ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে চরমপন্থা
১৪ নভেম্বর ২০১৯সাহারা মরুভূমির এক প্রান্তে অবস্থিত বুরকিনা ফাসোর সাহেল অঞ্চল৷ ২০১০ সালে ব্যক্তিগত রেডিও ডিভাইস ব্যবহার করে ইব্রাহিম ‘মালাম' ডিকো নামের এক ধর্মপ্রচারক নিজের বক্তব্য প্রচার করতে শুরু করেন সাহেলের মানুষের কাছে৷ সরকার এবং পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দেন তিনি৷ ফলে মানুষের কাছে তার বক্তব্য ধীরে ধীরে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে৷
প্রতিবেশী দেশ মালির সীমান্তে অবস্থিত জিবো শহরে এক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন ৩২ বছর বয়সি আদামা কোনে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা তাকে উৎসাহ দিতাম৷ তিনি আমাদের ক্ষোভ বুঝতে পারতেন৷ তার বক্তব্য তরুণদের আস্থা যোগাতো৷''
সাহেল অঞ্চলের ফুলানি আদিবাসীদের বেশিরভাগেরই মূল পেশা পশুপালন৷ অবস্থাসম্পন্ন কৃষকদের তুলনায় তাদের অবস্থা অনেকটাই শোচনীয়৷ ফুলানিদের ধারণা, রাজধানী ওয়াগাডোগোর সরকার শুধু ধনীদের কথাই ভাবে৷ জনগণের এই হতাশা কাজে লাগিয়ে জিহাদ শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন ডিকো নামের এই ধর্মপ্রচারক৷
তার এই জিহাদের ঘোষণার পথ ধরে অঞ্চলটিতে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসেছে আল-কায়দা ও ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গি গোষ্ঠী৷
ডিকো'র প্রথম রেডিও ভাষণের পর থেকে বুরকিনা ফাসো ধীরে ধীরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে৷ একটু স্কুল বন্ধ করে দেয়া, গির্জায় হামলা চালানোসহ নানা জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়েছে গোষ্ঠীগুলো৷
ক্যানাডিয়ান খনি কর্মকর্তাদের বহনকারী গাড়িতে অক্টোবরে হামলা চালানো হয়৷ এই হামলায় অন্তত ৩৯ জন মারা যান৷ এখনও কেউ হামলার দায় স্বীকার না করলেও হামলার ধরন দেখে ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকেই অভিযুক্ত করা হচ্ছে৷
২০১৬ সাল থেকে চলা সশস্ত্র জঙ্গি কার্যক্রমে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, গৃহহীন হয়েছেন পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ৷ শুধু গত মাসেই জিহাদিদের সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭৫৫ জন৷
শুরুর দিকে ইব্রাহিম ডিকোর ভক্ত হলেও এখন কোনের মতো অনেকেই বুঝতে পারছেন ঘটনা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা তাকে মসজিদে মাইক্রোফোন হাতে তুলে দিতাম, তিনি বক্তব্য দিতেন৷ পরে যখন আমরা বুঝতে শুরু করলাম তার আসল পরিকল্পনা কী, ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে৷''
দুই বছর আগে জিহাদিরা তার স্কুলে আক্রমণ করার পর রাজধানী ওয়াগাডোগোতে পালিয়ে যান কোনে৷ ইউনিসেফ বলছে, নিরাপত্তাজনিত কারণে বুরকিনা ফাসোর অন্তত দুই হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে৷
১৯৮০ এর দশকে সৌদি আরবে পড়াশোনা করেন ডিকো৷ জিহাদের পক্ষে প্রচারণা শুরু করেন ২০১০ সালে৷ ধীরে ধীরে জনমত গড়ে তুলে আনসারুল ইসলাম নামে দল গড়ে তুলেন৷ বুরকিনা ফাসোর বাইরে, বিশেষ করে প্রতিবেশী মালি থেকে জঙ্গি গোষ্ঠী আস্তানা গাড়তে থাকে দেশটিতে৷
সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মালিতে ঢোকার সময় একবার ফরাসি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারও হন ডিকো৷ তবে ২০১৫ সালে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়৷ এরপর তিনি সীমান্তে নিজের সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলেন৷ রেডিও ব্যবহার করে তরুণদের আহ্বান জানান ‘রক্ত দিয়ে হলেও' তাকে সমর্থন করার জন্য৷
দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ব্লাইসে কম্পাওরে ক্ষমতায় থাকার সময় মালির ইসলামপন্থিদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন৷ কিন্তু ২০১৪ সালে দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে নিজের ২৭-বছরের ক্ষমতা আরো বাড়ানোর চেষ্টা করলে অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি৷
এরপর থেকে বুরকিনা ফাসোতে জঙ্গিগোষ্ঠীর কার্যক্রম আরো বেড়ে যায়৷ নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আসার দুই সপ্তাহের মধ্যে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে স্পেলনডিড হোটেলে বোমা হামলায় ৩০ জন প্রাণ হারান৷ উত্তর মালিতে আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট একটি সংগঠন এর দায় স্বীকার করে৷
ডিকো এরপর থেকে আরো বেশি উগ্রপন্থি হয়ে ওঠেন৷ তার কর্মকাণ্ডে সমর্থন না করায় সহযোগীদের সঙ্গেও তার মতবিরোধ দেখা দেয়৷ এমনকি মালি থেকে একে-৪৭ এবং গ্রেনেড নিয়ে আসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে রাজি না হওয়ায় নিজের ডান হাত বলে পরিচিত বোলিকেও হুমকি দেন ডিকো৷ দুই সপ্তাহ পর বোলি বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন৷
এরপর থেকে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকে৷ সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষকদের হত্যা করা হয়, নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালানো হয়৷
ডিকোর কাজে শুরু থেকে সহায়তা করা অন্যান্য তরুণের মতো শিক্ষক কোনেকেও আহ্বান জানানো হয় জঙ্গিদের সহায়তা করতে৷ কোনে তা প্রত্যাখ্যান করেন৷ ২০১৭ সালের মে মাসে একদিন স্কুলে যেতে দেরি হয় তার৷ এক সহকর্মী ফোনো জানান একদল বন্দুকধারী তার খোঁজে স্কুলে এসেছিল৷ সেই মুহূর্তেই সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রাজধানী ওয়াগাডোগোতে পালিয়ে যান কোনে৷ এরপর আর কখনও ফিরে যাননি তিনি৷
এডিকে/কেএম (রয়টার্স)