জার্মান সেনা বাহিনীতে বৈষম্যের শিকার সমকামী সেনাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল ম্যার্কেল প্রশাসন।
বিজ্ঞাপন
যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিল আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মন্ত্রিসভা। জার্মান সেনা বাহিনীর যে সমস্ত সমকামী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ হয়েছে, তাঁদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। মন্ত্রিসভার ধারণা, অন্তত এক হাজার মানুষ এই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী। তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার ইউরো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
১৯৬০ সালে জার্মানিতে সমকামীদের জন্য বিশেষ আইন তৈরি হয়। তার আগে পর্যন্ত সমকামিতা নিষিদ্ধ ছিল সেখানে। কিন্তু ১৯৬০ সালের পর থেকে গে এবং লেসবিয়ানদের উপর থেকে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। জার্মান সেনা বাহিনীতেও সমকামী অংশগ্রহণে কোনো বাধা ছিল না। বস্তুত, ২০০০ সালে জার্মান সেনায় সমকামী অংশগ্রহণ নিয়ে বিশেষ আইনও তৈরি করা হয়। কিন্তু বাস্তব সব সময় আইনের উপর নির্ভর করে না।
জার্মানির রাজনীতিতে সমকামিতা
জার্মানিতে সমকামীদের অধিকারের লড়াই দীর্ঘদিনের৷ এখন তাদের অনেক অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে৷ তবে এখনো তাদের নানা ধরনের বৈষম্য ও বিদ্বেষের শিকার হতে হয়৷ কিন্তু সমকামিতা জার্মান রাজনীতিকে ধীরে ধীরে পালটে দিচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. von Erichsen
বৈধতা, বিয়ের অধিকার
প্রুশিয়ান সাম্রাজ্য এবং পরে নাৎসি জার্মানিতে সমকামীরা ব্যাপক নির্যাতনের স্বীকার হতেন৷ সমকামিতার অভিযোগে ছিল কারাদণ্ডের বিধান৷ এমনকি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং আধুনিক জার্মানি স্থাপিত হওয়ার পরও সমকামীদের অধিকার নিশ্চিত হয়নি৷ তবে কয়েক দশকে সে অবস্থানের দ্রুতই পরিবর্তন হয়েছে৷ ১৯৬৯ সালে সমকামীদের শাস্তি দেয়ার বিধান বাতিল হলেও ২০১৭ সালে এসে তারা বিয়ের অধিকার পান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. von Erichsen
পার্লামেন্টে জয়
জার্মান পার্লামেন্টে ভোটের মাধ্যমে সমকামীদের বিয়ের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ান রাজনীতিবিদরা৷ কিন্তু তখনো অনেক পার্লামেন্ট সদস্য এর বিরুদ্ধে ছিলেন৷ ক্ষমতায় থাকা দল সিডিইউ-র ৩০৯ সদস্যের মধ্যে ২২৫ জনই এর বিরুদ্ধে ভোট দেন৷ খোদ চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ছিলেন বিরোধিতাকারীদের একজন৷ তবে পরবর্তী ভোটে রাজনীতিবিদরা যাতে দলের মতাদর্শ মেনে ভোট না দিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে ভোট দেন, সে আহ্বান জানিয়েছিলেন ম্যার্কেল৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/O. Messinger
প্রকাশ্যে সমকামী রাজনীতিবিদ
সমকামীদের অধিকারের আন্দোলন যত জনপ্রিয় হতে থাকে, জার্মান রাজনীতিতেও পড়ে এর প্রভাব৷ অনেক রাজনীতিবিদ নিজেদের সমকামিতার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে থাকেন৷ ২০০১ সালের সিটি নির্বাচনে বার্লিনের এসপিডির মেয়র প্রার্থী ক্লাউস ভোভেরাইট দলের সম্মেলনে তার বক্তব্য শেষ করেন এই বলে, ‘‘আমি সমকামী এবং এটা খারাপ কিছু নয়৷’’ পরবর্তীতে ভোভেরাইট মেয়র নির্বাচিত হন এবং টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেন৷
ছবি: Imago/W. Wagner
রক্ষণশীল দলে সমকামী নেতা
সমকামিতা সাধারণ মানুষের চোখে ধীরে ধীরে সহনীয় করে তোলায় বড় ভূমিকা রেখেছেন রাজনীতিবিদরা৷ চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডো ভেস্টারভেলে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক সফরে তার পার্টনার মিখায়েল ম্রোনৎসকে নিয়ে যেতেন৷ এখন এমনকি সমকামিতার বিরুদ্ধে কথা বলে এমন কট্টর ডানপন্থি দল এএফডির এক নেত্রী অ্যালিস ভাইডেলও এক নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন৷
ছবি: Reuters/M. Rehle
সরকারে সমকামী মন্ত্রী
জার্মানির বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েনস স্পান নিজেকে সমকামী ঘোষণা দেয়া প্রথম মন্ত্রী ৷ দলের অন্যতম উদীয়মান রাজনীতিবিদ বলে বিবেচনা করা হয় স্পানকে৷ করোনা মহামারিতে নিজের দেশকে দারুণভাবে সামাল দেয়ায় দল ও দেশ ছাড়াও আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি৷ ম্যার্কেলের পর সিডিইউয়ের প্রধান হওয়ার লড়াইয়েও অনেক এগিয়ে আছেন স্পান৷ জিতে গেলে তিনি হতে পারেন প্রথম সমকামী জার্মান চ্যান্সেলর৷
ছবি: Sean Gallup/Getty Images
এখনো রয়েছে বৈষম্য
রাজনীতিবিদ তো বটেই, জার্মান জনগণের মধ্যেও ধীরে ধীরে সমকামীভীতি দূর হচ্ছে৷ কিন্তু এখনো অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যের স্বীকার হন তারা৷ সম্প্রতি জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চ এবং বিলেফেল্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিজেদের এলজিবিটিকিউ ঘোষণা দেয়া ৩০ শতাংশ কর্মীই কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন৷ জরিপে অংশ নেয়া এক তৃতীয়াংশই জানিয়েছেন, তারা সহকর্মীদের এ বিষয়ে জানাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA/O. Messinger
6 ছবি1 | 6
সম্প্রতি একটি রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ১৯৫৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জার্মান সেনা বাহিনীতে সমকামীদের চূড়ান্ত হেনস্থা করা হয়েছে। তাঁদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। তাঁদের প্রোমোশন দেওয়া হয়নি, কাজ থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে। ওই রিপোর্টের ভিত্তিতেই জার্মান সরকার সিদ্ধান্ত নিল, বৈষম্যের শিকার ওই ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
২০০০ সালে জার্মান সেনায় সমকামী আইন হওয়ার আগে সেনা আইনে বহু সমকামীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল সেনা আদালত। মন্ত্রিসভা ঘোষণা করেছে, ওই সমস্ত ব্যক্তিকে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার ইউরো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এর বাইরেও যাঁরা বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন, তাঁদেরকেও নাম নথিভুক্ত করতে বলা হয়েছে। শুধু পশ্চিম নয়, কমিউনিস্ট শাসিত পূর্ব জার্মানির সেনাদেরও ওই তালিকায় নাম নথিভুক্ত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
ম্যার্কেল সরকারের এই ঘোষণায় স্বাভাবিক ভাবেই খুশি দেশের অধিকার রক্ষা মঞ্চগুলি। তবে তাদের বক্তব্য, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ আরো বাড়ানো উচিত। দিনের পর দিন ধরে যাঁরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, কাজ হারিয়েছেন, প্রমোশন পাননি, তাঁদের এত কম ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য নয়। তবে জার্মান সরকারের এই ঘোষণার পরে আনন্দ প্রকাশ করেছেন বৈষম্য়ের শিকার হওয়া তৎকালীন সেনা বাহিনীর সদস্যরা। তাঁরা বলেছেন, এত দিনে ঠিক ঠিক বিচার পেলেন তাঁরা।