শিশু যৌন নিপীড়নে পাদরিদের জড়িত থাকার নিন্দা জানিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের পরিবারগুলোর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস৷ ক্যাথলিকদের উদ্দেশে সোমবার লেখা এক চিঠিতে এ ধরনের ঘটনা দমন করতে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
‘‘ছোট্ট এ শিশুদের প্রতি আমরা কোনো যত্ন দেখাইনি৷ আমরা তাদের পরিত্যাগ করেছিলাম'', চিঠিতে এভাবেই আক্রান্ত শিশুদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন পোপ৷
বিশ্বের ১২০ কোটি ক্যাথলিকের উদ্দেশে পোপ ফ্রান্সিসের লেখা এটিই ছিল প্রথম চিঠি৷ চলতি সপ্তাহের শেষে আয়ারল্যান্ড সফর করার আগে ক্যাথলিকদের উদ্দেশে তিন পৃষ্ঠার চিঠিটি লেখেন তিনি৷
পোপ লিখেছেন, ‘‘অত্যন্ত লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় যে পাদরি হিসাবে আমাদের যে অবস্থানে থাকার কথা ছিল, আমরা সে অবস্থানে নেই৷ আমরা এ ঘটনার ভয়বহতা অনুধাবন করতে পারিনি এবং এ বিষয়ে সময়মতো কোনো পদক্ষেপও নিইনি৷''
শিশুদের যৌন নিপীড়ন কলঙ্ক
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চিলি ও আয়ারল্যান্ডে পাদরিদের বিরুদ্ধে শিশু যৌন নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে৷ পাদরিদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত হওয়া এ ধরনের অভিযোগ মূলত চার্চ প্রধানদের প্রতি মানুষের আস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে৷ গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের গ্র্যান্ড জুরির এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজ্যটির বিভিন্ন চার্চে পাদরিদের দ্বারা প্রায় এক হাজার শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে৷
শিশু যৌন নিপীড়নের মামলায় বিপাকে যাজক
00:34
গত ৭০ বছর ধরে সংঘটিত এ ধরনের ঘটনায় প্রায় তিনশ' পাদরিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে৷ তদন্ত প্রতিবেদনটির প্রকাশ ঠেকানোর জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন পাদরিরা৷ প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পোপ ফ্রান্সিস বলেন, প্রতিবেদন অনুয়ায়ী এ ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই অনেক আগে ঘটেছে৷ এতে প্রমাণিত হয় যে, দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়গুলোকে অবহেলা করা হচ্ছিল৷
গির্জার দায়িত্বে থাকা পাদরিরা নিপীড়নের শিকার এসব শিশুকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন পোপ ফ্রান্সিস৷
সহযোগিতার আহ্বান
ক্যাথলিকদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে পোপ ফ্রান্সিস এ ধরনের অপকর্ম ঠেকাতে সবার সহযোগিতা চান৷ শিশু নিপীড়নের ঘটনা ভবিষ্যতেআর ধামাচাপা পড়বে না বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি৷
তবে পাদরিদের মধ্যে যারা শিশু নির্যাতন বিষয়টি জানার পরও কোনো ব্যবস্থা নেননি, তাদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেয়া হবে সে বিষয়ে চিঠিতে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেননি পোপ৷
এদিকে নিপীড়নের শিকার শিশুদের পরিবারগুলো পোপের এ চিঠি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে৷ নিপীড়ক পাদরিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পোপের আরো জোরালো পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেছেন তাঁরা৷
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?