উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের নির্বাচনের মুখে তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন ফিরিয়ে নেওয়ার কথা জানালেন নরেন্দ্র মোদী।
বিজ্ঞাপন
কৃষকদের আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করতে হলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। এতদিন ধরে তিনি গোঁ ধরে বসেছিলেন যে, কৃষি আইন বাতিল করা হবে না। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দিল্লির সীমানায় কৃষকদের আন্দোলন অবশেষে জয় পেল। অবশেষে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করলেন মোদী।
শুক্রবার সকালে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানেই কৃষি আইন ফিরিয়ে নেওয়ার কথা জানান তিনি। ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সংসদে কৃষি আইন পাশ করে বিজেপির সরকার। মোট তিনটি বিষয়ে সেখানে পুরনো কৃষি আইনের আমূল পরিবর্তন করা হয়েছিল। এর আগে জুন মাসে সংসদে ওই আইনের অর্ডিন্যান্স নিয়ে এসেছিল সরকার। তখন থেকেই আইনটি নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানার বড় অংশের কৃষক জানিয়ে দেয়, এই আইন তারা কোনোভাবেই মানবেন না। তারপরেও বিতর্কিত বিলটিকে আইনে পরিণত করে কেন্দ্রীয় সরকার।
দাবি আদায়ে রাজপথে কৃষকরা
শেষমেষ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে নামতে হলো ভারতের বেশ কয়েক হাজার কৃষককে৷ ঋণ মওকুফ, পণ্যের ভালো দাম আর জমির অধিকার নিশ্চিতে তাদের রাপজথের আন্দোলন ইতোমধ্যে ফল দিতে শুরু করেছে৷
ছবি: Imago/Hindustan Times/R. Choudhary
লাল পতাকার সমুদ্র
মাথায় লাল টুপি পরে আর হাতে লাল পতাকা নিয়ে নাসিক থেকে সপ্তাহান্তে ১৮০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বইয়ে পৌঁছান কয়েক হাজার কৃষক৷ তাঁদের লক্ষ্য ছিল মুম্বইয়ে অবস্থিত মহারাষ্ট্রের সংসদ ঘিরে ফেলা৷ কৃষকদের অধিকাংশই দরিদ্র৷ মার্চের গরমের মধ্যে খালি পায়ে লম্বা পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকের পায়ে ফোস্কা পড়ে যায়, অসুস্থও হয়ে পড়েন কেউ কেউ৷
ছবি: REUTERS
সরকারের সহায়তা দাবি
কৃষকদের দাবি, কৃষিকাজে তাঁদের যে খরচ হয়, শষ্য বিক্রি করে যেন তার দেড়গুণ লাভ করা যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে৷ পাশাপাশি, কৃষি ঋণে জর্জরিতদের ঋণ মওকুফের দাবি জানান তাঁরা৷ আন্দোলনকারী কৃষকদের মধ্যে অনেক উপজাতি ছিলেন, যাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে জমিতে চাষ করছেন, অথচ সেই জমির মালিকানা এখনো পাননি৷
ছবি: AFP/Getty Images
সমাধানের চেষ্টা
মহারাষ্ট্র সরকার অবশ্য কৃষকরা মুম্বই পৌঁছানোর পর তাঁদের দাবি-দাওয়া মেনে নেয়ার ঘোষণা দেয়৷ গতবছর মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ জানিয়েছিলেন যে কৃষকদের ৩০৫ বিলিয়ন ভারতীয় টাকার যে ঋণ রয়েছে, তা মওকুফের চেষ্টা করা হচ্ছে৷ এবার কৃষকদের আন্দোলন বেগে পেলে সব দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দেয় রাজ্য সরকার৷
ছবি: P. Paranjpe/AFP/Getty Images
সংকটে কৃষিখাত
মহারাষ্ট্র হচ্ছে ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৃষি রাজ্য৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেখানে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় তীব্র খরা দেখা দেয়৷ ফলে চরম বিপাকে পড়েন কৃষকরা৷ রাজ্যটিতে শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই আত্মহত্যা করেছেন আড়াই হাজারের বেশি কৃষক৷ তবে কৃষকদের সমস্যা শুধু মহারাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ নেই৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
অসন্তোষ বাড়ছে
গত কয়েকমাস ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কৃষকরা নানা দাবিতে আন্দোলন করছেন৷ কৃষিখাতের প্রতি সরকারের আরো সহায়তা চান তাঁরা৷ এ সব আন্দোলনে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র কৃষক এবং কৃষিখাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত দিনমজুরদের অংশগ্রহণ বেশি দেখা গেছে৷
ছবি: AP
কম আয়
অনেক কৃষকই ঋণে জর্জরিত৷ একদিনে ঋণের কিস্তি শোধের চাপ, অন্যদিকে ফসলের ন্যায্য মজুরি না পাওয়ার কারণে তাঁদের অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে৷ মধ্যসত্ত্বভোগীরা অনেক সময় কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে কৃষকদের শষ্য বিক্রি করতে বাধ্য করে৷ মোটের উপর, প্রকৃতির বৈরি আচরণও ভোগাচ্ছে কৃষকদের৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
দ্রুত সমাধান?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কৃষকদের ঋণ মওকুফ করা হলে তা তাঁদের অসন্তোষ কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে৷ তবে শষ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বিক্রি পর্যন্ত নানা পর্যায়ে কৃষকদের ঠকানোর যে চর্চা রয়েছে, তা বন্ধে আরো উদ্যোগের প্রয়োজন৷ তাই কৃষকরা যাতে তাঁদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পান, তা নিশ্চিতে সরকারকে আরো সক্রিয় হতে হবে৷
ছবি: Imago/Hindustan Times/R. Choudhary
বড় চ্যালেঞ্জ
ভারতের কৃষকদের মধ্যে এই অসন্তোষ দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বিপাকে ফেলে দিয়েছে, যিনি কিনা ঘোষণা করেছিলেন পাঁচ বছরের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা হবে৷ ক্ষুব্ধ কৃষকদের শান্ত করতে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচির পরিধি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা ভবিষ্যতে নির্বাচনের উপরও বড় প্রভাব ফেলতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
কৃষির উপর নির্ভরতা
ভারতের এক দশমিক তিন বিলিয়ন নাগরিকের দুই-তৃতীয়াংশই জীবিকার জন্য কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল, যদিও দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষিখাতের অবদান ১৪ শতাংশ৷ গত দুই দশকে দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক মানুষ শহরে চলে আসলেও এখনো গ্রামাঞ্চলে রয়ে গেছেন অর্ধেক জনগোষ্ঠী৷
ছবি: UNI
9 ছবি1 | 9
সরকারের ওই পদক্ষেপে দেশজুড়ে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়। দিল্লির সীমানায় ক্যাম্প করে বসে পড়েন কৃষকরা। তাদের উপর পুলিশ লাঠি চালিয়েছে, জলকামান চালিয়েছে। প্রচুর আন্দোলনকারী বিক্ষোভ দেখাবার সময় মারা গেছেন। কিন্তু আন্দোলন থামানো যায়নি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দিল্লির সীমানায় লাগাতার আন্দোলন জারি রেখেছেন তারা। ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি আন্দোলনরত কৃষকরা লালকেল্লা পর্যন্ত মিছিল করেন। কৃষকদের সেই মিছিল ঘিরেও বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু কৃষক আন্দোলন বন্ধ হয়নি।
শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় খুশির আবহাওয়া দিল্লির সীমানায় বসে থাকা আন্দোলনরত কৃষক শিবিরে। তবে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, কৃষকদের জন্য নয়, মোদী এই ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে। উত্তরপ্রদেশে এখন যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে বিজেপি সরকার চালাচ্ছে। কিন্তু আগামী নির্বাচন বিজেপির জন্য খুব সুখকর নয় বলেই বিজেপির অন্দরের রিপোর্ট। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ কার্যত উত্তরপ্রদেশে গিয়ে বসে আছেন। তেলের দাম, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে উত্তরপ্রদেশের মানুষ যে খুশি নয়, তা বুঝতে পারছেন বিজেপি নেতৃত্ব। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের প্রচুর কৃষক দিল্লি সীমানায় আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ ভোট বিজেপি থেকে সরে যাচ্ছিল বলেই মনে করছেন বিজেপির নেতারা। এই পরিস্থিতিতে ভোট ফেরানোর লক্ষ্যেই প্রধানমন্ত্রী এ কাজ করলেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দিল্লি সীমানায় কৃষক আন্দোলন
07:13
পাঞ্জাবে কৃষকরা বিজেপি-র উপর প্রবল ক্ষুব্ধ ছিলেন। হরিয়ানায় তারা বিজেপি নেতাদের গ্রামে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে কৃষকদের ক্ষোভ তীব্র ছিল। উত্তরাখণ্ডেও। সবদিক বিবেচনা করেই মোদী এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে বিজেপি নেতারা জানিয়েছেন। কৃষক নেতা ও স্বরাজ পার্টির প্রধান যোগেন্দ্র যাদব বলেছেন, ''এই সরকার ও প্রধানমন্ত্রী এতদিন কৃষকদের কথা শোনেনি। তারা কৃষকদের অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে ফেলেছে। কৃষকরা অর্ধাহারে থেকেছেন, অনাহারে থেকেছেন। সরকার কিছুই করেনি। এখন তারা ভোটে হারবে বলে কৃষি আইন প্রত্যাহার করলো। এই সরকার শুধু এই ভাষাটাই বোঝে।''
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও টুইট করে বলেছেন, ''দেশের অন্নদাতা কৃষকদের সত্যাগ্রহের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হলো সরকার। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা জিতলেন। অন্নদাতাদের সত্যাগ্রহ জিন্দাবাদ।''
এর আগে একাধিকবার আইন ফিরিয়ে নেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছিল সরকারের কাছে। পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাবের মতো রাজ্যে বিধানসভায় আইনের বিরোধিতা করে প্রস্তাব পাশ করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার আইন প্রত্যাহারে রাজি হয়নি। অবশেষে সে কাজ করতে বাধ্য হলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।