1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ক্ষমা প্রার্থনার বেনজির সংস্কৃতিতে গণমাধ্যম যখন ‘ক্লায়েন্ট'

১১ জুলাই ২০২৫

বলা হয়, ‘‘সত্যপি সামর্থে পরাপকারসহনং ক্ষমা।'' এর অর্থ, প্রতিকারের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরের অপকার সহ্য করাই হলো ক্ষমা। দুর্বল তো বটেই, যিনি শক্তিধর তাকেও ক্ষমা করতে হয়, ক্ষমা চাইতে হয়, যদি তিনি ভুল করেন, অপরাধ করেন।

গণমাধ্যমের কাভারেজ রাজনৈতিক দল ও নেতাদের উপর 'জন ও আইনি চাপ' তৈরি করতে পারে, যা তাদের ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে।ছবি: Shamima Nasrin Lucky

এটা তার দায়িত্বশীলতার পরিচয় বহন করে।ক্ষমা, দায়িত্বশীলতা – এই বিষয়গুলো নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় – সবক্ষেত্রেই দায়িত্বশীলতা এবং ক্ষমা প্রার্থণা নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জটিলতা আছে। তারপরও ক্ষমা প্রার্থনার সংস্কৃতি একটি সুস্থ ও পরিপক্ব রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য অপরিহার্য। এটি শুধু ব্যক্তিগত ভুলের স্বীকারোক্তি নয়, বরং সমষ্টিগতভাবে দায়িত্ব গ্রহণ, ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের একটি প্রক্রিয়া বলে বিবেচিত হয়। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করে এবং রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে বিভেদ কমাতে সাহায্য করে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো নাগরিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর জবাবদিহিতা৷ সেটি নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্বশীলতার পাশাপাশি ক্ষমা প্রার্থণার সংস্কৃতি গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলোর কাজকে সহজ করে দেয়। এখানে গণতন্ত্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ' হিসেবে গণমাধ্যমেরও বেশ শক্তিশালী ভূমিকা আছে। গণমাধ্যমের কাজ শুধু রাষ্ট্র পরিচালনার অংশীদারদের ভুল ধরিয়ে দেয়া নয়; তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখা, ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা এবং জনমত গঠনে সহায়তা করা। এজেন্ডা-সেটিং এবং ফ্রেমিংয়ের মতো শক্তিশালী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণমাধ্যম নির্দিষ্ট বিষয়গুলোকে জনসাধারণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে এবং সেগুলোর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে। গণমাধ্যম সরাসরি জনগণকে কী ভাবতে হবে তা না বললেও, কী বিষয়ে ভাবতে হবে তা প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশ, যেখানে 'জিরো-সাম' মানসিকতার (যেখানে এক পক্ষের লাভ মানে অন্য পক্ষের ক্ষতি) রাজনৈতিক সংষ্কৃতি বেশ প্রবল, সেখানে রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতা এবং ক্ষমা প্রার্থনার এই সংস্কৃতি প্রায় অনুপস্থিত। আবার বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থা হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনুলিপি, যেখানে রাজনৈতিক ছত্রছায়ার বাইরে গণমাধ্যম কাঠামো ও ব্যবস্থার চিন্তা প্রায় অলীক ধারণা, সেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমা ও দায়িত্বশীলতা প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমের ভূমিকা হয়ে থাকে ‘গ্রন্থগত বিদ্যা পরহস্তে ধন'- এর মতো। প্রয়োজন পড়লে, কিংবা ইস্যু হিসেবে চাউর হলে গণমাধ্যম দু-চার কথা বলে থাকে। কিন্তু এজেন্ডা-সেটিং এবং ফ্রেমিংয়ের মতো শক্তিশালী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুচিন্তিত ভূমিকা রাখার লক্ষণ দেখা যায় না। 

ক্ষমা প্রার্থনা, বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, শুধু একটি শব্দ বা বাক্য নয়। এটি একটি গভীর প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়, যা ঐতিহাসিক ভুল স্বীকার, দায়িত্ব গ্রহণ এবং অনুশোচনা প্রকাশের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা, ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতি জানানো এবং ভবিষ্যতে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি না করার প্রতিশ্রুতি দেয়া। এটি ব্যক্তি থেকে সমষ্টিগত পর্যায়ে, যেমন রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যেখানে অতীতের অন্যায় বা ভুল কাজের জন্য ক্ষমা চাওয়া হয়। এই ধরনের ক্ষমা প্রার্থনা একজন ব্যক্তির, একটি দল, রাষ্ট্র কিংবা জাতির কলঙ্কিত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে এবং অতীতের ভুল থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিতে সাহায্য করে। এটি ক্ষতিগ্রস্ত গোষ্ঠী এবং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে, যা সত্য ও পুনর্মিলন প্রক্রিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। রাষ্ট্রীয় তথা সামাজিক অপরাধের দায় স্বীকার করে রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্রের প্রতিনিধির ক্ষমা চাওয়ার ঘটনা অনেক দেশেই বিরল নয়। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী গ্রাহাম জি ডডস ১০৭৭ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বড় বড় রাজনৈতিক ক্ষমা প্রার্থণাগুলোর একটি তালিকা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে সেই তালিকা আছে। ১০৭৭ সালে রোমান রাজা চতুর্থ হেনরি পোপ সপ্তম গ্রেগরির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। সে সময় চার্চ-স্টেট দ্বন্দ্বে চার্চের লোকজনকে খালি পায়ে তুষারের মধ্যে তিন দিন দাঁড়িয়ে রাখার জন্য চতুর্থ হেনরি ক্ষমা চেয়েছিলেন। জার্মানির চ্যান্সেলর ভিলি ব্রান্ডট ১৯৭০ সালে ওয়ারশ ঘেটোতে হাঁটু গেড়ে বসে হলোকাস্টের জন্য জার্মানির অপরাধ, দুঃখ ও দায়িত্ব প্রকাশ করেছিলেন। ঘটনার ৮০ বছর পরে পোল্যান্ডের কাছে সর্বসমক্ষে সরকারিভাবে ক্ষমা চেয়েছেন জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার। জাপানের প্রধানমন্ত্রী কাকিউই তানাকা ১৯৭২ সালে চীনের প্রতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৃষ্ট 'বিশাল ক্ষতির' জন্য দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছিলেন। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ ১৯৯০ সালে কাতিয়ান গণহত্যার দায় স্বীকার করেছিলেন। রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালের যে ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গায় কমপক্ষে আট লাখ লোক মারা যায়, সেই গণহত্যার দায় স্বীকারে করে ফ্রান্স। রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে গিয়ে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ ২০২১ সালে সেদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী জমানার শেষ প্রেসিডেন্ট ছিলেন এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক। তার হাত ধরে দেশটিতে পালা বদল ঘটেছিল। ক্লার্ক নিজে ১৯৯৭ সালে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন'-এ হাজিরা দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর অতীতে সংঘটিত অত্যাচারের জন্য প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে, এবং দেশের জীবিত ও মৃত শ্বেতাঙ্গদের তরফ থেকে ক্ষমা চান। দক্ষিণ আফ্রিকার ঔপন্যাসিক জে এম ক্যুটসি‘র বিখ্যাত উপন্যাস ‘ওয়েটিং ফর দ্য বারবেরিয়ানস'-এ এই ক্ষমা চাওয়ার গল্প আছে। এই উপন্যাসে একজন ম্যাজিস্ট্রেট তার কৃতকর্মের জন্য এক কৃষ্ণাঙ্গ পঙ্গু মেয়ের সেবা করার মধ্য দিয়ে নিজের অপরাধকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। রাষ্ট্র হোক, কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের এমন ক্ষমা প্রার্থনার গল্পগুলোর অনেক গুরুত্ব আছে। এগুলোর মধ্য দিয়ে সূচিত হয় রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্তরে রক্তাক্ত সম্পর্কের শুশ্রূষা।

দুঃখজনকভাবে, বৈশ্বিক এই দায়িত্বশীলতার সংস্কৃতির বিপরীতে ভারত উপমহাদেশের দেশগুলোর রাজনৈতিক অঙ্গনে দায় স্বীকারের প্রবণতা প্রায় অনুপস্থিত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে বর্বরতা, গণহত্যা, ধর্ষণ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়েছিল তার জন্য পাকিস্তান এখনো কোনো ধরনের ক্ষমা চায়নি। ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর দিল্লি শহরে শিখ নিধনের ঘটনায় দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী ক্ষমা চাননি। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার জন্য ক্ষমা চাওয়ার সম্ভাবনা বহু বার জোর গলায় উড়িয়ে দিয়েছেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকে থাকালেও একই চিত্র দেখা যাবে। ১৯৭১ সালে গণহত্যার সহযোগী হিসেবে জামায়াতের ইসলামের যে দায় আছে তার জন্য দলটির পক্ষ থেকে কখনো অনুশোচনাও করা হয়নি। অনেকেই জামায়াতের আমীর ড. শফিকুর রহমানের সাম্প্রতিক 'শর্তহীন ক্ষমা'র কথা তুলে ধরেন। কিন্তু একই সাথে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘‘ইতিহাসই নির্ধারণ করবে কোনটি সঠিক বা ভুল'' এবং ‘‘আজ যা ভুল বলে মনে হচ্ছে, আগামীকাল তা সঠিক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা যেতে পারে।'' এই ধরনের বক্তব্য দায় স্বীকারের আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং এটি হলো অনুশোচনাহীন ক্ষমা। আবার গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গুম-খুনের অনেক অভিযোগ সামনে উঠে আসছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে দলটির পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া ও ভুল স্বীকারের কোনো লক্ষণ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অভিযোগ প্রমাণের আগেই দায় স্বীকার তো দূরের কথা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্যদের ওপর দায় চাপানোর সংস্কৃতিই বরং চালু আছে। যে-কোনো ব্যর্থতা বা অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য ‘ব্লেইম গেম‘, অর্থাৎ প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি জনপ্রিয় কৌশল। এই প্রবণতা এতটাই গভীর যে, কোনো বড় নির্বাচনি পরাজয় বা বড় ধরনের প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য কোনো নেতা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন এমন নজির নেই। এই দায় স্বীকার না করার সংস্কৃতি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আত্মসমালোচনার অভাব তৈরি করে। যখন ভুল থেকে শেখার কোনো প্রক্রিয়া থাকে না, তখন একই ভুল বারবার ঘটতে থাকে, যা সুশাসন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য মারাত্মক হুমকি।  

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি নিয়ে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জটিলতা আছে। মহাভারতে এ নিয়ে দ্রৌপদীর সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের অনেক বিতর্ক আছে। দ্রোপদির যুক্তি ছিল, বিরামহীন ক্রোধ অশুভ, আবার নিরবচ্ছিন্ন ক্ষমাও অনিষ্টকর। তবে প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যুধিষ্ঠিরের মন্ত্র ছিল, ক্ষমাই ধর্ম, ক্ষমাই এই পৃথিবীকে ধারণ করে আছে। শক্তিধরেরা যখন ক্ষমা চান, তার মধ্যে থাকে এক বৃহত্ত্বের ব্যঞ্জনা থাকে। শাসকরা বা রাষ্ট্র পরিচালকরা কিংবা রাজনীতিবিদরা যখন ক্ষমা চান তখন তার সঙ্গে যুক্ত হয় রাজধর্মের অনুষঙ্গ। ফরাসি দার্শনিক জাঁক দেরিদা'র মতে, ক্ষমা হতে হবে শর্তবিহীন। কিন্তু বর্তমান দুনিয়ায় শান্তিতে অনেক নোবেল বিজয়ীও শর্তহীন ক্ষমার পক্ষপাতী নন। দেরিদা তো ক্ষমা প্রার্থণায় কোনো মধ্যস্থতাকারীও রাখতে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, বিশেষ কোনো লক্ষ্য, যেমন, ক্ষতিপূরণ, সমন্বয়সাধন, ন্যায়প্রতিষ্ঠা, আত্মিক শান্তি — এগুলো কোনটি দিয়ে ক্ষমা বাস্তবায়ন করা যায় না। দক্ষিণ আফ্রিকায় যে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন' হয়েছিল, সেটির আপ্তবাক্য ছিল ‘উবুন্তু' শব্দটি,  যার অর্থ হলো মানুষে মানুষে পারস্পরিক বন্ধন।

যদিও গণমাধ্যম একা জবাবদিহিতার সংকট সমাধান করতে পারে না, তারপরও স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং একটি সুশিক্ষিত জনমত গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। গণমাধ্যম একটি গণতান্ত্রিক সমাজের প্রাণকেন্দ্র, যা রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা এবং ক্ষমা প্রার্থনার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ, গণমাধ্যম নির্দিষ্ট বিষয় বা ঘটনাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে জনসাধারণের কাছে সেগুলোর গুরুত্ব নির্ধারণ করে। এটি জনগণকে কী ভাবতে হবে, তা সরাসরি না বললেও, কী বিষয়ে ভাবতে হবে সে বিষয়ে প্রভাবিত করে। একটি বিষয় যত বেশি গণমাধ্যমের মনোযোগ পায়, জনসাধারণ সেটিকে তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং এর উপর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানায়। গণমাধ্যম রাজনৈতিক জ্ঞান, মনোভাব এবং আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে। গণমাধ্যমের কাভারেজ রাজনৈতিক দল ও নেতাদের উপর 'জন ও আইনি চাপ' তৈরি করতে পারে, যা তাদের ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে। যখন কোনো নেতা বা দল ভুল করে ক্ষমা চাইতে ব্যর্থ হয় বা তাদের ক্ষমা আন্তরিক মনে হয় না, তখন গণমাধ্যম সেই ব্যর্থতা বা আন্তরিকতার অভাবকে তুলে ধরে চাপ বজায় রাখতে পারে। গণমাধ্যম ক্ষমা প্রার্থনার উপাদানগুলো (যেমন, ক্ষতির স্বীকৃতি, দায়িত্ব গ্রহণ, অনুশোচনা, ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি না করার প্রতিশ্রুতি) বিশ্লেষণ করে এবং এই উপাদানগুলোর অনুপস্থিতি তুলে ধরে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোও কী এই ভূমিকা পালন করতে পারছে? উত্তরটা এক বাক্যে বলা যায়, আশাতীতভাবে না পারলেও এক সময় পর্যন্ত চেষ্টা ছিল। এখন সে চেষ্টাটাও নেই। এর বড় কারণ হলো বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থার ইউনিক চরিত্র। যেসব দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে সে দেশগুলোতে গণমাধ্যম একটি স্বাধীন ব্যবস্থা হিসেবে পরিচালিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মুখাপেক্ষী না হয়েও গণমাধ্যম একটি স্বাধীন ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। গত ৫ আগস্টের আগে মনে করা হতো, দলীয় লেজুড়বৃত্তি ও দলীয় লোকদের লাইসেন্সিং এবং তাদের দিয়ে গণমাধ্যম পরিচালনাই মূল সমস্যা। কিন্তু আগেও বহুবার বলেছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মতো এখানকার গণমাধ্যম ব্যবস্থা বড় ইউনিক। এমন ব্যবস্থা আপনি অন্য দেশে দেখতে পাবেন না। আওয়ামী লীগ সরকার এত এত টিভি চ্যানেল, পত্রিকা, অনলাইনের লাইসেন্স ও ডিক্লারেশন দিলো। অথচ ৫ আগস্টের পর সবাই একযোগে ‘আওয়ামী লীগবিরোধী' হয়ে গেল কেন? বাংলাদেশের গণমাধ্যম সংস্কারের জন্য যে কমিশন গঠিত হয়েছে তাদের ধারণা ক্রস-ওনারশিপ মডেলেই যত সমস্যা। এটাও বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থার মডেল বুঝতে না পারার ফল। ক্রস-ওনারশিপ যদি সমস্যা হয়, তাহলে বসুন্ধরা, হামিম গ্রুপসহ যত গ্রুপ আওয়ামী লীগ আমলে মিডিয়ার লাইসেন্স পেয়েছিল তারা তো আওয়ামী লীগের হয়ে কথা বলার কথা ছিল। একই ঘটনা ২০০১ সালের পরও হয়েছিল। ২০০১ সাল থেকে বিএনপিও বেশ কয়েকটি চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়েছিল। তারাও ২০০৭ সাল থেকে ‘বিএনপিবিরোধী' হয়ে গিয়েছিল। এর মূল সমস্যা হলো, বাংলাদেশে পার্টি প্রেস বা পার্টি গণমাধ্যমের ধারণা বিকশিত হয়নি। যেটি হয়েছে সেটি পলিটিক্যাল প্যারালিস্ট নয়; বরং সেটাকে বলা যায় পলিটিক্যাল ক্লায়েন্টেলিজম। এখানে মিডিয়াকে সব সময় সরকার তার ক্লায়েন্ট করে রাখতে পছন্দ করে। তাই দেখবেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কন্টেট সিলেকশনের ক্ষেত্রে একটা বড় নীতি হলো – মরা হাতিকে মারো, জিন্দা হাতিকে তেল মারো। পতিত যে কোনো রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি কিংবা সংগঠনের ওপর যেনতেনভাবে, কোনো ধরনের নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে, সরকার প্রেরিত কন্টেন্ট পরিবেশন করা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতির হাওয়া যেদিকে চলে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকও সেদিকে নৌকা নিয়ে নামে – আর গণমাধ্যমগুলো দুদককে অনুসরণ করে। এর সাথে সম্প্রতি যোগ হয়েছে সামাজিক মাধ্যমের হাওয়া। এটা হচ্ছে বৃহৎ পরিসরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কনটেন্ট রাজনীতি। বাংলাদেশের মতো আর একটি দেশ পাওয়া যাবে না যেখানে গণমাধ্যম ব্যবস্থায় একই সাথে পলিটিক্যাল প্যারালিজম এবং ক্লায়েন্টেলিজম একসাথে চলে। এজন্য বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থায় অন্য দেশের মডেল কাজ করে না। কারণ, এই দুটি যখন সমান্তরালে চলে, তখন পুরো গণমাধ্যম ব্যবস্থার রাজনৈতিক ইন্সট্রুমেন্টালাইজেশন ঘটে। সেটি বাংলাদেশে অতীতে বহুবার ঘটেছে, এমনকি বহু আশা নিয়ে আসা অধ্যাপক ইউনূস সরকারের আমলেও ঘটছে। রাজনৈতিকভাবে যদি গণমাধ্যমকে হাতিয়ার বানানোর প্রক্রিয়া অনেক শক্তিশালী হয়, তখন গণমাধ্যমের দোষ, ভুল – এগুলোকে অনেক বড় করে দেখা হয়। বাধ্য হয়ে তখন গণমাধ্যম হর্স রেস বা গেম ফ্রেম তত্ত্বে চলে যায়। নীতিগত বিষয়গুলো তখন তুচ্ছ হয়ে যায়। বিষয়টি গণমাধ্যমকে ধীরে ধীরে একটি দুষ্টচক্রের মধ্যে ফেলে দেয়। গণমাধ্যম যখনই সরকার কিংবা ক্ষমতাসীনদের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে চায়, তখন গণমাধ্যমের ভুলগুলোকে সামনে নিয়ে আসা হয়। যে গণমাধ্যম ক্ষমা প্রার্থণার জন্য অনুঘটক হয়ে কাজ করার কথা, তাদেরকেই তখন ক্ষমাপ্রার্থী হতে হয়। যার হওয়ার কথা ছিল চালক, সে হয়ে যাচ্ছে যাত্রী। এটাই সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপকভাবে ঘটছে। যেসব রাজনৈতিক নেতাদের গণমাধ্যম স্বাক্ষরতা শূন্যের চেয়ে নীচে, তারাই গণমাধ্যমকে জ্ঞান দিচ্ছেন। এটাকে রাষ্ট্র বহির্ভূত চাপ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এটিও পুরাতন মডেল, সরকারের অংশ হয়ে কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি নয় – এমনভাবে চাপ প্রয়োগ করা। পলিটিক্যাল ক্লায়েন্টেলিজম বজায় রেখে গণমাধ্যম কখনোই রাজনীতিতে আদর্শ ভূমিকা রাখতে পারে না। তাকে রাজনীতির ক্রীড়নক হয়েই থাকতে হয়।

রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা ও ক্ষমা প্রার্থনার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান 'জিরো-সাম' মানসিকতা এবং ভিন্নমতের প্রতি দমন-পীড়নের ইতিহাস এই পরিবর্তনকে আরো কঠিন করে তুলেছে। গণমাধ্যমের ভূমিকা কেবল তাৎক্ষণিক সংবাদ পরিবেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি জনমতকে ধারাবাহিকভাবে পুষ্ট করা, নাগরিকদের শিক্ষিত করা এবং সংস্কারের জন্য অবিরাম চাপ সৃষ্টি করার মাধ্যমে সমাজের প্রত্যাশা ও রাজনৈতিক আচরণকে ধীরে ধীরে পুনর্গঠিত করার একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা। এটি একটি ম্যারাথন, স্প্রিন্ট নয়।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ