যে কোনো মূল্যে ৩১শে অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি পালন করতে কার্যত ব্যর্থ হলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ মঙ্গলবার সংসদ ব্রেক্সিট চুক্তি কার্যকর করতে তাঁর আনা প্রথম প্রস্তাব অনুমোদন করায় প্রথমে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিলেন তিনি৷ কিন্তু সেই আনন্দ বেশিক্ষণ টেকে নি৷ কারণ এর কয়েক মিনিট পর দ্বিতীয় এক প্রস্তাবের মাধ্যমে সংসদ গোটা প্রক্রিয়ার জন্য আরও সময় আদায় করতে চেয়েছিল৷ বিরোধীদের যুক্তি ছিল, মাত্র তিন দিনের মধ্যে এমন জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়৷ সেই প্রস্তাব অনুমোদনের পর ক্ষুব্ধ জনসন ব্রেক্সিট চুক্তি সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া থামিয়ে দিয়েছেন৷ প্রধানমন্ত্রীর দফতর জানিয়েছে, ইইউ ব্রেক্সিটের সময়সীমা বাড়ানোর অনুরোধ মেনে নিলে একমাত্র আগাম নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে এই অচলাবস্থা কাটানো সম্ভব৷ অবশ্য সেই পদক্ষেপের জন্যও সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে৷
লন্ডনের এই ঘটনাপ্রবাহ পর্বেক্ষণ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নও ব্রিটেনের অনুরোধ মেনে ব্রেক্সিটের সময়সীমা তৃতীয়বারের মতো পিছিয়ে দেবার তোড়জোড় করছে৷ ইইউ দেশগুলির সরকারের পরিষদের প্রধান ডোনাল্ড টুস্ক শীর্ষ নেতাদের সেই পরামর্শ দেবেন বলে জানিয়েছেন৷ তাঁর মতে, আপাতত চুক্তিহীন ব্রেক্সিট এড়ানোর এটাই একমাত্র পথ৷ তবে জরুরি শীর্ষ সম্মেলন ডাকার বদলে লিখিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে চান তিনি৷ নীতিগতভাবে ব্রেক্সিট পিছিয়ে দিতে রাজি হলেও তার সময়সীমা নিয়ে ইইউ নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে৷ বিশেষ করে ফ্রান্স ব্রেক্সিটের মেয়াদ বড়জোর কয়েক দিনের জন্য বাড়াতে প্রস্তুত৷ তার মধ্যেই ব্রিটিশ সংসদে আইনি প্রক্রিয়া শেষ হবে বলে সে দেশ আশা করছে৷
ইইউ-র সিদ্ধান্তের উপর ব্রেক্সিট প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে৷ ব্রাসেলস দীর্ঘ বিলম্ব মেনে নিলে ব্রিটেনে আগাম নির্বাচন অথবা দ্বিতীয় গণভোট আয়োজন করা সম্ভব হতে পারে৷ কিন্তু সেই মেয়াদ কম হলে ব্রিটেনের সংসদের উপর আইনি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করার জন্য চাপ বাড়বে৷ ঠিক সময়ে সেই কাজ শেষ না করলে চুক্তিহীন ব্রেক্সিট অনিবার্য হয়ে পড়বে৷
বরিস জনসন জানিয়েছেন, তিনি ইইউ নেতাদের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করবেন৷ তিনি এখনো ৩১শে অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর করার পক্ষে অবিচল রয়েছেন৷ ইইউ নেতাদেরও সেই কথা জানিয়ে তিনি আবার সংসদে ফিরে যেতে চান৷ জনসনের যুক্তি, আইন করে চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের সম্ভাবনা দূর করার পর সংসদকে এই চুক্তির ভিত্তিতেই ব্রেক্সিট মেনে নিতে হবে৷ অতএব সেই কাজে দেরি না করাই উচিত৷ সংসদে বিরোধীরা অবশ্য এই দুর্দশার জন্য জনসনকেই দায়ী করছে৷ লেবার পার্টির নেতা জেরেমি কর্বিন বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাঁর দূর্ভাগ্যের রচয়িতা৷''
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/এসিবি (রয়টার্স, ডিপিএ)