অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ বলে, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা বদল হলেই সংগঠনগুলোও রাতারাতি ক্ষমতা বদল হয়৷ বাম আমলে সরকারি কর্মীদের সংগঠন কো-অর্ডিনেশন কমিটি ছিল চরম শক্তিশালী৷ সরকারি কর্মীদের বিষয়ে তারাই ছিল শেষকথা৷
২০১১ সালে ক্ষমতাবদল হলো৷ কো-অর্ডিনেশন কমিটির প্রতাপও গেল৷ রাতারাতি ক্ষমতাবান হয়ে গেল তৃণমূলের রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশন৷ তাদের মধ্যে ভয়ংকর কোন্দল আছে৷ মারামারি আছে৷ আলাদা মঞ্চ আছে৷ তা সত্ত্বেও তারাই প্রধান রাজ্য সরকারি কর্মচারী সংগঠন৷
একই ঘটনা ঘটেছে অধ্যাপক ও শিক্ষকদের সংগঠনের ক্ষেত্রে৷ বাম আমলে সিপিএমের শিক্ষক সংগঠন ছিল এবিটিএ৷ তারাই ছিল দোর্দন্ডপ্রতাপ৷ ক্ষমতার বদল হলো৷ এবার তৃণমূলের শিক্ষক সমিতি পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক ও শিক্ষা বিষয়ক কর্মচারী সমিতি সেই জায়গায় চলে গেল৷ বাম আমলে সিপিএম প্রভাবিত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সংগঠন ছিল ওয়েবকুটা৷ তারাই ছড়ি ঘোরাত৷ তৃণমূল আমলে সেই কাজটা করে ওয়েবকুপা৷ সম্প্রতি এই ওয়েবকুপার রাজ্য সভাপতি দাবি করেছেন, বিজেপি-র বর্তমান সভাপতি ও অধ্যাপক সুকান্ত মজুমদার সাত বছর ধরে তাদের সংগঠনের সদস্য৷ বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি হওয়ার পরেও তিনি ইস্তফা দেননি৷ আসলে ক্ষমতা যেখানে, কর্মীরাও সেখানে৷
শুধু শিক্ষক, অধ্যাপকদের সংগঠনই, বাম আমলে অধিকাংশ অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন বামপন্থি৷ ২০০৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগের কথা৷ তখন আমি টিভিতে ছিলাম৷ ভোটের জন্য কলকাতা গিয়ে অ্যাঙ্কারিং করতে হয়েছিল৷ যতজন অভিনেতা ও অভিনেত্রী সেসময় বিভিন্ন আলোচনায় গেস্ট হিসাবে এসেছিলেন, একজনকে বাদ দিয়ে তারা সকলেই দাবি করেছিলেন, তারা বামপন্থি এবং পারিবারিকভাবে বামপন্থায় বিশ্বাসী৷ পাঁচ বছর পরে রাজ্যপাট বদলের সম্ভাবনা যথন প্রব, তখন সবাইকে বলতে শুনেছি, তারা তো তৃণমূলকেই বরাবর সমর্থন করেন৷ ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, তৃণমূলের ফেডারেশন টলিউড শাসন করছে৷ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও তাঁর ভাই স্বরূপ বিশ্বাসের কথাই সেখানে শেষ কথা, এমন অভিযোগ অনেকবার উঠেছে৷ বিধানসভা নির্বাচনের আগে টলিউডে বিজেপি পাল্টা একটা সংগঠন করে প্রাধান্য পাওয়ার চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু সফল হয়নি৷ অল্প কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীই সেখানে গেছেন৷
ভারতে প্রতিটি প্রভাবশালী দলে যে কত শাখা সংগঠন আছে ভাবতে পারবেন না৷ এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে বিজেপি৷ তাদের তো সিএ, সাবেক সেনা কর্মী, ব্যবসায়ী, তথ্যপ্রযুক্তি, গরু ও উন্নয়ন, সংস্কৃতি, প্রতিরক্ষা, চিকিৎসক, আর্থিক, নির্বাচনী, মৎসজীবী, বিনিয়োগকারীপঞ্চায়েত, খেলাধুলা, শিল্প-বাণিজ্য, ব্যবসায়ী, পুরসভা, প্রবীণ নাগরিক, ম্যানেজমেন্ট, মানবাধিকার-সহ অসংখ্য সেল আছে বিজেপি-র৷
তৃণমূলেরও প্রচুর সেল বা সংগঠন আছে৷ তারাই এখন নিজের নিজের ক্ষেত্রে ছড়ি ঘোরাচ্ছে৷ তার জন্য কোনো সংগঠনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার দরকার হয় নমা৷ বিরোধীদের সঙ্গে শক্তির মহড়া নিতে হয় না৷ তাদের নেতাদের হাতে বিপুল ক্ষমতা থাকে৷ আইনজীবীদের সংগঠন, প্রেস ক্লাবের মতো কয়েকটি সংগঠন ব্যতিক্রম৷ সেখানেও দলবদল আছে৷ মাঝেমধ্যেই শোনা যায়, কোনো জেলায় প্রচুর আইনজীবী বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলের সংগঠনে যোগ দিয়েছেন৷
কিছুদিন আগে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে বিধানসভা উপনির্বাচনে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বায়রন বিশ্বাস জিতেছেন৷ তারপর মুর্শিদাবাদ বার কাউন্সিলের নির্বাচন হয়েছে৷ সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীদের হারিয়ে দিয়েছেন কংগ্রেস-বাম প্রার্থীরা৷ পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদে এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ, এই জেলা হলো কংগ্রেসের লোকসভার নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরীর খাসতালুক৷ মুসলিমপ্রধান এই জেলায় গত বিধানসভায় একটা আসনও পায়নি কংগ্রেস বা বামেরা৷ সব আসনে জিতেছিল তৃণমূল৷ এমন ক্ষেত্রে অবধারিতভাবে সব সংগঠনে তৃণমূল প্রার্থীরা হইহই করে জেতে৷ কারণ এটাই দস্তুর৷
কিন্তু মুর্শিদাবাদ যে এক্ষেত্রে উল্টো রাস্তায় চলেছে তার কারণ, অধীর চৌধুরীর জনপ্রিয়তা এবং দ্বিতীয় কারণ হলো, তৃণমূলের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক ওঠা একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগের প্রতিফলন৷ তাছাড়া গতবার সিংহভাগ মুসলিম ভোটার বিজেপি-কে ঠেকানোর জন্য তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিলেন৷ এবার তারা কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন৷
কারণ, যাই হোক না কেন, মুর্শিদাবাদ বার অ্যাসোসিয়েশন উল্টো রাস্তায় হেঁটেছে৷ তবে আইনজীবীদের অ্যাসোসিয়েশন অনেক সময় আলাদা রাস্তায় হাঁটে৷ কিন্তু অন্য সংগঠনগুলির ক্ষেত্রে এই কথা খাটে না৷ কারণ, সেখানে ক্ষমতাসীন দলের সংগঠনই ছড়ি ঘোরায়৷
যেহেতু পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা যার হাতে সেই শেষ কথা বলবে, তাই কোনো সংগঠনে কষ্ট করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার দরকার কী, পুরো সংগঠনটা দলের হয়ে গেলে তো লাভ বেশি৷ সেখানে নিজেদের নেতা-নেত্রীরা লড়বেন৷ সবকিছুই দলের হাতে থাকবে৷ নীতি তো একটাই, কোনো ক্ষমতা যেন বিরোধীদের কাছে না থাকে৷ তাই এই বিষয়ে অন্তত ভারতকে পথ দেখাতে পারে পশ্চিমবঙ্গ৷