আবার ক্ষমা চেয়েছে জার্মানি৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬০ লাখ মানুষ হত্যা যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেখানে গিয়ে এবার ক্ষমা চেয়েছেন জার্মানির প্রেসিডেন্ট৷ অতীতের ভুল, অপরাধ যা-ই বলি না কেন, স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে কি কেউ ছোট হয়?
বিজ্ঞাপন
হয় না৷ বরং এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয় যা শান্তির আলোকিত পথে যাত্রা শুরু করে৷ জার্মানিকে এই পথে নিয়েছিলেন ভিলি ব্রান্ট৷ সাবেক এই জার্মান চ্যান্সেলর পোল্যান্ড গিয়ে অপরাধী যেভাবে অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করে, অনেকটা সেভাবেই হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চেয়েছিলেন পোলিশদের কাছে৷ শুরুতে সবাই খুব খোলা মনে তাঁকে বাহবা দিতে পারেননি৷ কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে জার্মানি তাঁর দেখানো পথ ধরেই এগিয়েছে৷ সরকার এসেছে গিয়েছে, নতুন নতুন চ্যান্সেলর এসেছেন, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বের পাপমোচনের সদিচ্ছা থেকে একচুলও সরেনি জার্মানি৷
এবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ৮০ বছর পূর্তিতেও পোল্যান্ডে গিয়েছেন ফ্রাঙ্ক ভাল্টার স্টাইনমায়ার৷ হিটলারের নাৎসিবাহিনীর অপকর্মের কথা অসীম লজ্জা আর গ্লানি নিয়ে স্মরণ করে বলেছেন, ‘‘আমার দেশ এমন ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধ বাধিয়েছিল যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ৷ যুদ্ধ করে অপরাধ করেছিল জার্মানি৷ পোলিশদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, পোল্যান্ডকে যে আঘাত জার্মানি দিয়েছিল, তা আমরা ভুলবো না৷ পোল্যান্ডের পরিবারগুলোকে যে যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়ছিল, জনগণ যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তা আমরা ভুলবো না৷''
বাংলাদেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুই সমাধিক্ষেত্র
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় নিহত সৈনিকদের দু’টি সমাধিক্ষেত্র রয়েছে বাংলাদেশের কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে৷ প্রতিবছর প্রয়াত বীরসেনাদের সম্মান জানাতে প্রচুর দর্শনার্থী যান যায়গা দুটিতে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রি
ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রি তৈরি হয়েছে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৪-এর মধ্যে৷ কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের কাছেই এর অবস্থান৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
সমাধি সংখ্যা
ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রিতে সমাধির সংখ্যা ছিল ৭৩৮টি৷ ১৯৬২ সালে এ সমাধিস্থল থেকে একজন সৈনিকের স্বজনরা তাঁর দেহাবশেষ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান৷ বর্তমানে তাই এখানে সমাধির সংখ্যা ৭৩৭৷ এর মধ্যে ৭২৩ জনের পরিচয় জানা গেছে৷ বাকি ১৪ জন পরিচয়হীন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
নিহত যোদ্ধারা
পরিচয় পাওয়া ৭২৩ জন যোদ্ধার মধ্যে ছিলেন তিন জন নাবিক, ৫৬৭ জন সৈনিক এবং ১৬৬ জন বৈমানিক৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
কোন দেশের কতজন
ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রিতে শায়িত যোদ্ধাদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের ৩৫৭ জন, অবিভক্ত ভারতের ১৭৮ জন, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬ জন, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬ জন, জাপানের ২৪ জন, ক্যানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার ১২ জন করে, নিউজিল্যান্ডের চারজন, রোডেশিয়ার তিনজন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা, বার্মা, বেলজিয়াম ও পোল্যান্ডের একজন করে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
সমাধি
ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রির প্রথম ধাপে আছে ইউরোপিয়ান যোদ্ধাদের কবর, উপরের ধাপে আছে উপমহাদেশের যোদ্ধাদের কবর৷ সমাধিগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো৷ ১৩টি ছাড়া প্রত্যেক সমাধিতে লেখা আছে নিহত সৈনিকের নাম, বয়স, পদবী, নিহত হবার তারিখ ও ঠিকানা৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
চট্টগ্রাম ওয়ার সেমেট্রি
চট্টগ্রাম শহরের দামপাড়া এলাকার বাদশা মিয়া চৌধুরী সড়কে অবস্থিত৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তি সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এই সমাধিসেৌধ প্রতিষ্ঠা করে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
চট্টগ্রামে সমাধি সংখ্যা
চট্টগ্রাম ওয়ার সেমেট্রিতে মোট ৭৫৫টি সমাধি৷ এর মধ্যে ৭৫১টি যুদ্ধকালীন সমাধি, বাকি চারটি অন্য সময়ের৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
নিহত যোদ্ধারা
চট্টগ্রাম ওয়ার সেমেট্রিতে শায়িত যোদ্ধাদের মধ্যে ৫৪৩ জন সৈনিক, ১৯৪ জন বৈমানিক এবং বাকি ১৪ জন নাবিক৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
কখন যাবেন
ময়নামতি ও চট্টগ্রাম ওয়ার সেমেট্রি ঈদের দু’দিন ছাড়া বছরের প্রতিদিনই সকাল ৭টা থেকে বেলা ১২টা এবং দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সবার জন্য খোলা থাকে৷ তবে রমজান মাসে খোলা থাকে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত৷ জায়গা দু’টিতে বিনা খরচে প্রবেশ করা যায়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন
কুমিল্লার ময়নামতি এবং চট্টগ্রামের সমাধিক্ষেত্র দু’টি কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত৷ এর দেখভালও করে কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন৷ এর প্রধান কার্যালয় লন্ডনে৷ কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহের অনুদানে চলে এ সংস্থাটি৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
আরো সমাধিক্ষেত্র
কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন বাংলাদেশের দু’টি সমাধিক্ষেত্র ছাড়াও ভারতের ১০টি, মিয়ানমারের তিনটি, পাকিস্তানের দু’টি, থাইল্যান্ডের দু’টি, সিঙ্গাপুরের একটি, মালয়েশিয়ার একটি, এবং জাপানের একটি সমাধিক্ষেত্র রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
11 ছবি1 | 11
১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ডের ভিয়েলুইন শহরে বোমা মেরে বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেছিল জার্মান বাহিনী৷ ৮০ বছর পরও যেভাবে সেইদিনটিকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের কাছে লজ্জায় নত হয়, ক্ষমা চায়, তাতে কোনো ক্ষতি হচ্ছে না জার্মানির৷ সমৃদ্ধিতে ভাটা পড়ছে না৷ ভাবমূর্তির ক্ষতি হচ্ছে না৷এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করলেই হয়ত পৃথিবীতে হানাহানি, বৈরিতা কমে যেতো৷
মানুষ হিসেবে, একজন বাংলাদেশি হিসেবে এমন এক সময়ে জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর ভিলি ব্রান্টকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি৷ তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ নামের দেশটির অভ্যুদয়ের একটা সম্পর্ক রয়েছে৷ ব্রান্ট নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৭১ সালে৷ ১০ ডিসেম্বর পুরস্কার তুলে দেয়া হয় তাঁর হাতে৷ বাংলাদেশ তখন স্বাধীন হওয়ার অপেক্ষায়৷ অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরস্কার নেয়ার সময় ব্রান্ট বলেছিলেন, ‘‘সুধীবৃন্দ, আপনারা যখন আমার হাতে এবারের শান্তি পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন ঠিক তখন যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি নতুন দেশ জন্ম নিচ্ছে, তার নাম বাংলাদেশ৷''
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিজের দেশের অপকর্মের প্রতি ঘৃণা জানিয়ে, ইউরোপে ঐক্য স্থাপনে ভূমিকা রেখে শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন ভিলি ব্রান্ট৷ পুরস্কার গ্রহণের সময় শুধু মুখের কথায় মানুষের অধিকার আদায়ের অধিকারকে সম্মান জানাননি, পরবর্তীতে নিজের দেশের কলঙ্কজনক অতীতকে স্মরণ করে ক্ষমা চেয়েছেন আর এভাবেই নিজেকে, নিজের দেশকে তুলে নিয়েছেন অন্য উচ্চতায়৷