গত দু'দিনে অন্তত পাঁচটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ‘ক্রসফায়ারের' ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী একে বলছে ‘বন্দুকযুদ্ধ'৷ মানবাধিকার কর্মীদের ভাষায়, ক্রসফায়ার যেন নতুন গতি পেয়েছে৷ অব্যাহত বিচারহীনতাই এর প্রমাণ৷
বিজ্ঞাপন
গত দু'দিনে যাঁরা ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে তিনজন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতা৷ এ নিয়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগে ক্ষোভ থাকলেও সড়ক যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘‘সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে, অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে৷''
ওদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বলেছেন, ‘‘অপরাধী আটক করতে গেলে দু-একটা ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটতেই পারে৷ এতে করার কিছু নাই৷''
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার'-এর হিসেব অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে ১,৬৫৩টি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে৷ ২০১৪ সালে ক্রসফয়ারে নিহত হয়েছেন ১১৯ জন আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ৫৯ জন৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুয়ায়ী, চলতি বছরের গত সাত মাসে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে ১১৩টি৷ আসক-এর পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আন্তর্জাতিক মহলের চাপের কারণে ক্রসফায়ারের ঘটনা কিছু কমে এলেও, সাম্প্রতিক সময়ে তা আবার বেড়েছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘দেখে-শুনে মনে হচ্ছে ক্রসফায়ার যেন নতুন গতি পেয়েছে৷''
২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশে ক্রসফায়ারের বিষয়টি আলোচনায় আসে৷ এখন র্যাব ছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য ইউনিটের বিরুদ্ধেও ক্রসফায়ারের অভিযোগ বাড়তে থাকে৷ র্যাব-এর ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড' নিয়ে বারবার সরকারকে বিপাকে পড়তে হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো একাধিকবার র্যাব-এর কার্যক্রম বন্ধ অথবা পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও র্যাব-এর এই ধরণের কর্মকাণ্ড বন্ধের কথা বলেছে, তবে তাতে তেমন কাজ হচ্ছে না৷
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
র্যাব-এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান অবশ্য ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন, ‘‘এ ধরনের প্রতিটি ঘটনারই তদন্ত হয়৷ এবং কোনো র্যাব সদস্যের দায় পাওয়া গেলে তা আমলে নেয়া হয়৷''
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘কোনো ক্রসফায়ারই গ্রহণযোগ্য নয়, এমনকি সে যদি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও হয়৷ এছাড়া ক্রসফায়ারের এই সব ঘটনা দিয়ে কোনো অপরাধীকে হত্যা করার আইন বা অধিকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নেই৷ তাহলে তো দেশে আর বিচারব্যবস্থা বলে কিছু থাকে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘সংবিধান ও মানবাধিকারের এই লঙ্ঘন কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না৷ প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত এবং বিচার হওয়া প্রয়োজন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘বিচারব্যবস্থার ত্রুটিকে ক্রসফায়ার দিয়ে ঢাকা যায় না৷ এতে বিচারহীনতা আরো জেঁকে বসে৷''