ক্ষুধার্ত আফগানিস্তান, আংশিক দায় পশ্চিমা বিশ্বেরও
১৪ আগস্ট ২০২২জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলে গত বছরের শেষে আফগানিস্তানের পরিস্থিতিকে ‘বিশ্বের মধ্যে নারকীয়' বলে উল্লেখ করেন৷ ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে সে দেশে বোমা হামলা কিংবা গুলির ঘটনা কমেছে৷ তবে ব্রাসেলস-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের আশঙ্কা, তালেবান ক্ষমতায় আসার পর গত দুই দশকের যাবতীয় বোমা ও বুলেট হামলার চেয়ে আরো বেশি সংখ্যক আফগানের ক্ষুধার কষ্টে মৃত্যু হতে পারে৷
আফগানিস্তানে মানবিক সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন'-এর ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর নোরা হাসানিয়েন ডিাডব্লিউ-কে এই অসহায় পরিবারগুলির বিষয়ে জানান৷ তার কথায়, চরম পন্থা অবলম্বন করে বেঁচে থাকতে এই পরিবারগুলো৷ নিজেদের ক্ষতিও করছে৷ এর মধ্যে নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দেয়ার মতো ঘটনাও রয়েছে৷
নজিরবিহীন ক্ষুধা বিপর্যয়
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মতে, প্রায় ২ কোটি লোকের জরুরি খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন, যা গোটা দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক৷ কিন্তু সংস্থার কান্ট্রি ডিরেক্টর মেরি-এলেন ম্যাকগ্রোয়ার্টির মতে আফগানিস্তানের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ নেই৷ জুলাই মাসে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, কাকে কী খাবার দেয়া হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ব্যক্তির বর্তমান পুষ্টি পরিস্থিতি বা তাদের বিশেষ দুর্বলতার উপর ভিত্তি করে৷ ‘অত্যন্ত কঠিন এবং হৃদয়বিদারক' সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ার কথা বলেন ম্যাকগ্রোয়ারটি৷
স্বাস্থ্য খাতেও ধস নেমেছে আফগান মুলুকে৷ ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির (আইআরসি) জন্য কাজ করেন সামিরা সায়েদ রহমান৷ তিনি পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পাকতিয়ায় একটি হাসপাতালে যাওয়ার সময় যা দেখেছিলেন তা ডিডাব্লিউকে জানান৷ তার কথায়, ‘‘সেখানে পর্যাপ্ত ডাক্তার ছিল না, পর্যাপ্ত নার্স ছিল না৷ আমরা যে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের গত ছয় মাস ধরে বেতন দেওয়া হয়নি৷ ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা বেশিরভাগ নারী অপুষ্টির শিকার৷ নবজাতক ইউনিটে একটি ইনকিউবেটরে তিনটি শিশুকে রাখা হয়েছে৷''
দেশ নানা সংকটে
আফগানরা নানা সংকটের সঙ্গে লড়াই করছে৷ কয়েক দশকের যুদ্ধের কারণে এখানে পরিস্থিতি বিধ্বস্ত৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তিন বছর ধরে দেশের বড় অংশে খরা দেখা দিয়েছে৷ জুনের জুনের মাঝামাঝি বন্যা বা অমৌসুমি তুষারপাত হয়েছে কোনো কোনো জায়গায়৷ এ বছর দেশটিতে বড়সড় ভূমিকম্প হয়েছে৷ আইআরসি থেকে রহমানের মতে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, বিদেশ থেকে অর্থপ্রদান স্থগিত করা৷
২০ বছর ধরে, আফগানিস্তানের সামরিক, রাজনৈতিক এবং উন্নয়ন সহযোগিতায় ব্যাপকভাবে জড়িত ছিল পশ্চিমা বিশ্ব৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরকারি ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশ বহন করেছে৷ রাস্তা, স্কুল এবং হাসপাতাল নির্মাণ এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণের উন্নতি হয়েছে৷ কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার পর রাতারাতি টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়৷
রহমান বলেন, ‘‘সেখানে প্রায় চার লাখ লোক সরকারি খাতে নিযুক্ত ছিল, দুই লাখ লোক কাজ করতেন নিরাপত্তা খাতে৷ এই চাকরির অনেকগুলি আচমকা উধাও হয়ে গিয়েছে৷ বেকারত্ব আগের চেয়ে বেশি এবং মুদ্রাস্ফীতিও৷''
নিষেধাজ্ঞা বিশৃঙ্খলা বাড়াচ্ছে
তালেবানরা শান্তি আলোচনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার ছিল, কিন্তু যা প্রত্যাহার করা হয়৷ তারা যে সরকার গঠন করেছে তা বিচ্ছিন্ন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়৷ এতে টাকা আসার বিষয়গুলি থেমে গিয়েছে৷ ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞাগুলি কার্যকর করা হয়েছিল তা এখন তালেবানের নেতৃত্বাধীন সরকারি সিস্টেমকে প্রভাবিত করছে৷ ফলে সমগ্র দেশে তার প্রভাব পড়ছে৷
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরিচালক কেনেথ রথ লিখেছেন, একটি কার্যকরী ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছাড়া এই সাহায্যগুলি পাওয়া সম্ভব নয়৷
নিষেধাজ্ঞা দুই ধরনের আছে৷ জাতিসংঘ এবং ইইউ তালেবানের স্বতন্ত্র সদস্যদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে৷ যেমন, জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটিকে তার অফিসিয়াল পরিভাষায় ‘ডি-ফ্যাক্টো সরকার' বলে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯৯ সালে জারি করা এই নিষেধাজ্ঞা আরো জোরদার করে ২০০১ সালে৷ তারা তালেবানকে ‘বিশেষ ধরনের বৈশ্বিক সন্ত্রাসী সংগঠন'-এর তালিকাভুক্ত করেছে৷
বন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর কনফ্লিক্ট স্টাডিজের (বিআইসিসি) কনরাড শেটারের মতে, এই নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য আফগানিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া৷ দেশের সকল উন্নয়ন প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছে৷ অর্থনৈতিক ও আর্থিক বাজার থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে আফগানিস্তানকে৷''
বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক
মার্কিন প্রশাসনের সিদ্ধান্ত ছিল, আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় সাত বিলিয়ন ইউরোর (১ বিলিয়ন অর্থাৎ ১০০ কোটি টাকা) সম্পদ জব্দ করা এবং ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে সন্ত্রাসী হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে এর অর্ধেক টাকা আটকে রাখা৷ একতরফা জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপের বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টার আলেনা ডোহানের মতে, এটি আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ পদক্ষেপ৷ তার কথায়, ‘‘আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ সরকারের নয়, দেশের জন্য৷''
এর বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডার ছাড়া আফগান অর্থনীতিতে সীমিত ভূমিকা রাখতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷ নিষেধাজ্ঞা এবং বৈদেশিক মুদ্রার অভাব আফগানিস্তানে অর্থ স্থানান্তর প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছে৷
তত্ত্বগতভাবে, মানবিক উদ্দেশ্যে বিশেষ অনুমতি ব্যবহার করে অর্থ স্থানান্তর সম্ভব৷ তবে বাস্তবে তা কঠিন কাজ৷ এটি আফগানিস্তানের জন্য জার্মানির সাহায্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য৷ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিএমজেড)-এর একজন মুখপাত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অকার্যকর ব্যাঙ্কিং সেক্টরের কারণে অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টা আফগানিস্তানের জন্য আরো বেশি কঠিন৷ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ৷''
হাওয়ালা নেটওয়ার্কের উপর নির্ভরশীল
মানবতাবাদী গোষ্ঠীগুলিগুলোকে অবশ্যই অপ্রচলিত পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে৷ জার্মান সাহায্য সংস্থা ওয়েল্টহুঙ্গারলাইফের এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক এলকে গোটশচাল্ক ডয়চে ভেলেকে বলেন, হাওয়ালা নেটওয়ার্ক নামে পরিচিত বিকল্প চ্যানেলের মাধ্যমে কীভাবে অর্থ স্থানান্তর প্রক্রিয়া করা উচিত৷তৃতীয় দেশে হাওয়ালা ডিলার নামে পরিচিত ব্যক্তিদের অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর করা হয়৷ এই এজেন্ট তখন নিশ্চিত করেন কাবুলে নগদে এসেছে সেই টাকা৷ তখন তা গণনা করা হয়, তারপর ব্যবহার করা যেতে পারে৷
সামিরা সাঈদ রহমান নিশ্চিত করেছেন যে আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটিও হাওয়ালা পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল৷ তবে এটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি নয়৷ সামিরা মনে করেন, এই সংকট মানুষের তৈরি, এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৈরি৷ সেভ দ্য চিলড্রেন-এর নোরা হাসানিয়েন বলেন, কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ মানবিক সহায়তা এখানে এলেই সমস্যার সমাধান হবে না৷ বড়সড় সমাধান প্রয়োজন৷''
বিচ্ছিন্নতার অবসান
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপেরও এই মত৷ জুন মাসে, কাবুল সফরের পরে, এই থিঙ্ক ট্যাঙ্কের আফগানিস্তান বিশেষজ্ঞ গ্রায়েম স্মিথ লিখেছেন, ‘‘আরো গভীর বিপর্যয়ের প্রকোপ থেকে ফিরে আসতে হলে দেশের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটাতে হবে, উন্নয়ন সহায়তা আনতে হবে এবং পশ্চিমা ও আঞ্চলিক সরকারগুলিকে অর্থনৈতিক সহায়তায় রাজি করাতে হবে৷''
দ্বিধার জায়গাটা হল, এমন একটি সরকার যারা ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে–বিশেষ করে সংখ্যালঘু, মহিলা এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে, এমন একটি সরকারকে সাহায্য করা৷ জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির প্রশাসক আচিম স্টেইনার এ বিষয়ে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন৷ মে মাসে ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে তিনি বলেছিলেন, ‘‘নৈতিক ক্ষোভের নীতিতে চার কোটি আফগানকে এভাবে ত্যাগ করতে পারি না৷''
মাথিয়াস ফন হাইন/আরকেসি