যুবলীগ নেতা মিল্কি হত্যার সন্দেহভাজন ঘাতক তারেকের নিহত হওয়ার ঘটনা নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে৷ ব়্যাবের দাবি, তারা পাল্টা গুলি ছুড়লে তারেক নিহত হয়৷ তবে ড. মিজানুর রহমান মনে করেন, বড় অপরাধীকে আড়াল করতেই এই ‘ক্রসফায়ার’ নাটক৷
বিজ্ঞাপন
সোমবার গভীর রাতে গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ড-এর সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় শাসক দল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কিকে৷ সিসি টিভি-র ফুটেজে পুরো হত্যাকাণ্ডের ঘটনার রেকর্ড থেকে যায়৷ আর তা সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করলে সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়৷ কারণ ঘাতকরা আবার যুবলীগেরই নেতা৷ তাদের মধ্যে যুবলীগ নেতা জাহিদ সিদ্দিকী তারেককে আহত অবস্থায় উত্তরার একটি হাসপাতালে আটক করে ব়্যাব৷ ব়্যাব দাবি করে যে বুধবার রাত ১০টার দিকে তাঁকে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের জন্য নেয়ার পথে কুড়িল এলাকায় তাদের ওপর হামলা করে সন্ত্রাসীরা৷ এরপর উভয় পক্ষের বন্দুক যুদ্ধে তারেক এবং তাঁর সহযোগী শাহ আলম নিহত হন৷ ব়্যাবের দাবি, তারেককে সন্ত্রাসীরা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল৷
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়েত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে৷ এদিকে দাবি উঠেছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
‘‘জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল’’
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (০১.০৮.১৩) বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনায়েতুর রহিম এবং কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রায়ে বলা হয়, ‘‘জামায়াতের গঠনতন্ত্র শুধু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
২০০৯ সালের রিটের রায়
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হাইকোর্টে রিট করেন ২০০৯ সালে৷ রিটে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়, জানান ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর৷ সেই রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করলেন আদালত৷
ছবি: Reuters
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
আদালতের রায়ের পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানান, রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ সেজন্য ইতিমধ্যে রায়ের কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেদলের কিছু নেতার হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত৷’’
ছবি: AP
ট্রাইব্যুনালে বিচার
জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে৷ এই ছবিঘর তৈরির দিন (০১.০৮.১৩) অবধি ছয়জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল৷ সর্বশেষ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়েছে৷ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও সরকার এতটা সাহসী হবে বলে আশা করেন না৷ মুনতাসির মামুনের কথায়, ‘‘জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে তা বলাও হয়েছে৷ তাই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্লগারদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণার আগেই ফেসবুকে আরিফ জিবতেক লিখেছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়টা কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া মামলা না৷ মামলাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত আইনসিদ্ধভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে বিবেচনা৷’’ এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই৷’’
ছবি: privat
এই দাবি নতুন নয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মোট তিনবার দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷
ব়্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লে. কর্ণেল জিয়উল আহসান ডয়চে ভেলেকে জানান, সিসি টিভি-র ফুটেজে যে ব্যক্তি মিল্কিকে গুলি করছে বলে দেখা যায় সেই হলো তারেক৷ তবে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান শুভ্র ডয়চে ভেলেকে জানান, এই ‘ক্রসফায়ার'-এর ঘটনা নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন সহজেই তোলা যায়৷ ব়্যাব কেন তারেককে রাতের বেলায় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে গেল৷ তাঁর মতো একজন ‘অপরাধী'-কে নিয়ে চলাচলের সময় কেন পর্যাপ্ত ফোর্স নেয়া হয়নি৷ আর এতেই বোঝা যায় যে এটা একটি সাজানো নাটক৷
তিনি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মধ্যে তারেকই যে শেষ ব্যক্তি, তা নয়৷ সংবাদমাধ্যমে এরই মধ্যে শাসক দলের আরো অনেক প্রভাবশালীদের কথা বলা হয়েছে নেপথ্যের ইন্ধন দাতা হিসেবে৷ বলা হয়েছে মিল্কি টেন্ডার বাজির বলি হয়েছেন৷ তাই তারেক বেঁচে থাকলে এবং তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরো অনেকের নাম জানা যেত৷ বেড়িয়ে আসত নেপথ্যের আরো অনেক ঘটনা৷ হয়ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা জানতো৷ তাই শাসক দলের প্রভাবশালী কাউকে বাঁচাতে অথবা বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে এই বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা সাজানো হয়েছে৷
আদিলুর রহমান খান বলেন, ক্রসফায়ার সমর্থনযোগ্য নয়৷ ক্রসফায়ার কোনো পক্ষের ন্যায় বিচার নিশ্চিতও করে না৷ তাঁর মতে, এর মাধ্যমে নিহত মিল্কির পরবিারও ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবে৷ কারণ, অনেক তথ্য আর জানা যাবে না৷
এদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, এই প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক যে তারেককে ক্রস ফয়ারে দিয়ে মূল অপরাধীদের আড়াল করা হলো কিনা৷ কোনো বড় অপরাধীকে বাঁচাতে এই ক্রসফায়ারের নাটক সাজানো হতে পারে৷ কারণ তারেক বেঁচে থাকলে তাদের নামও প্রকাশ করত৷ তিনি বলেন, তারেকের কাছ থেকে যে তথ্য পাওয়া যেত তা মামলার তদন্তে সহায়তা করত৷ তাঁর কথায়, গত কয়েকদিনে তারেকসহ আরো কয়েকটি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে৷ এতে মানবাধিকার কমিশন উদ্বিগ্ন৷ কমিশন বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে এই উদ্বেগের কথা জানিয়েছে৷ ড. মিজান বলেন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ দেখে শুনে মনে হচ্ছে যে, একদল অপরাধীকে আড়াল করতে আরেক দলকে ক্রসফায়ারের বলি করা হচ্ছে৷