রিকার দেশ ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর, সেনাবাহিনীর এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর রুৎশুরু শহরের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বাধ্য হন তাঁরা
ছবি: Getty Images/AFP/J. D. Kannah
রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী
অনেকেই অন্য দেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন৷ সব শর্ত পূরণ না হওয়ায় তাদের বেশির ভাগই হয়ে যান শরণার্থী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Schmidt
সংখ্যাধিক্যই বড় সমস্যা
শরণার্থী সমস্যা বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই বড় সংকট হয়ে উঠছে৷ শরণার্থীদের সংখ্যা এত দ্রুত বাড়ছে যে সংকটের আশু নিরসন দুরূহ হয়ে পড়ছে৷ পরিসংখ্যান বলছে, এ মুহূর্তে মোট শরণার্থীর সংখ্যা স্পেন, ক্যানাডা বা দক্ষিণ কোরিয়ার মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি!
ছবি: Getty Images/AFP/A. Pizzoli
আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং সোমালিয়া
২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্বের মোট শরণার্থীর শতকরা পঞ্চাশ ভাগেরও বেশি ছিল আফগান, সিরীয় এবং সোমালীয়৷ অর্থাৎ এই তিন দেশের মোট শরণার্থী বিশ্বের মোট শরণার্থীর অর্ধেকেরও বেশি৷ ছবিতে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়া এক আফগান পরিবার৷
ছবি: Majeed/AFP/Getty Images
স্বদেশেই শরণার্থী
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, অন্য দেশে আশ্রয় নেয়া মানুষের চেয়ে নিজের দেশেই শরণার্থী হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি৷ ২০১৩ সালে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন ১ কোটি ৬৭ লাখ মানুষ, অন্যদিকে নিজের দেশে গৃহহারার সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৩৩ লাখ৷
আশ্রয় শিবিরের বাইরে...
সব শরণার্থী কিন্তু আশ্রয় শিবিরে থাকেন না৷ বরং বিশ্বের মোট শরণার্থীর তিন ভাগের দুইভাগই বাস করছেন আশ্রয় শিবিরের বাইরে৷ শহর বা গ্রামের কোনো ফাঁকা জায়গায়, কিংবা কোনো অ্যাপার্টমেন্টে গাদাগাদি করে থাকতে দেখা যায় তাঁদের৷
ছবি: Getty Images/AFP/Z. Abubeker
শিশুদের দুর্বিষহ জীবন
মোট শরণার্থীর শতকরা ৪৬ ভাগই শিশু৷ ঘরছাড়া এই শিশুদের জীবনে লেখাপড়া নেই, কোনো সাধ-আহ্লাদও নেই৷ ছবির এই মা, শিশু সিরিয়ার৷ গ্রিসের লেসবসে আশ্রয় নিয়েছে তারা৷
ছবি: Getty Images/AFP/L. Gouliamaki
নির্যাতনের শিকার
৫ কোটি ১০ লাখ শরণার্থীর অন্তত ৩৫ ভাগই কোনো-না-কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার৷ শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকারদের অনেকেই স্বাভাবিক হতে পারছেন না৷ যু্দ্ধ আর নির্যাতনের আতঙ্ক অনুক্ষণ তাড়া করে তাঁদের!
ছবি: JAMES LAWLER DUGGAN/AFP/GettyImages
শেষ আশ্রয় যুক্তরাষ্ট্র!
সহিংসতা বা বিরোধের কারণে একবার দেশ ছাড়লে খুব কম মানুষই আবার নিজের দেশে ফিরতে চান৷ অথচ যে দেশে থাকতে চান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে দেশ তাঁদের দায়িত্ব নিতে চায় না৷ এমন পরিস্থিতিতে আশ্রয়প্রার্থীদের নতুন কোনো দেশে পাঠানোর চেষ্টা করে ইউএনএইচসিআর৷ তবে খুব কম শরণার্থীই সেই সুযোগ পায়৷ তবে এমন শরণার্থীদের সবচেয়ে বেশি আশ্রয় দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ সংখ্যাটা অবশ্য নগন্য, বিশ্বের মোট শরণার্থীর মাত্র ১ শতাংশ!