1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ক্লাব-সমিতির নির্বাচন : সকলি গরল ভেল

নূর সিদ্দিকী, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
নূর সিদ্দিকী
২৪ মার্চ ২০২৩

উচ্চ আদালতে আমার যাতায়াত শুরু ২০০৮ সালে৷ ওই বছরই টেলিভিশন সাংবাদিকতায় নাম লেখাই৷ একুশে টেলিভিশনে যোগদানের দিন দশেকের মাথায় আমাকে উচ্চ আদালতে যেতে বলা হয়৷

ছবি: Md Abdul Halim

টালমাটাল অবস্থা তখন দেশের৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল৷ আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক নেতারাই কারাগারে৷ ফলে উচ্চ আদালত খুব গরম৷ প্রতিদিনই প্রধান শিরোনাম বা বুলেটিনের প্রথমভাগে জায়গা পায় এমন সব প্রতিবেদন করতে হতো৷ সেই থেকে শুরু উচ্চ আদালতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক৷

সময়ের হিসেবে ১৫ বছর হলো উচ্চ আদালতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড কাছ থেকে দেখার ও বোঝার সুযোগ হয়েছে৷ বিশেষ করে আইনজীবীদের রাজনীতি, আইনজীবী সমিতির নির্বাচন এসব পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে পেশাগত কারণেই৷ এবছর সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে যা হলো বা যা দেখতে ও শুনতে হলো তা আগের কোন অভিজ্ঞতার সঙ্গেই খাপ খায় না৷ অবশ্য এবারের এই পরিস্থিতি যে হুট করেই হয়েছে তা কিন্তু নয়৷ গেলো কয়েক বছরের ‘প্র্যাকটিস ম্যাচ' শেষে এবার ফাইনাল খেলা দেখলো দর্শক৷

এবার কেমন নির্বাচন হয়েছে?

ঠিক এই প্রশ্নটিই ১৯শে মার্চ করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ফকির এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুন নূর দুলালকে৷ সেদিন তারা এসেছিলেন নির্বাচন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে৷  তাদের জবাবটা কেমন তা বোধ হয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ তারপরও বলি, তাঁরা বলেছেন- বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের হট্টগোল থামাতে পুলিশের অ্যাকশন, বিরোধীদের নির্বাচন বাতিলের পায়তারা, ব্যালট পেপার ছিনতাই-চুরি ও ছিঁড়ে ফেলার ঘটনা ছাড়া ভোট সুষ্ঠু হয়েছে৷ তারা জানান প্রায় সাড়ে চার হাজারেরর মত ভোটার ভোট দিয়েছেন৷ ভোটারদের মধ্যে বিএনপির অনেকেই আছেন৷ ফলে ভোট বা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ নেই৷ ‘একতরফা' নির্বাচন হয়েছে এমনটাও মানতে নারাজ তারা৷

একই প্রশ্ন ছিলো বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের প্যানেলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন এবং রুহুল কুদ্দুস কাজলের কাছেও৷ তারাও পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে এই প্রশ্নসহ অনেক কিছুই খোলাসা করার চেষ্টা করেছেন একইদিনে৷ তারা বলেছেন- নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত উপ-কমিটির আহ্বায়ক পদত্যাগের পর নতুন করে যেহেতু উপকমিটি হয়নি তাই নির্বাচনও হয়নি৷ যা হয়েছে সেটা তামাশা৷  তাদের দাবি পুলিশকে ব্যবহার করে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে নিয়েছে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা৷  নির্বাচন সংক্রান্ত নতুন উপ-কমিটি গঠন করে নতুন করে নির্বাচনের দাবি তুলেছেন তাঁরা৷

ভোটের দু'দিন কী দেখলাম, কী শুনলাম?

দু'দিনের কথা নয় আসলে তিনদিন যা দেখলাম আর যা শুনলাম লিখলে সত্য বলা হবে৷ ভোটের আগের রাতেই শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া৷  কেন এমনটা হলো? দুই দিনব্যাপী নির্বাচন ১৫ ও ১৬ মার্চ৷  তবে ভোটের এক দিন আগে ১৪ই মার্চ নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মনসুরুল হক চৌধুরী ‘ব্যক্তিগত' কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন৷ এমন প্রেক্ষাপটে ভোট হবে কি না, কে আহ্বায়ক হবেন, নাকি উপকমিটির অপর সদস্যরা নির্বাচন পরিচালনা করবেন—এ নিয়ে ভোটের আগেরদিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা দিনভর আলোচনা করেন৷ কিন্তু সেই আলোচনায় কোন সমঝোতা হয়নি৷

ফলে আহ্বায়ক কমিটির প্রধান নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তাপ ছড়ায়৷ আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়ক হিসেবে মো. মনিরুজ্জামানকে মনোনীত করেন৷ অন্যদিকে বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা এ এস এম মোকতার কবির খানকে আহ্বায়ক মনোনীত করেন৷

আওয়ামী লীগ মনোনীত আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান নির্বাচনী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে রাতেই ব্যালট পেপারে সই করতে সমিতির তিনতলার সম্মেলন কক্ষে যান৷ এতে আপত্তি জানান বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা৷ তারা কিছু ব্যালট পেপার ছিনিয়েও নেন৷ এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল, হইচই ও হট্টগোল শুরু হয়৷ একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া এবং হাতাহাতির ঘটনা ঘটে৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়৷

এই নির্বাচনে ১৪টি পদের বিপরীতে  প্রার্থী হয়েছিলেন ২৯জন ৷ আর নির্বাচনে ভোটারসংখ্যা ছিলো আট হাজার ৬০২৷  নির্বাচনের আগের রাতের উত্তাপ ভোটেরদিন সকালেই ছড়িয়ে পড়ে৷ সকাল থেকেই বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ভোটের বিরোধীতা শুরু করেন৷ আওয়ামীপন্থিরা ভোটের পক্ষে অবস্থান নেন৷ এমন যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে ভোট শুরু হতেও কয়েকঘন্টা লেগে যায়৷

আগেই বলেছি আগের রাতেই পুলিশ আসে আদালত চত্ত্বরে৷ ভোটের দিনের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে এটা আঁচ করতে পেরেই পুলিশের সংখ্যাও বাড়ানো হয়৷ পুলিশও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আদালত চত্ত্বরেই কেবল নয় একেবারে ভোটের বুথ পর্যন্ত চলে যায়৷ ভোট বন্ধে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা মরিয়া হয়ে উঠলে পুলিশও শক্তি প্রদর্শন শুরু করে৷

আইনজীবী আর পুলিশের মারপিট হচ্ছে তাও আবার দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের ভোটে ফলে সংবাদ হিসেবে তো গুরুত্বপূর্ণই৷ তাই ক্যামেরা সচল হতেই পুলিশ মারতে শুরু করে সাংবাদিকদেরও৷ নারী পুরুষ নির্বিশেষে পুলিশের হাতে ১০জনের মতো সাংবাদিক আহত হন৷ হাসপাতালেও যান কয়েকজন৷

‘সাংবাদিকেরা মার খাবেই’ এমনটাই এখন বাস্তবতা৷  ফলে এনিয়ে খুব বেশি রা করেনি খোদ গণমাধ্যম নিজেই৷ কিছু বিবৃতি, মানববন্ধন ইত্যাদি হয়েছে করতে হয় তাই৷  পুলিশও আইন সাংবাদিকদের সংগঠন ল' রিপোর্টার্স ফোরামের কার্যালয়ে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে দায় সেরেছে৷

আইনজীবী সমিতি আদালতের অংশ নয় এবং এই সমিতি স্বাধীন৷ ফলে এই নির্বাচনে যতই মারধর হোক তা নিয়ে আদালত বা প্রধান বিচারপতির করার কিচ্ছু নেই৷ একথা জানার পরও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির কাছে গিয়েছিলো৷ তিনিও তাই জানিয়েছেন তার কিচ্ছু করার নেই৷

এবার বছর দশেক আগের একটা ঘটনাবলি৷ বিএনপি তখন আন্দোলনে তুঙ্গে৷ আইনজীবীরাও তা থেকে দূরে নয়৷ পুলিশের মামলার আসামী এক আইনজীবী গ্রেফতার এড়াতে আইনজীবী সমিতির সভাপতির কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন৷ দিন সাতেক আটকে রেখেছিলেন নিজেকে৷ এনিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও হয়েছে৷ পুলিশ আদালতের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলো, কিন্তু সেই আইনজীবীকে আটক বা গ্রেফতার করতে সমিতির সভাপতির কক্ষে প্রবেশ করেনি৷

এই ঘটনা মনে পড়লো একারণে যে-এবার পুলিশি সেই আইনজীবীদেরই পিটিয়েছে মনখুলে৷ আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকই কেবল নয় জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সামনেই পিটিয়েছে৷ এতে কী প্রমাণ হয় তা অনুমান করতে পারছেন আশা করি৷

এই আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের এই ‘বিশৃঙ্খল দশা'র ইতিহাস খুব পুরনো নয়৷ বছর পাঁচেক ধরে এইদশার শুরু৷ ২০০৮ সাল থেকেই দেখে এসেছি সভাপতি সাধারণ সম্পাদকসহ বেশিরভাগ পদেই বিএনপির জয় প্রায় নিশ্চিত ছিলো বার নির্বাচনে৷ আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে দল ক্ষমতায় থাকার পরও বহুবার বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা রাজ করেছেন বারে৷ সেই ধারা থেকে বের হওয়ার চেষ্টার অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগ মরিয়া হয়েছে৷ আর বিএনপি যেহেতু ‘দুর্বল’ তাই নির্বাচনও তেমনই হচ্ছে৷ ফলও উল্টাতে শুরু করেছে৷ আগের কোন নির্বাচনেই এভাবে ১৪টি পদেই আওয়ামী লীগ জিতেছে এমন হয়নি৷ এবার হলো৷ কারণ এবারের নির্বাচনকে ‘একতরফা' তকমাও দিয়েছেন অনেকেই৷

পাড়ার ছোকড়াদের ক্লাব আর আইনজীবী সমিতির মধ্যে তফাৎ খুঁজতে গেল বহু পাওয়া যাবে কিন্তু দুটোর মধ্যে একটি মিল খুব প্রকট৷ সেটি হচ্ছে স্বাধীনতার প্রশ্নে৷ পাড়ার ক্লাবও স্বাধীন আইনজীবী সমিতিও স্বাধীন৷ ফলে এই স্বাধীন একটি সংগঠনে কে জিতলো কে হারলো তা নিয়ে এতো আলোচনা কেন? এত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিই বা কেন? স্বার্থটা আসলে কার?

এই আইনজীবী সমিতির মতো দেশে হাজার হাজার স্বাধীন সংগঠন আছে৷ যারা নিজেদের গঠনতন্ত্রে পরিচালিত হয়৷ হ্যাঁ এসবে বিভিন্ন মতের মানুষ আছে৷ একইদলের সমিতি বা ক্লাব নেই৷ যদি এমন কিছু থাকে তাকে বরং ক্লাব বা সমিতি না বলে রাজনৈতিক দল বলাই ভালো৷ যেহেতু এসব সংগঠন বহুমতের মানুষের অংশগ্রহণে তৈরি হয় তাহলে সবার মত বা সবার অংশগ্রহণও তো নিশ্চিত করতে হবে? এটা কারা করবে? যারা সংগঠন বা ক্লাব বানিয়েছেন তারাই৷ আইনজীবীদের সংগঠন হলে আইনজীবীরা আর পাড়ার ছোকড়াদের হলে ছোকড়ারা৷ এই সহজ কথা তারা জানেন না একথা কোন বুদ্ধুই মানবে না৷

আইনজীবীরা পরস্পরকে ‘লার্নেড ফ্রেন্ড’ বলে সম্বোধন করেন৷  কিন্তু এবারের নির্বাচনে সেই ‘লার্নেড'রাই মারামারি করলেন ঘাটের কুলিদের মত৷ নিজেরা তো করলেনই পুলিশও ডেকে আনলেন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে৷

বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা কেন নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলো না?

এই প্রশ্নের জবাব বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা দেননি৷ সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নটি না শোনার ভান করেছেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী৷ তারা না বললেও বোঝা যায় সবই৷

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে সিটি কর্পোরেশন বা ইউনিয়ন পরিষদ এপর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই বিএনপির প্রার্থীরা ভোট শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছেন৷ অভিযোগ- নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না, কারচুপি হচ্ছে, কেন্দ্র-ব্যালট দখল করা হচ্ছে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই ইত্যাদি৷ নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের ফলে দেশ-বিদেশে যে বার্তা যায় তা হলো- সরকার নিরপেক্ষ বা মুক্ত নির্বাচনের প্রধান বাধা৷ এই তরিকায় বিএনপির খুব যে লাভ হয়েছে তা মনে হয় না৷ হয়তো লাভ হয়েছে আমার জ্ঞানের রাডারে তা ধরা পড়ছে না৷

তাহলে আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে কেন তারা ‘প্রত্যাখ্যান' ‘বর্জন' ঘোষণা করলেন না?  বেশ ক'জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপও হয়েছে এনিয়ে৷ তাদের মতে- বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বা খোদ দলটিই প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা না দিয়ে এটাই হয়তো প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে- সরকার নির্বাচনই হতে দিচ্ছে না৷ তারা হয়তো ভেবেছিলো নানা অজুহাতে ভোট বন্ধ রাখতে পারলে সারা দুনিয়ার কাছে এই বার্তাই যাবে যে, দেশে ভোটেরই পরিবেশ নেই৷ তারা এই কাজে নিজেদের সফলও ভাবতে পারে৷

সুপ্রিম কোর্টের সামনে বিচারের দেবি থেমিসের ভাষ্কর্য স্থাপন করার পর তা হেফাজতসহ কিছু ইসলামিক দলের আব্দারের মুখে রাতের আঁধারে সড়িয়ে ফেলা হয়েছিল৷  ভাষ্কর্যটি এখন আছে উচ্চ আদালতের অ্যানেক্স ভবনের সামনে৷ যখন এই ভাষ্কর্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি করা হয়েছিল তখন বিএনপি বা আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের কোন আওয়াজ শুনতে পাইনি৷  স্বাধীন আদালতের চত্ত্বরে একটি ভাষ্কর্যও স্বাধীনভাবে টিকলো না, তা টিকিয়ে রাখতে আইনজীবীরা মুখ খোলেননি কেন? এই প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গেও এবারের নির্বাচন এবং নির্বাচন নিয়ে যা হলো তার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে৷

তখন সরকার চায়নি ভাষ্কর্যটি সুপ্রিম কোর্টের সামনে থাকুক, কারণ সরকারের পালিতপুত্র হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম৷ ফলে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা এনিয়ে কথা বলেননি৷ আর বিএনপি তো অন্য ইসলামী দলগুলোর মিত্র ফলে তারাও চুপ ছিলেন৷ আইনজীবীদের মধ্যে বামপন্থি যে ক'জন আছেন তারা জানেন তাদের কথার গুরুত্ব নেই, তাই খামাখা আওয়াজ তুলতে যাননি তারাও৷

আইনজীবীদের পেশার প্রতীক ওই ‘থেমিস' হতে পারতো কিন্তু হলো না৷ তাদের একতা কিভাবে হবে? তারা তো যতটা না আইনজীবী তারচে বেশি দলীয় কর্মী৷ আর একারণেই তারা প্রধান বিচারপতির এজলাসে হট্টগোল করতে পারেন৷  আদালতের দরজা ভাঙতে পারেন৷ আইনজীবীদের চেম্বারের দরজা তো বহুবারই ভেঙেছেন৷  এই আইনজীবীদের পকেটে হাতুড়িও দেখেছি বছর কয়েক আগে৷ পাড়ার মাস্তানদের মত কবে আবার অস্ত্র বের করে বসে কে জানে৷

আরও যত জয়

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মতই ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যকরী কমিটির নির্বাচনেও সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক পদসহ সব কটি পদে জিতেছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা৷ যদিও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী প্রার্থীরা এ ভোট বর্জন করেছিলেন৷ নির্বাচনের প্রথম দিনে ভোট কারচুপির কারণে বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেলের আইনজীবীরা ভোট বর্জন করেছেন৷ ভোট কারচুপি করে নির্বাচনকে কলঙ্কিত করা হয়েছে বলে দাবি করেছে তারা৷

এবার দেখা যাক ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের কী অবস্থা৷ এখানেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সবাই পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন৷  গত ৫ মে পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু পরিচালক পদে ৭৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় আর নির্বাচনের প্রয়োজন হয়নি৷

সরকারের উচ্চপর্যায়ের সবুজ সংকেতে কোনো ভোট ছাড়াই সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন জসিম উদ্দিন৷ বিগত কয়েকটি নির্বাচনেও সভাপতি পদে সরকার-সমর্থিত প্রার্থীর বিপরীতে অন্য কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি৷ এমনকি সহসভাপতির পদগুলোও ঠিক হয়েছে সরকারের সমর্থনে৷ একইভাবে এবারও জসিম উদ্দিনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি হলেন৷

‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড' খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ২০২৩ সালের কার্যকর পরিষদ নির্বাচনে ১৫টি পদের মধ্যে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ১৪টিতে জিতেছেন আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের প্রার্থীরা৷ আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গত এক যুগে সমিতিতে নীল দলের অবস্থান ক্রমাগত নিরঙ্কুশ হয়েছে৷ সর্বশেষ নির্বাচনেও ১৫ পদের ১৪টিতে জিতেছিল আওয়ামীপন্থী নীল দল৷ বরাবরের মতো এবারও সমিতির নির্বাচনে নীল ও সাদা দলের বাইরে অন্য কোনো প্যানেল ছিল না৷

নূর সিদ্দিকী, সাংবাদিক ও সাহিত্যিকছবি: Privat

প্রায় সকল পেশাজীবী সমিতি বা ক্লাবের নির্বাচনেরই একইদশা৷  শান্তিপূর্ণ অথচ জমজমাট নির্বাচন বলতে আগে ক্লাব সমিতির নির্বাচনই ছিলো৷ জাতীয় নির্বাচনের ইতিহাস পুরোপুরি তেমন না হলেও আংশিক শান্তিপূর্ণ বা কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া জমজমাটই হতো৷  যেকোন নির্বাচনই একসময় উৎসব ছিলো এই দেশে৷ নির্বাচন থেকে উৎসবটা হারিয়ে গেলো৷ আহা!

এই জয়ে কার লাভ কার ক্ষতি?

আগেই বলেছি পাড়ার ক্লাব আর আইনজীবী সমিতি বা এফবিসিসিআই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির মধ্যে বড় মিল এগুলো স্বাধীন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন৷ যদি তাই হয় তাহলে এসবে নির্বাচনে কে জিতলো কে হারলো তাতে সরকারের কী এসে যায়? এই তরিকার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যদি সারাদেশের সব সমিতির নির্বাচনেও আওয়ামীপন্থিরা জয় লাভ করে তাতেও দেশের বিন্দুমাত্র লাভের আশা নেই৷ আবার সবগুলোতে বিএনপি জিতলেও দেশ বা জনগণের কোন লোকসানের আশঙ্কা নেই৷

তাহলে লাভটা হলো কার? আমার বিবেচনায় আইনজীবী সমিতির মতো পেশাজীবীদের যেকোন স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনগুলোতে সরকারি দল সমর্থকদের জয় অনেকটা লোক দেখানো ব্যাপার৷ আমার দল ক্ষমতায়, আমিও আমার সংগঠনের পদ দখল করে ক্ষমতায় থাকবো৷ এই মানসিকতাই সকল সংগঠনের মধ্যে বিরাজ করছে৷ সরকারও এতে আমোদ লাভ করে৷ নিজেরা নিজেদের সাবাশী দেয়৷ এবার বোঝা গেলো ক্লাবে-সমিতিতে সরকার কেন হানা দেয়? কি লাভ তাতে!

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতির একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে৷  ছবিতে দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শুয়ে আছেন আর দুজন কর্মী তাঁর পা টিপছেন৷  এই ছবিটিই আসলে বলে দিচ্ছে আমরা কেমন৷ আমাদের চরিত্র কেমন, আমাদের চাহিদা কেমন৷ পেশাজীবী সংগঠনগুলো এভাবেই একজোড়া অদৃশ্য পা টিপে যাচ্ছে৷ হোক তা আইনজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিক্ষক, প্রকৌশলী কিংবা যেকোন পেশাজীবীদের সংগঠনই৷ আর সেই পা টেপার কাজটা কে কত নিখুঁতভাবে করতে পারে তারই প্রতিযোগিতা চলছে যেন৷ 

সকল কিছুর মূলে রাজনীতি আর রাজনৈতিক ফায়দা!

সকল পেশার মানুষই তাদের মর্যাদার কথা ভুলে যাচ্ছে৷ তাদের দায়িত্ব বা অধিকারের কথাও ভুলে যাচ্ছে৷  যে মর্যাদা তারা দীর্ঘদিনের চর্চায়, অভিজ্ঞতায় অথবা নিজেদের কাজের মাধ্যমে অর্জন করেছিলেন৷ সেই মর্যাদার কথা ভুলে যাচ্ছেন৷ ভুলে যতটা যাচ্ছে তারচে বেশি ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ মর্যাদা বিক্রির হাট বসলেও আর অবাক হবে না বাঙালি৷  যদিও সেই হাটে মর্যাদার বিনিময়ে কী মিলবে তা নিয়েও শঙ্কা আছে৷ হয়তো অদৃশ্য একজোড়া পা-ই ধরিয়ে দেয়া হবে মর্যাদার বিনিময়ে৷

মধ্যযুগের কবি জ্ঞানদাস লিখেছিলেন-

সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল
অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

বাংলাদেশ