রাশিয়া ক্রাইমিয়ায় সৈন্য পাঠানোর পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাটো সমালোচনায় মুখর৷ বৈঠকের পর বৈঠক চলছে এবং আগামীতেও চলবে৷ তা-তে অন্তত বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা৷
বিজ্ঞাপন
ক্রাইমিয়ার পরিস্থিতি ক্রমেই আশঙ্কাজনক হয়ে উঠছে৷ ইউক্রেন সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখছে এবং ন্যাটোর সাহায্য প্রার্থনা করেছে৷ রবিবার ন্যাটোর বৈঠকের আগেই জোটের মহাসচিব আন্ডার্স ফগ রাসমুসেন রাশিয়ার প্রতি অবিলম্বে সামরিক অভিযান বন্ধ করার আহ্বান জানান৷ ‘‘রাশিয়া বর্তমানে ইউক্রেনে যা করছে, তা জাতিসংঘের সনদের বিরোধী৷ এর ফলে ইউরোপের শান্তি ও নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে'', বলেছেন রাসমুসেন৷
জার্মানির তরফ থেকেও বক্তব্য স্পষ্ট৷ চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেছেন, ‘‘ক্রাইমিয়ায় যা ঘটছে, তা নিয়ে আমরা বিশেষভাবে চিন্তিত৷'' পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাংক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার ঘোষণা করেছেন, রাশিয়া ক্রাইমিয়ায় যা করছে, তা ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও রাজ্যাঞ্চলিক সংহতির সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খেতে হবে৷
রাশিয়ায় সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন, রাশিয়ার ব্যাপারে নয়
অপরদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, ন্যাটোর রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলা উচিত৷ এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে ন্যাটো-রাশিয়া পরিষদের বৈঠক আহ্বানের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন হ্যারাল্ড কুইয়াট, যিনি জার্মান সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান এবং ন্যাটোর সামরিক পরিষদের সাবেক সভাপতি৷ রাশিয়ার উপর সেটাই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতো, বলে তিনি মনে করেন৷
ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়৷ কাজেই ন্যাটোর পক্ষে আপাতত ইউক্রেনকে বাস্তবিক সাহায্য করা সম্ভব নয় বলেই কুইয়াটের ধারণা – সামরিক সাহায্য প্রদান তো নয়ই: রাশিয়া যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তি, তা বিস্মৃত হলে চলবে না৷ কাজেই কুইয়াটের পরামর্শ হলো: রাশিয়ার সম্বন্ধে কথা না বলে, রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করো৷
ইয়ানুকোভিচের পলায়ন, টিমোশেঙ্কোর মুক্তি
কখনো কখনো সময়ের পরিবর্তন দেখে অবাক হতে হয়৷ ইউক্রেনের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ এখন পলাতক আর তাঁর প্রতিপক্ষ টিমোশেঙ্কো কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ক্ষমতায় ফেরার অপেক্ষায়৷ এই নিয়েই আজকের ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ভীষণ ক্লান্ত, তাতে কী!
কারাগারে আড়াই বছর কাটিয়ে ইউলিয়া টিমোশেঙ্কো ভীষণ ক্লান্ত৷ তবে বড় কথা হলো, গত শনিবার থেকে তিনি মুক্ত৷ তাঁর রাজনৈতিক শত্রু বলে পরিচিত ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতা হারানোর পরপরই রাজধানী কিয়েভ ছেড়ে পালিয়েছেন৷ প্রায় একই সময়ে মুক্ত জীবনের আস্বাদ পাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী টিমোশেঙ্কো ফিরেছেন কিয়েভে৷ কে বলবে কয়েকদিন আগেও পিঠের প্রচণ্ড ব্যথা সইতে না পেরে খারকিভের হাসপাতালে ভর্ত্তি হতে হয়েছিল তাঁকে!
ছবি: Reuters
ঐতিহাসিক সংসদ অধিবেশন
গণবিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের আসন এমনিতেই টলে গিয়েছিল৷ তাই ইউক্রেনের সংসদ ভেরহোভনা রাডায় বিরুদ্ধে অভিসংশনের প্রস্তাব পাশ হওয়ায় পালানো ছাড়া উপায় ছিল না তাঁর৷ একই অধিবেশনে কারাবন্দী টিমোশেঙ্কোকে মুক্তি দেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়৷ ঐতিহাসিক এ অধিবেশনে ইউক্রেনের সংসদ সদস্যরা আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিনও চূড়ান্ত করেছেন৷ আগামী ২৫শে মে নির্বাচন হবে পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে৷
ছবি: Reuters
সংগ্রামমুখর কয়েকটি বছর
নিজের মুক্তির দাবি আদায়ের জন্য এতদিন চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি ৫৩ বছর বয়সি টিমোশেঙ্কো৷ কারাগারে অনশন ধর্মঘট করেছেন বেশ কয়েকবার৷ পরিবারের সদস্যরা তাঁর পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছেন দেশে-বিদেশে৷ কারাগারে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন টিমোশেঙ্কো৷ অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিতে হয়েছিল বার্লিনের শারিটে হাসপাতাল থেকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রাজনৈতিক সুবিচার
গত কয়েকবছর ধরে ইউক্রেন সরকার এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সম্পর্কের মাঝে কাঁটা হয়ে ছিলেন ইউলিয়া টিমোশেঙ্কো৷ দু’দফা ক্ষমতায় ছিলেন তিনি৷ তখন ইউক্রেনকে ইইউ-র অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছেন অবিরাম৷ সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ ইইউ-র সঙ্গে যে চুক্তি স্বাক্ষর না করায় দেশ জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়, সেই চুক্তির শর্তের মধ্যে টিমোশেঙ্কোর মুক্তির বিষয়টিরও উল্লেখ ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্ট্রাসবুর্গের ভর্ৎসনা
টিমোশেঙ্কোকে কারাদণ্ডাদেশ দিয়ে ইউক্রেনের আদালত শুধু যে ইইউ-র সমালোচনার শিকার হয়েছে, তা কিন্তু নয়৷ ২০১৩ সালে এক ঘোষণায় স্ট্রাসবুর্গে অবস্থিত ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত জানায়, ইউক্রেনের আদালত টিমোশেঙ্কোর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে৷ ঘোষণায় আরো বলা হয়, টিমোশেঙ্কোকে অযৌক্তিকভাবে কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছে আদালত৷
ছবি: Patrick Hertzog/AFP/Getty Images
ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে অভিযুক্ত
২০১১ সালের আগস্ট মাসে টিমোশেঙ্কোকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় তাঁকে৷ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাশিয়ার গ্যাস কম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করার কারণে এই শাস্তি দিয়েছিল আদালত৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
প্রতীকী ব্যক্তিত্ব
ইউক্রেনের অনেক মানুষের কাছে টিমোশেঙ্কো দশ বছর আগের ‘কমলা বিপ্লব’-এর প্রতীকী ব্যক্তিত্ব৷ গণতন্ত্র মুক্তির সেই আন্দোলনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল৷ সেই সুবাদে দু-দুবার প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন তিনি৷
ছবি: Reuters
ভালো-মন্দে মেশানো অতীত
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বে টিমোশেঙ্কোর এখনো খুব সমাদর৷ তবে বিনুনি কাটা চুলের এই রাজনৈতিক নেত্রী প্রধানমন্ত্রী হবার পর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেননি৷ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: SERGEI SUPINSKY/AFP/Getty Images
বিক্ষোভেও তিনি ছিলেন
ইউক্রেনের সাম্প্রতিক বিক্ষোভে বিক্ষোভকারীদের হাতে হাতে ছিল টিমোশেঙ্কোর ছবি৷ কারামুক্তির পর টিমোশেঙ্কো ফিরেছেন কিয়েভে৷ ফিরেই জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হবেন৷ ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে শাস্তি পাওয়া টিমোশেঙ্কো তাই আবার ক্ষমতায় ফেরার অপেক্ষায়৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
মধ্যস্থের ভূমিকায় ন্যাটো?
সামরিক বিশেষজ্ঞ ক্লাউস মমসেনের মতে ন্যাটো এই সংঘাতে সত্যিই মধ্যস্থের ভূমিকা নিতে পারে৷ মমসেন বলেন: ‘‘ন্যাটো তো শুধু একটা প্রতিরক্ষা জোট নয়; বরং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়া যাবৎ ন্যাটো একটি রাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত হয়েছে, যে মঞ্চে রাশিয়াও উপস্থিত, যেমন ন্যাটো-রাশিয়া পরিষদের মাধ্যমে৷''
২০০৮ সালে যখন রাশিয়া এবং জর্জিয়ার মধ্যে যুদ্ধ চলে, তখনও ন্যাটো প্রধানত কূটনৈতিক পন্থাতেই তার প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেছিল৷ দক্ষিণ অসেশিয়া ও আবখাজিয়া আজও রুশ প্রোটেক্টোরেট বা সুরক্ষিত এলাকা৷ ন্যাটোর সে কথা খুব ভালোভাবেই স্মরণে আছে, বলে মমসেন মনে করেন৷
রাশিয়াকে অবশ্য আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা চলে, যেমন সোচিতে জি-এইট গোষ্ঠীর বৈঠক বর্জন করার মাধ্যমে৷ কিন্তু সে ধরনের বয়কটের প্রতীকী মূল্য ছাড়া আর কিছু থাকবে কি? প্রশ্ন তুলেছেন মমসেন৷ আবার একেবারে কোনো আশা নেই, এমন তো নয়৷ রুশ প্রধানমন্ত্রী মেদভেদেভ তাঁর ইউক্রেনীয় সতীর্থের সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ সেটাও এক ধরনের যোগাযোগ, মনে করেন মমসেন৷