1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আজও অভিজিৎ হত্যার চার্জশিট হয়নি

২১ এপ্রিল ২০১৮

তিন বছর ধরে অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের বিচারের অপেক্ষা করছেন তাঁর বাবা অজয় রায়৷ ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা শেষে জঙ্গিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন তিনি৷ এখনও অভিজিৎ হত্যার চার্জশিটও হয়নি৷.

Bangladesch Dhaka Universität Proteste
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/M. Asad

শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছেন অজয় রায়৷ স্বাস্থ্যের অবনতি তাঁকে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি রেখেছে৷ এ অবস্থাতেও তাঁর গলার স্বর ছিল দৃঢ়, ‘‘আমার প্রচণ্ড রাগ হয়৷ কষ্ট পাই৷ কিন্তু আমি এর পাশাপাশি একজন ধৈর্যশীল মানুষ যে কিনা এ ধরনের শোক সম্মানের সঙ্গে সামলাতে পারে৷''

কিছুক্ষণের জন্য থেমে আবার বলা শুরু করলেন, ‘‘কিন্তু কোনো কোনো সময় আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না৷ সবকিছুর পরওআমি তার বাবা; যখন তার ছবির দিকে তাকাই তখন নিজেকেই প্রশ্ন করি – কেন অভিজিৎ তুমি দেশে ফিরে এসেছিলে?''

ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অজয় রায় এভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন৷

অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এই শিক্ষক৷ মনেপ্রাণে তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তার রাষ্ট্র চান৷ আর তিনি মনে করেন, ধর্মের স্থান কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাসের পর্যায়ে৷

পেশাগত জীবনেও তিনি সবসময়ই বিজ্ঞানভিত্তিক মানবতাবাদী শিক্ষার পক্ষে কথা বলে এসেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘বিজ্ঞানের মাধ্যমে যা অর্জন করেছি, তার জন্য আমি গর্বিত৷ কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে৷ নাগরিক বা ব্যক্তি স্বাধীনতা বাংলাদেশে হারাতে শুরু করেছে এবং মুক্তচিন্তার পথ ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে৷''

পেশাগত জীবনে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পাওয়া শিক্ষক অজয় রায়ের নিহত সন্তান অভিজিৎ ছিলেন প্রকৌশলী৷ সিঙ্গাপুরে ডক্টরেট করার পর ২০০৭ সালে অ্যামেরিকায় গিয়েছিলেন৷ সেখানে তিনি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন৷

পাশাপাশি ‘মুক্তমনা' নামে একটি ব্লগও চালু করেন৷ বাবার মতো অভিজিৎও মানবতাবাদী এবং মুক্তচিন্তার পক্ষের লোক ছিলেন৷ ইসলামি মৌলবাদীদের কটাক্ষ করে অভিজিৎ-এর বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়, যার মধ্যে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস' অন্যতম৷

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভিজিৎ দেশে ফেরেন৷ ঢাকায় তখন একুশে বইমেলা চলছিল৷ ঢাকায় ফেরার ব্যাপারে বাবা অজয় রায় তাঁকে সাবধান করেছিলেন৷ কেননা, তখন ধর্ম নিয়ে সমালোচনাকারী বিভিন্ন ব্যক্তি, নাস্তিক, ভিন্নধর্মালম্বী এবং বিদেশিরা বাংলাদেশে ইসলামি উগ্রপন্থিদের আক্রমণের শিকার হচ্ছিলেন৷

অজয় রায় স্মৃতিচারণ করেন, ‘‘সাবধান করার পর অভিজিৎ জিজ্ঞাসা করেছিল: কেন মৌলবাদীরা আমাকে হত্যা করবে বাবা, আমি তো কেবলই একজন লেখক!''

থেমে, নিজেকে সামলে  অজয় রায় বলেন, ‘‘কী সরল আর নিষ্পাপ চিন্তা! আর এর জন্য তাকে কি মূল্যই না দিতে হলো!''

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সময় পুলিশ কাছেই ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে৷ কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ঘটনার কোনও বিচার হয়নি৷ ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ১০ জনেরও বেশি ব্লগার হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও বেশিরভাগেরই বিচার হয়নি৷

রাষ্ট্র কি এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিচারে শৈথিল্য দেখাচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবে অজয় রায় বলেন, ‘‘আমি এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিতে পারবো না৷ এ ঘটনার তদন্তে যাঁরা জড়িত, তাঁরা হয় অযোগ্য অথবা অক্ষম৷ অথবা তাঁদের সদিচ্ছা নেই৷ এর বেশি আমি আর কী বলতে পারি?''

এই পদার্থবিদ মনে করেন না যে বাংলাদেশ মোল্লাতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘খুনিরা মৌলবাদীদের হয়ে কাজ করছে৷ কিন্তু এরা খু্ব ছোট দল৷ দেশের বেশিরভাগ মানুষই মুক্তমনা ও সহনশীল সমাজের পক্ষে৷''

একটি পুরনো পারিবারিক অ্যালবাম দেখাতে দেখাতে গর্বিত এই পিতা বলেন, ‘‘অভিজিৎ ও তার ভাই ছোটবেলা থেকে বই গিলত, আর জটিল জটিল প্রশ্ন করত৷''

অভিজিৎ রায়কে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন বাবা আজয় রায়সহ অন্যান্যরাছবি: picture-alliance/dpa/A. Abdullah

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ রাজনৈতিক অব্যবস্থপনার শিকার৷ আমরা ব্লগার হত্যাকারীদের বিচারকরতে ব্যর্থ হয়েছি৷ এই ধারাবাহিকতা চললে এটি একটি নৈরাজ্যের দেশে পরিণত হবে৷''

অজয় রায়ের এই অভিযোগ অস্বীকার করে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেছেন, ‘‘ব্লগার হত্যাকারীদের শিগগিরই ধরা হবে৷'' তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ‘‘শিগগিরই এর বিচার দেখতে পাবেন৷'' অথচ অভিজিৎ-এর মামলার এখনো অভিযোগপত্রই দেওয়া হয়নি৷

বাংলাদেশ সরকারের জঙ্গিবাদের ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স' মনোভাব রয়েছে জানালেও এইচ টি ইমাম অন্য কয়েকজন মন্ত্রীর মতোই খুন হয়ে যাওয়ার জন্য ব্লগারদেরও দায় আছে বলে মনে করেন৷

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ একটি ইসলামি মনোভাবাপন্ন দেশ৷ কিছু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা অত্যন্ত ধর্মভীরু৷ তাই যখন আপনি কোরআনের মতো পবিত্র গ্রন্থের অপব্যাখ্যা দেবেন এবং মহানবীকে নিয়ে কটাক্ষ করবেন, কিছু মানুষ কষ্ট পাবেন৷ এভাবেই ব্লগাররা নিজেদেরকে তাদের শত্রুতে পরিণত করেছে৷''

তিনি মনে করেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে অন্যের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা নয়৷

তবে তিনিও বাংলাদেশকে অজয় রায়ের মতো ‘সেকুলার' বলে উল্লেখ করে এই চেতনা বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে কথা বলেন৷

তিনি বলেন, ‘‘ব্লগার এবং তাদের যারা হত্যা করেছে, তারা দু'দলই সেকুলারিজমের শত্রু৷ কেননা, দু'পক্ষই চরমপন্থি৷ আমাদের এ দু'পক্ষকেই মূলধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে৷ এটাই রাজনীতির মূল কাজ৷''

পুরানো ঢাকার লালবাগ মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসার ছাদে ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মুফতি ফায়েজুল্লাহ ব্লগার ও ধর্মীয় সমালোচনাকারীদের হত্যার ব্যাপারে ইসলামের অনুসারী কারও সংযুক্ত থাকার ব্যাপারটি সরাসরি নাকচ করে দেন৷

তিনি বলেন, ‘‘প্রকৃত ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম হলে এরকম কোনো হত্যাকাণ্ড হবে না৷ ফায়জুল্লাহ মনে করেন, ইসলামের সুনাম ক্ষুণ্ণের জন্য এটি একটি ষড়যন্ত্রের অংশ৷

ইসলামপন্থিদের মধ্যে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠা ফায়েজুল্লাহ বলেন, ‘‘মুসলিমদের জন্য আল্লাহ এবং প্রিয় নবী খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ এসব বিষয়ে কিছু বলা হলে তারা মনে খুব কষ্ট পান৷''

ইসলামের নামে কোনো ধরনের নৈরাজ্য সমর্থন করেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘কিন্তু আমরা আল্লাহ ও নবী অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইন চাই এবং ইসলামের শত্রুদের শাস্তি দেখতে চাই৷''

২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী হজ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করলে ইসলামপন্থিরা দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করে৷ ফায়েজুল্লাহ সেই আন্দোলনে সামনের সারির নেতা ছিলেন৷ পরে লতিফ সিদ্দিকী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন৷

আইনজীবী সারা হোসেন নিবিড়ভাবে বর্তমান প্রেক্ষাপটের দিকে নজর রেখেছেন৷ তাঁর বাবা ড. কামাল হোসেন মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন৷ তাঁর নেতৃত্বে তৈরি বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল৷ সারা হোসেন বলেন, ‘‘সহনশীলতার পরিবেশকে মেনে নেওয়ার ব্যাপারে বর্তমানে কেবল যে অসহিষ্ণুতার অভিজ্ঞতাই হচ্ছে তা নয়, বরং আমার মনে হচ্ছে আমরা আসলে একে আঁকড়ে ধরেছি৷''

তিনি মনে করেন, রাজনীতি এখন আর সেকুলারিজমের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে না৷ বরং সেকুলার সংবিধানের মুখবন্ধটুকুই কেবল অবশিষ্ট রয়েছে৷

তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখন আর বিশ্বাস করি না যে প্রত্যেকের কিছু অধিকার রয়েছে৷ মুক্তভাবে বাঁচার এবং মুক্তচিন্তা করার অধিকার রয়েছে৷''

২০১৬ সালে বাংলাদেশের কূটনীতিক পাড়ার একটি রেস্তোরাঁয় হামলা চালিয়ে ইসলামপন্থিরা বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করেছিল, যা পুরো পৃথিবীর টনক নাড়িয়ে দিয়েছিল৷

সারা হোসেন বলেন, ‘‘যেটা পুরো পৃথিবী খুব কম লক্ষ্য করেছে, সেটা হলো স্বাধীনতার মূল চেতনা থেকে একটি ছোট বিচ্যুতি৷''

অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইসলামি গোষ্ঠীর নানা ধরনের দাবি রয়েছে উল্লেখ করে সারা হোসেন উদাহরণ হিসেবে হাই কোর্টের সামনে থেকে ‘লেডি জাস্টিস' অপসারণের উদাহরণ টানেন৷ ‘অপসংস্কৃতি ও মূর্তিপূজার' কথা বলে মুফতি ফায়েজুল্লাহর নেতৃ্ত্বে সেই আন্দোলনের এক পর্যায়ে সরকার সেটাকে অপসারণ করে৷

সারা হোসেন আগুন নিয়ে খেলা করার সাথে তুলনা করে বলেন, ‘‘ধীরে ধীরে হওয়া এ পরিবর্তন খালি চোখে ধরা পড়ে না৷ কিন্তু এটি আপনার চিন্তার জগৎকে পরিবর্তন করে৷ জীবনযাপনকে পরিবর্তন করে এবং আরো অনেক কিছুকেই পরিবর্তন করে৷''

সান্ড্রা পেটার্সমান/এইচআই

পাঠক, ব্লগার হত্যার বিচার নিয়ে আপনাদের ভাবনা আমাদের জানান নীচের ঘরে৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

বাংলাদেশ