‘ক্ষমা না চাইলে পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক অর্থহীন’
হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৩ ডিসেম্বর ২০২১
বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ধরে রাখতে হলে পাকিস্তানকে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে৷ নয়তো ওই দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ধরে রাখার দরকার নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷
বিজ্ঞাপন
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে ভয়াবহ গণহত্যার দায় স্বীকার করে পাকিস্তান এখনো ক্ষমা চায়নি৷ বাংলাদেশের পাওনা সম্পদও ফেরত দেয়নি৷ বরং অনেক বিষয়ে এখনো বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই দেশটির অবস্থান৷ যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে প্রকাশ্যেই মদত দিয়ে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশে পাকিস্তান দূতাবাসের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতায় সহায়তার অভিযোগও আছে৷
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান, তারপর দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়৷ তবে কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অভিমত এই পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখার কোনো মানে হয় না৷ তবে দেশটি যদি গণহত্যার দায় স্বীকার করে সেদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সহায়তা ও একাত্তরের জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে সত্যিকার অর্থে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আগ্রহ দেখায় তাহলে আলাদা কথা৷
বাংলাদেশ সরকার বার বার একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে৷ দেশে ও দেশের বাইরে বাংলাদেশি নাগরিকরাও বার বার এই দাবি তুলছেন। এমনকি পকিস্তানের নাগরিকদের একাংশও বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে তাদের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে৷
গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম পাকিস্তানকে আবারো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে বলেন৷ ঝুলে থাকা দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলোরও সুরাহা করতে বলেন৷ বাংলাদেশে পাকিস্তানের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এই বিষয়গুলো তুলে ধরেন৷
শাহরিয়ার কবির
সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি সিরিজের অনুশীলনের সময় বাংলাদেশের মাঠে পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা কোনো অনুমতি ছাড়াই তাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন৷ বিষয়টি বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে৷ ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের একটি সংগঠন এর প্রতিবাদে নানা কর্মসূচি পালন করে৷ সংগঠনটির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা পাকিস্তারের সাথে কূটনৈতিকসহ সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানিয়ে আসছি৷ আমরা ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধার রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেলাম৷ কিন্তু সেই পরাজিত পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে৷ তারা এখনো বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারছে না৷ এই দেশে তাদের সহযোগীরা এখনো আছে৷ তাদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে৷’’
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান নানাভাবে মুসলিম বিশ্বকে দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য প্রভাবিত করেছে৷ তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তান দূতাবাসের দুই কূটনীতিক৷ শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলিম চৌধুীর কন্যা ড. নজুহাত চৌধুরী বলেন, ‘‘বাংলাদেশের পাকিস্তান দূতাবাস পাকিস্তানি গোয়েন্দা আইএসআই-এর অফিসে পরিণত হয়েছে৷ তারা এখানে বসে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে৷ বাংলাদেশে পাকিস্তনি দূতাবাস রাখার কোনো মানে হয় না৷ দুটি দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকবে এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু পাকিস্তানের কথা আলাদা৷ তারা এই দেশে জেনোসাইড-এর জন্য দায়ী৷ তাই তাদের সবার আগে ক্ষমা চাইতে হবে৷ কিন্তু তারা তো ক্ষমা চায়নি৷ তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যারা এই জেনোসাইডে জড়িত তাদের বিচার এখনো করেনি৷ উল্টো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে৷ এ ধরনের দুষ্ট রাষ্ট্রের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখার বিরোধী আমি৷’’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কিছু দুর্লভ ছবি
সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-র সংগ্রহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কিছু দুর্লভ ছবি রয়েছে৷
ছবি: AP
উত্তাল মার্চ
১৯৭১ সালের ২৩ শে মার্চ ঢাকার রাস্তায় স্বাধীনতার দাবিতে হারপুন হাতে বিক্ষোভ মিছিল৷
ছবি: AP
যশোরে মুক্তিবাহিনী
২ এপ্রিল ১৯৭১৷ যশোরে মার্চ করছে মুক্তিবাহিনী৷
ছবি: AP
ত্রিপুরায় বাংলাদেশি শরণার্থী
১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল৷ প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে৷ প্রাণ বাঁচাতে ভারতের ত্রিপুরার মোহনপুরের একটি স্কুল ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশিরা৷
ছবি: AP
ভারত সীমান্তের কাছে বাংলাদেশিদের অবস্থান
১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল৷ ভারত সীমান্তের ৩০ মাইলের মধ্যে কুষ্টিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেকেই অবস্থান করছিল৷
ছবি: AP
বেনাপোলের কাছে শরণার্থী শিবির
১৪ এপ্রিল ১৯৭১, যশোরের বেনাপোলের কাছে ভারত সীমান্তে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল পাঁচ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি৷
ছবি: AP
আহত মুক্তিযোদ্ধা
১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর বোমা হামলায় আহত একজন মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসা দিতে নিয়ে যাচ্ছেন বেসামরিক মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধারা৷
ছবি: AP
মুক্তিবাহিনী
১৯৭১ সালের ৩ রা আগস্ট৷ ঢাকার কাছে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হেমায়েতউদ্দীন একটি গোপন ক্যাম্প থেকে মেশিনগান তাক করে রেখেছেন৷
ছবি: AP
১৯ বছর বয়সি শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে প্লাটুন
১৩ নভেম্বর ১৯৭১৷ ফরিদপুরে রাইফেল হাতে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ৷ ৭০ সদস্যের একটি প্লাটুন গড়া হয়েছিল সেখানে৷ সেই প্লাটুন দক্ষিণাঞ্চলে সামরিক ও চিকিৎসা দ্রব্য সরবরাহ করত৷ একদম বামে থাকা ১৯ বছর বয়সি তরুণটি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র৷ ৭০ জনের প্লাটুনের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি৷
ছবি: AP
মুক্তিবাহিনীর পারুলিয়া দখল
১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর৷ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পারুলিয়া গ্রাম দখল করে নেয় মুক্তিবাহিনী৷
ছবি: AP
আখাউড়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী
২৯ নভেম্বর, ১৯৭১৷ আখাউড়ায় অস্ত্র পাহাড়া দিচ্ছে পাকিস্তানি সেনারা৷ তাদের দাবি ছিল, ভারতীয় সৈন্যদের কাছ থেকে এসব অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে৷
ছবি: AP
ভারতীয় সেনাদের হামলা
২ ডিসেম্বর, ১৯৭১৷ যশোরে পাকিস্তানি সেনাদের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে ভারত ৷ এক পাকিস্তানি সেনাসদস্য রাইফেল নিয়ে অন্যত্র যাচ্ছে৷ অন্য সেনারা তখন অস্ত্র তাক করে পরিখার মধ্যে রয়েছে৷
ছবি: AP
ভারতীয় সেনা
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর৷ ভারতীয় সীমান্তের কাছে ডোঙ্গারপাড়ায় খোলা মাঠে মেশিনগান তাক করে রেখেছেন এক ভারতীয় সেনা৷
ছবি: AP
ডিসেম্বরেও ঢাকায় পাকিস্তানি সার্জেন্ট
১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১৷ রাজধানী ঢাকার অদূরে একটি এলাকায় একজন পাকিস্তানি সার্জেন্ট দুই সেনাকে নির্দেশনা দিচ্ছে৷
ছবি: AP
যুদ্ধবিরতি
রবিবার ১২ ডিসেম্বর. ১৯৭১৷ ঢাকা বিমানবন্দরে অপেক্ষায় আছেন বিদেশিরা৷ একটি ব্রিটিশ বিমান অবতরণ করেছে৷ ৬ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির সময় বিদেশিদের নিয়ে যাওয়ার জন্যই ঐ বিমানটি পাঠানো হয়েছিল৷
ছবি: AP
ভারতীয় ট্যাংক
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর৷ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্যাংক বগুড়ার দিকে রওনা হয়েছে৷
ছবি: AP
চার রাজাকারকে হত্যার পর মুক্তিবাহিনীর প্রতিক্রিয়া
হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা চার রাজাকারকে হত্যার পর আল্লাহ’র উদ্দেশে শুকরিয়া জানাচ্ছেন মুক্তিসেনারা৷
ছবি: AP
16 ছবি1 | 16
বাংলাদেশে যুদ্ধপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান সেটা বানচালের নানা ষড়যন্ত্র করেছে৷ তারা তাদের এদেশীয় দোসরদের বাঁচাতে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব এনেছে৷ শুধু তাই নয়, সেখানকার রাস্তায় যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনে মিছিলও হয়েছে৷
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক শাহরিয়ার কবির মনে করেন, ‘‘পাকিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সীমিত পর্যায়ে কূটনেতিক সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন৷ কিন্তু বাংলাদেশে তাদের এত বড় দূতাবাসের কোনো দরকার নেই৷’’
তিনি বলেন, ‘‘গণহত্যার প্রধান অপরাধী পাকিস্তান৷ পাকিস্তান এখনো তাদের বিচার করেনি৷ কিন্তু আমরা পারি৷ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আমাদের যে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আছে, সেখানে তাদের বিচার করা যায়৷ আর পাকিস্তানকে আমাদের ক্ষমা চওয়ার জন্য চাপ দিতে হবে৷ গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করতে হবে৷ আমাদের পাওনা সম্পদ এখনো তারা ফেরত দেয়নি৷ সেটা ফেরত দিতে হবে৷’’
শাহরিয়ার কবির আরো বলেন, ‘‘এসব না করে উল্টো তারা (পাকিস্তান) বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত৷ তাদের দূতাবাস জঙ্গিদের মদত দেয়৷ স্বাধীনতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কাজ করে৷’’
বাংলাদেশ বার বার আহ্বান জানালেও পাকিস্তান এখনো ক্ষমা না চাওয়ার ব্যাপারে অনঢ়৷ ২০০৯ সালে পকিস্তানের দূত আলী বাসার খান দেখা করতে এলে তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সাথে পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন৷ কিন্তু আলী বাসার বলেন, ‘‘পকিস্তান ক্ষমা চাইবে না৷’’
গত অক্টোবরে ঢাকায় পাকিস্তান দূতবাসের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়৷ ৯ অক্টোবর ঢাকায় পাকিস্তান রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর প্রতিবাদ জানালে তারা ভিডিওটি সরিয়ে ফেলে৷
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের একটি অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটুক্তি করা হয়৷
গণহত্যার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ক্ষমা চাইলেও একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের এখনো ক্ষমা না চাওয়ার বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘পাকিস্তানের সব ধরনের পাঠ্যপুস্তকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, অপব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে৷ ফলে সেখানকার যারা নতুন প্রজন্ম, তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘তারা যদি সত্যিকার অর্থে ক্ষমা প্রার্থনা করতো, অনুতপ্ত হতো, তাহলে এই কাজগুলো করতো না৷ জাপানিরা ক্ষমা চেয়েছে৷ জার্মানি অহরহ ইহুদিদের ওপর অত্যাচারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে যাচ্ছে৷ ক্ষমা চাইলে কেউ ছোট হয়ে যায় না৷ এটা পাকিস্তানিদের বোঝানো কঠিন৷’’
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
তিনি মনে করেন, ‘‘এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়৷ আওয়ামী লীগের একটি নীতিগত জায়গা আছে৷ সেখানে তারা ছাড় দেবে না৷ পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ানোর ব্যাপারে তারা অনঢ়৷’’
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, ‘‘পাকিস্তান সরকার এখন বাংলাদেশের নানা ধরনের উন্নয়নের প্রশংসা করলেও আসল জায়গায় তাদের মনোভাবের পরিবর্তন আসেনি৷ তারা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি৷ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় তারা তাদের পার্লামেন্টে হইচই করলো৷ তবে তাগিদ বা প্রয়োজন পাকিস্তানের৷ আমাদের তেমন কোনো প্রয়োজন নেই৷ তাই পাকিস্তান যদি চায় তাহলে তাদের মনোভাবে পরিবর্তন আনতে হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘তারা আমাদের পাওনাও ফেরত দেয়নি৷ আমরা কিন্তু স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সহায়তা বাবদ ঋণের আমাদের অংশ ফেরত দিয়েছি৷’’
পাকিস্তান সরকারের ওপর তারপরও চাপ প্রবল হচ্ছে৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দাবি জানানো হচ্ছে পাকিস্তান যাতে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়৷ চলতি মাসেই নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে আয়োজিত একটি সম্মেলন থেকে এই দাবি জানানো হয়৷ ইউরোপভিত্তিক প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম (ইবিএফ) সুইজারল্যান্ড মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশের সহযোগিতায় আয়োজিত সম্মেলনে একাত্তরের গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে পাকিস্তান সরকারকে চাপ দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দাবি জানানো হয়৷ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, একাত্তরের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়ে ৩০ লাখ শহিদ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন একান্ত প্রয়োজন৷ মানবাধিকার লঙ্ঘনমুক্ত বিশ্ব গঠন এবং বিশ্বজুড়ে পরবর্তী প্রজন্মের নিরাপত্তার জন্য গণহত্যার স্বীকৃতি অপরিহার্য৷ বিশ্ব সম্প্রদায় যদি কোনো অপরাধকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে ভবিষ্যতে সেই অপরাধ পুনরায় ঘটানোর দরজা খোলা থাকে৷
এদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বিশ্বের ৫০টি দেশের পাকিস্তান দূতাবাসে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে স্মারকলিপি দিয়েছে বিশ্বব্যাপী প্রবাসীদের সংগঠন বাংলাদেশ প্রবাসী অধিকার পরিষদ৷
পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ ঢাকায় এই ডিসেম্বরে নিয়মিত কর্মসূচি পালন করছে৷
একাত্তরের বীর নারীরা
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পৌঁছে দেয়া, চিকিৎসক ও সেবিকা হিসেবে কাজ করা ছাড়াও অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের বীর নারীরা৷ এমন কয়েকজন অসীম সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধার গল্প শুনুন৷
ছবি: privat
ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা রহমান বীরপ্রতীক
স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন সেনা কর্মকর্তা ও চিকিৎসক তৎকালীন সিতারা রহমান৷ তার বড়ভাই মেজর এটিএম হায়দার বীর উত্তম ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের ডেপুটি কমান্ডার৷ কিন্তু ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে নির্মমভাবে খুন হন মেজর হায়দার ৷
ছবি: privat
সিতারার যুদ্ধে যাওয়ার গল্প
জুলাই মাসে ভাই মেজর এটিএম হায়দার আগরতলা যাওয়ার জন্য তার কাছে একটি চিঠি পাঠান৷ চিঠির সঙ্গে ছিল একটি পিস্তল৷ পথে কোথাও পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়লে আত্মহত্যা করার জন্য সে পিস্তল পাঠিয়েছিলেন সিতারা রহমানের ভাই৷ মাতৃভূমির মুক্তির জন্য সামরিক চাকরি উপেক্ষা করে রণাঙ্গনে হাজির ছিলেন ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা রহমান৷ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় নেতৃত্ব দেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়৷
ছবি: privat
যুদ্ধাহতের চিকিৎসাসেবা
ত্রিপুরার বিশ্রামগঞ্জে ৪০০ শয্যার বাংলাদেশ হাসপাতাল স্থাপন হলে সেখানে চিকিৎসা সেবা শুরু করেন ডা. সিতারা রহমান৷ তার সাথে যোগ দেন আরো বেশ কিছু সাহসী নারী৷ তবে বিজয় পর্যন্ত বাংলাদেশ হাসপাতালের সবকিছু দেখাশোনা ও পরিচালনার দায়িত্ব ছিল ডা. সিতারার উপর৷ সেখানে ডা. জাফরুল্লাহ এবং ডা. মুবিন ছিলেন৷ বর্তমানে সাভারের গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল সেই উদ্যোগেরই ধারাবাহিকতা৷
ছবি: Dr. Sitara Rahman
কিশোরী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি বীরপ্রতীক
মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার জন্য বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়া দুই নারী মুক্তিযোদ্ধার আরেকজন তারামন বিবি৷ মাত্র ১৪ বছর বয়সেই ১১ নম্বর সেক্টরে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে৷ ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার তারামন বিবিকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করেন৷ কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি৷ ময়মনসিংহের একজন গবেষক প্রথম তাকে খুঁজে বের করেন৷
ছবি: Fazle Elahi Shwopon
ছদ্মবেশী তারামন বিবি
সম্মুখযুদ্ধ ছাড়াও শত্রুপক্ষের তৎপরতা এবং অবস্থান জানতে গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করেছেন তারামন৷ সারা শরীরে কাদা মাটি, চক, কালি এমনকি মানুষের বিষ্ঠা পর্যন্ত লাগিয়ে পাগল সেজেছেন, চুল এলো করে বোবা সেজে পাক সেনাদের সামনে হাসি-কান্নার অভিনয় করেছেন৷ কখনও প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গুর মতো চলাফেরা করে শত্রুসেনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছেন নদী সাঁতরে গিয়ে৷ আবার কলা গাছের ভেলা নিয়ে কখনও পাড়ি দিয়েছেন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী৷
ছবি: DW
যুদ্ধজয়ের আনন্দময় মুহূর্তে তারামন
‘‘একদিন দুপুরের দিকে একটা জঙ্গি বিমান এল৷ এই বিমানটা আগের বিমানগুলোর মতো নয়৷ এটা থেকে কোন বোমা ফেলা হলো না৷ শুধু একটা চক্কর দিয়ে যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন আমরা গুলি ছুঁড়তে চাই৷ কিন্তু বাধা দেন আজিজ মাস্টার৷ ক্যাম্প থেকে আমাদের জানানো হলো, তাদের কাছে খবর এসেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে৷ পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে৷ আনন্দে আমার দুচোখ দিয়ে পানি আসতে শুরু করল৷ ক্যাম্পে মুহুর্মুহু স্লোগান উঠছে জয় বাংলা৷’’
ছবি: Fazle Elahi Shwopon
ফোরকান বেগমের সশস্ত্র প্যারেড
১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন ফোরকান বেগম৷ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকেছেন তিনি৷ ঢাকা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরেছেন স্বাধিকারের বার্তা নিয়ে৷ ঢাকায় গোয়েন্দাগিরি ও গেরিলা হামলার জন্য বিশেষ বাহিনী তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন৷ আত্মঘাতী হামলার জন্যও কিছু ছেলে-মেয়েকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন৷
ছবি: Forkan Begum
ফোরকানের ছবি নিয়ে খুঁজতো পাক বাহিনী
লেম্বুছড়া শিবিরে বাছাই করা আট-দশ জন সাহসী নারীকে নিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন ফোরকান বেগম৷ সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এই বিশেষ বাহিনীর সদস্যদেরকে দেশের ভেতরে গেরিলা হামলার জন্য পাঠাতে চেয়েছিলেন৷ এক সপ্তাহ পরেই তিনি জানান, ফোরকানের ছবি পকেটে নিয়ে তাকে খুঁজছে পাক সেনারা৷ তাই ঢাকায় না পাঠিয়ে ফোরকানের কাছ থেকে দেশের ভেতরে তার প্রশিক্ষিত সঙ্গীদের ঠিকানা নিয়ে তাদেরকে গেরিলা অভিযানে কাজে লাগানো হয়৷
ছবি: Forkan Begum
নার্সিং স্কোয়াডে তাহরীমা
ফোরকান বেগমের কাজে উৎসাহিত হয়ে আগরতলার হাপানিয়া শিবির থেকে অন্য ১৩জন মেয়েসহ তাহরীমা চৌধুরী যোগ দেন জিবি এবং বিএম হাসপাতালের নার্সিং স্কোয়াডে৷ সেখানে তারা সেবিকা হিসেবে কাজের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন৷ ওষুধের মাপ-জোখ, কীভাবে ড্রেসিং করতে হয়, কীভাবে সেলাই করতে হয়, হাড় ভেঙে গেলে কীভাবে প্লাস্টার করতে হয় এসব কিছু শেখানো হয়৷ তখন তার বয়স কেবল ১৪ বছর৷
ছবি: Md Alauddin
রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা
হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত দেহের ছবি এখনও ভেসে ওঠে তাহরীমার চোখে৷ নিজের অভিজ্ঞতা ডয়চে ভেলেকে জানান এভাবে, ‘‘এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছি যাদের হাত নেই, চোখ নেই কিংবা পেটের ভুড়ি বের হয়ে গেছে৷ সেখানকার যে আহাজারি, চিৎকার আর কষ্টগুলো দেখেছিলাম এখনও সেগুলো যেন আমার চোখের সামনে ভাসে৷’’
ছবি: Md Alauddin
কৃষক পরিবারের যোদ্ধা শেফালী রানী
গ্রামের এক কৃষক পরিবারে বড় হলেও নিজের দৃঢ় মনোবলের কারণে বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মহাবিদ্যালয়ে পা দেন ঝালকাঠির সাহসী নারী শেফালী রানী৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর কলকাতা গিয়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কার্যালয় খুঁজে বের করেন তিনি৷ তারপর মতিয়া চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নেন গোবরা শিবিরে৷
ছবি: Sukanta
লড়াইয়ে সাথী দুই বোন আলো ও মধুমিতা
চট্টগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা দুই বোন আলো রানী ও মধুমিতা বৈদ্য৷ তাদের ভাইও মুক্তিযোদ্ধাদের গাড়ি চালাতেন৷ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করার সময়ের অনুভূতি জানাতে গিয়ে আলো রানী বলেন, ‘‘বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে আমরা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতে গিয়ে, তাঁদের দেহ থেকে গুলি বের করতে গিয়ে এমন পরিস্থিতি দেখতাম যে খুব কষ্ট হতো আমাদের৷ সেই অবস্থায় মনে হতো যে, হাসপাতালে কাজ না করে অস্ত্র নিয়ে কাজ করাটাই ভালো ছিল৷’’
ছবি: DW
গেরিলা মিনারা
কলেজ জীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত মিনারা বেগম৷ যুদ্ধের সময় দেশের অভ্যন্তরে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন মিনারা ও তাঁর সঙ্গীরা৷ আগরতলা যাওয়ার সময় আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে আশ্রয় নিতে গিয়ে ভুল করে ঢুকে পড়েন এলাকার শান্তিবাহিনীর প্রধানের বাড়িতে৷ পরে বুঝিয়ে শুনিয়ে তার দুই ছেলেকেই মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতে রাজি করান মিনারা৷
ছবি: S.Siddiquee
কৌশলে রক্ষা
সেই অভিজ্ঞতা ডয়চে ভেলেকে বলেন মিনারা বেগম, ‘‘আমি এবং ফোরকান বেগম আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি৷ আমরা নরসিংদীর কাছে পাক সেনাদের সামনে পড়ে যাই৷ কিছুক্ষণ পরেই সেখানে গ্রাম পোড়ানোর জন্য যাচ্ছিল পাক সেনারা৷ এর মধ্যেই সেখানে অনেক কৌশল করে রক্ষা পেয়ে যাই৷ সেসময়ও আমাদের ব্যাগে ছোট আকারের গ্রেনেড ছিল৷ আমরা তো আগেই অস্ত্র চালনা শিখেছিলাম৷’’
ছবি: Minara Begum
নয় নম্বর সেক্টর নারী মুক্তিবাহিনীর প্রধান রমা দাস
১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাস্টার্স পড়ছিলেন রমা দাস৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই তাঁর লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়৷ ফলে প্রায় প্রতিদিনই কলাভবন, কার্জন হল, শহীদ মিনার চত্বরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন চত্বরের মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতেন তিনি৷ ফেব্রুয়ারি ও মাচের্র দিনগুলোতে তাঁরা দলবেঁধে বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিতেন৷ এছাড়া পোস্টার, ব্যানার ও দেয়াল লিখনে অংশ নিতেন৷
ছবি: Pinaki Das
অস্ত্র প্রশিক্ষণ
মাদ্রা প্রশিক্ষণ শিবিরে অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন রমা দাস৷ মেজর জলিল তাকে নয় নম্বর সেক্টরের নারী মুক্তিবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব দেন৷ দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে আত্মনিয়োগ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে কথিকা পাঠও করতেন রমা দাস৷ দেশ স্বাধীন হলেও খুলনায় মেজর জলিলের নেতৃত্বে গঠিত শিবিরে থেকে বিভিন্ন কাজ করেছেন তিনি৷
ছবি: Dr. Sitara Rahman
নারী মুক্তিফৌজের সংগঠক নিবেদিতা দাস
সিলেটের বীর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম সংগঠক নিবেদিতা দাস৷ পাঁচ নম্বর সেক্টরে নারী মুক্তি ফৌজের সম্পাদিকা ছিলেন তিনি৷ যুদ্ধ শুরু হলে ভারতের চেলা শিবিরে যান নিবেদিতা দাস৷ কিছুদিন পর জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল হক এবং আওয়ামী লীগ নেতা হেমেন্দ্র দাস পুরকায়স্থের সহায়তায় সিলেটের নারীদের নিয়ে নারী মুক্তিফৌজ গঠন করেন তাঁরা৷ এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন প্রীতিলতা দাস পুরকায়স্থ এবং সম্পাদিকা ছিলেন নিবেদিতা দাস৷
ছবি: Rupak Das
মেলাঘর হাসপাতালের দায়িত্বে কাজী হেলেন
১৯৫৪ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জে জন্ম কাজী হেলেনের৷ আগরতলার রাজবাড়িতে কর্নেল রউফ-এর সহায়তায় তিন মাসের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেন কাজী হেলেন৷ এরপর তাঁকে জিবি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত করা হয়৷ পরে মেলাঘর হাসপাতালের দায়িত্ব পান তিনি৷
ছবি: DW/AHM Abdul Hai
রাজশাহীর গর্ব মুক্তিযোদ্ধা সাবিত্রী বিশ্বাস
বাবার উৎসাহে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ শুরু করেন সাবিত্রী বিশ্বাস৷ আগরতলায় হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ‘‘আমার বাবা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর প্রশিক্ষণ শিবিরের খোঁজ পেয়ে আমাকে নিয়ে সেখানে গেলেন৷ বাবা বললেন, দেশের জন্য কিছু করো মা, না হলে তো হবে না৷ তুমি কি শুধু শুধু বসে থাকবে একা? তখন আমি সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে চিকিৎসা সেবা শুরু করি৷’’
ছবি: Rabiul Anowar Tomy,
‘মুক্তি আপা’ খালেদা খানম
শরীয়তপুরের সাহসী নারী খালেদা খানম৷ তিনি এতোটাই সক্রিয়ভাবে গ্রামে গ্রামে কাজ করতেন যে, শরীয়তপুর অঞ্চলে তাঁকে সবাই ‘মুক্তি আপা’ নামেই চিনতো৷ ২৪শে মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজে অস্ত্র খালাসের খবর পেয়ে মিছিল নিয়ে খালেদা ও তার সঙ্গীরা তা ঠেকানোর জন্য রওয়ানা হন৷ কিন্তু কাঁদানে গ্যাস ও গুলির মুখে পড়ে তারা আর এগোতে পারেননি৷ পরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে নিয়েছিলেন অস্ত্র চালনা ও চিকিৎসার ট্রেনিং৷
ছবি: Nur-A-Ashraful Alam
চিকিৎসার পাশাপাশি যুদ্ধ
ডা. লুৎফুন নেসা বলেন, ‘‘মরিচা হাউসে কাঠের পিস্তল দিয়ে প্রশিক্ষণ নিতাম৷ সেই নমুনা অস্ত্রের বদলে যে একদিন সত্যি আমাদের আসল বন্দুক হাতে নিয়ে লড়তে হবে তা ধারণা করাও কঠিন ছিল৷ তবে পরে যখন কলকাতায় গিয়ে আসল বন্দুক হাতে প্রশিক্ষণ নিয়েছি, তখন মনে হয়েছে ওরা আমাদের এভাবে মারছে, আমরাও প্রয়োজনে তাদেরকে এই অস্ত্র দিয়ে মারবো৷ চিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসা তো করবোই, কিন্তু নিজের হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধও আমরা করবো৷’’
ছবি: privat
মুন্সীগঞ্জের বীর ডা. লুৎফুন নেসা
১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন লুৎফুন নেসা৷ একইসাথে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদিকা ছিলেন তিনি৷ সেই হিসেবে চলমান স্বাধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি৷ এছাড়া আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে ইন্দিরা রোডের মরিচা হাউসে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন লুৎফুন নেসা৷
ছবি: privat
স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ডা. বদরুন নাহার
রাতের অন্ধকারে নৌকায় করে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতেন ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী৷ একাধিকবার তার নৌকা পাক সেনারা আটকও করে৷ তবু নানা কৌশলে তিনি রক্ষা পান পাক হানাদারদের হাত থেকে৷
ছবি: DW
মৌলভীবাজারের নারী নেত্রী রুমা চক্রবর্তী
একাত্তর সালে স্কুল ছাত্রী হলেও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন রুমা চক্রবর্তী৷ এছাড়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবায় আগে থেকেই নিজেকে তৈরি করেন এই সাহসী নারী৷ মে মাস পর্যন্ত তিনি ঢাকায় থেকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন৷ পরবর্তীতে ভারতের বনগাঁয় চল্লিশ শয্যার অস্থায়ী হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে অন্যদের সাথে যোগ দেন রুমা চক্রবর্তী এবং তার বোন৷