বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কয়লার ব্যবহার থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে৷ এক্ষেত্রে দেশগুলো বিভিন্ন কৌশল ও সময়সীমা অনুসরণ করছে৷
বিজ্ঞাপন
সৌর ও বায়ুশক্তির মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে ভারতের অনেক বড় লক্ষ্য রয়েছে৷ ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বনমুক্ত হতে সরকার অনেক বিনিয়োগ করছে৷ কিন্তু বিষয়টি কঠিন, কারণ কয়লাখাতে অনেক মানুষ চাকরি করছেন৷ চাহিদা মেটাতে ভারত এখনও বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করছে৷ বিশ্লেষকরা আশা করছেন, ভবিষ্যতে আমদানি কমবে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ উৎপাদন চলতে থাকবে৷
টেকসই এনার্জি ট্রানজিশন বিশেষজ্ঞ পাও-ইয়ু-ওই বলছেন, কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্গমন ধরে মাটির নীচে জমা করছে ভারত৷ ‘‘আমি মনে করি না, এটা বাস্তবসম্মত৷ কারণ, আমরা দেখছি, ফটোভল্টেয়েক বিদ্যুৎকেন্দ্র, নবায়নযোগ্য জ্বালানি আসলে, কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে সস্তার হতে পারে,'' বলেন তিনি৷
নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা
04:27
ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় কয়লা রপ্তানিকারক৷ তারপরও দেশটি তার ১৭ হাজারের বেশি দ্বীপকে ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিউট্রাল করতে চায়৷ কিন্তু দেশটির নীতি পরস্পরবিরোধী৷ ‘‘তারা বলছে, তারা হয়ত কয়লার ব্যবহার বন্ধ করবে, কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলোতে কয়লা রপ্তানি করবে৷ সেক্ষেত্রে কার্বন নিগর্মনের দায়টা সেই সব দেশের উপর বর্তাবে৷ ইন্দোনেশিয়ায় জিওথার্মাল এনার্জি ও ফটোভল্টেয়েকের অনেক সম্ভাবনা আছে৷ কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা এসবের খুব বেশি বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছি না- এমনকি ফটোভল্টেয়েকের ক্ষেত্রেও, কারণ বাজারে প্রবেশের সম্ভাবনা সীমিত,’’ বলেন পাও-ইয়ু-ওই৷
যুক্তরাষ্ট্রও কয়লার ব্যবহার বন্ধের পরিকল্পনা করছে৷ ২০৩৬ সালের মধ্যে সব কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে চায় দেশটি৷ কিন্তু কিছু রাজ্য কর্তৃপক্ষ এর বিরোধিতা করছে, কারণ এই খাতে অনেক মানুষ কাজ করছেন৷ তবে এটি এখন ভালোভাবেই প্রমাণিত যে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিও এখন একটি লাভজনক উৎস, এবং এটি বাড়ছে৷ পাও-ইয়ু-ওই বলেন, ‘‘টেক্সাসের মতো কিছু রাজ্যের কথা ভাবলে মনে হবে যেন, তারা জীবাশ্ম জ্বালানি পছন্দ করে৷ তবে এমন অনেক কোম্পানিও আছে যারা বুঝতে পেরেছে যে, বায়ুশক্তি, ফটোভল্টেয়েক ইত্যাদি করেও লাভবান হওয়া সম্ভব, কেননা টেক্সাসে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো আছে, অনেক বাতাস আছে৷ এছাড়া এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে আপনি কী বানাবেন, তা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার মতো অনেক মানুষ নেই৷’’
সৌরশক্তির বিস্তার: মিনিগ্রিড থেকে সোলার সিটি
সৌরশক্তি এখন বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা জ্বালানি উৎস৷ বিভিন্ন উপায়ে তাই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন কমিউনিটি, এমনকি বড় শহরগুলোও সূর্য থেকে শক্তি উৎপাদন করছে৷
ছবি: ME SOLshare Ltd.
সূর্য থেকে পানীয় জল
ইথিওপিয়ার রিমা গ্রামে পানির ট্যাংক ভর্তি করতে সোলার পাম্প ব্যবহার করা হচ্ছে৷ বিশুদ্ধ খাবার পানির কুয়াটি গ্রাম থেকে বেশ দূরে৷ সোলার পাম্প ব্যবহার করে সেই কুয়া থেকে গ্রাম অবধি পাইপের মাধ্যমে পানি আনা হয়৷ আগে ডিজেল পাম্প ব্যবহার করে এই কাজটি করা হতো৷ কিন্তু তখন প্রায়শই পাম্পটি নষ্ট হতো, কিংবা জ্বালানির অভাবে চালানো যেতো না৷ ২০১৬ সালে সোলার পাম্প চালুর পর থেকে আর কোনো ঝামেলা হচ্ছে না৷
ছবি: Stiftung Solarenergie
পাওয়ার গ্রিড ছাড়াই মোবাইল চার্জ করার ব্যবস্থা
পূর্ব আফ্রিকার অধিকাংশ প্রত্যন্ত অঞ্চল বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বা পাওয়ার গ্রিড-এর বাইরে৷ সেখানে মোবাইল চার্জ দিতে সোলার কিয়স্ক ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷ কেনিয়ার অলকিরামেশন গ্রামের এই সোলার কিয়স্কে সামান্য টাকার বিনিময়ে মোবাইল চার্জ দেয়া যায়৷
ছবি: Solarkiosk GmbH
কৃষকদের জন্য বিদ্যুৎ
নিকারাগুয়ার উত্তরের গ্রাম মিরাফ্লোরের বাসিন্দারা মুলত কফি চাষ এবং চিরাচরিত কৃষি কাজ করেন৷ ২০১৩ সাল অবধি এই গ্রামে কোনো বিদ্যুৎ ছিল না৷ এরপর সেখানে সোলার প্যানেল বসানো শুরু হয়৷ বর্তমানে গ্রামটির ছয়শ’র বেশি পরিবার সৌরশক্তি ব্যবহার করছে৷
ছবি: Stefan Jankowiak
পয়সা বাঁচাচ্ছে সৌরশক্তি
জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলের ফ্রাইবুর্গ শহরের এই হাউজিং প্রকল্পে চাহিদার চেয়ে বেশি সৌরশক্তি উৎপাদিত হচ্ছে৷ বিশ বছর আগে তৈরি এই ভবনগুলো এখন শহর উন্নয়নের মডেলে পরিণত হয়েছে৷ আধুনিক এসব ভবনে পুরনো ভবনের তুলনায় বিদ্যুৎ খরচ কম হয়৷ ফলে পরিবেশরক্ষার পাশাপাশি বাসিন্দাদের পয়সাও সাশ্রয় হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Haid
মাইক্রো-গ্রিডের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ
সোলশেয়ার নামে একটি স্টার্টআপ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাইক্রোগ্রিডের মাধ্যমে সস্তা এবং বিশুদ্ধ বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে৷ যেসব বাড়িতে সোলার প্যানেল রয়েছে, তারা তাদের প্রতিবেশি যাদের এখনো প্যানেল নেই তাদের সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ শেয়ার করছে৷ এই ব্যবস্থায় সৌরশক্তি ব্যবহারকারীরা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে অন্যদের বিদ্যুৎ দিচ্ছে, যা তাদের জন্য বাড়তি আয়ের এক উৎসও৷ দেশটিতে ডিজেলের বিকল্প হয়ে উঠছে সৌরশক্তি৷
ছবি: ME SOLshare Ltd.
কোভিড মোকাবিলায় সৌরশক্তি
হাইতির তাবার-এ অবস্থিত এই হাসপাতালটির জ্বালানির উৎস ছাদে বসানো সোলার প্যানেল৷ ৭১০ কিলোওয়াটের এই প্যানেলটি দেশটিতে বসানো এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্যানেল৷ করোনা রোগীদের এই হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়৷ এখনকার সব চিকিৎসা সরঞ্জাম সৌরবিদ্যুতে চলে৷ আর এই ব্যবস্থা ব্যবহার করায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বছরে পঞ্চাশ হাজার ইউরোর মতো সাশ্রয় হচ্ছে, কেননা, তাদের আর ডিজেল কিনতে হচ্ছে না৷
ছবি: Biohaus-Stiftung.org
পুরো গ্রামের জন্য মিনিগ্রিড
কেনিয়ার তালেক গ্রামে দেড় হাজারের মতো বাসিন্দা রয়েছেন৷ গ্রামটি ২০১৫ সাল থেকে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছে৷ তালেক-এর এক কোণায় একটি ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার ফিল্ড তৈরি করা হয়েছে৷ সেটির মাধ্যমে তিনশ’ মানুষের জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়৷
ছবি: Imago Images/photothek/T. Imo
সৌরশক্তি ছাড়া পানি মিলবে না
মিশরের মরুভূমিতে পানি পাওয়া দুর্লভ ব্যাপার৷ আর এ কারণেই ইল-ওয়াহাট ইল-বাহারিয়া ওয়াসিস-এ এই সোলার প্ল্যান্টটি স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য খুবই প্রয়োজন৷ এই প্ল্যান্টটি দিয়ে ওয়াটার পাম্প চালু করা হয়, যেটি ছাড়া কৃষি কাজ অসম্ভব৷ মরুভূমির অন্য সব স্থানের মতো এখানেও অবশ্য সোলার প্যানেলটির উপর দিয়ে নিয়মিত বালু সরাতে হয়৷
ছবি: Joerg Boethling/imago images
২০২৫ সালের মধ্যে ‘ক্লাইমেট নিউট্রাল’
ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন ২০২৫ সালের মধ্যে ‘ক্লাইমেট নিউট্রাল’ হতে চায়৷ আর এ কারণেই শহরটিতে পুর্নব্যবহারের উপযোগী জ্বালানির ব্যবহার ক্রমশ বাড়ানো হচ্ছে৷
ছবি: picture alliance / Zoonar
আইডিয়া আদানপ্রদান
জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলের শহর সারবেক-এর বাসিন্দার সংখ্যা ৭,২০০৷ শহরটিতে সৌর, বায়ু এবং বায়োমাস ব্যবস্থায় প্রয়োজনের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়৷ ছোট কমিউনিটির জন্য পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উৎপাদনের এক মডেলে পরিণত হয়েছে শহরটি৷ ছবিতে মার্কিন একদল প্রতিনিধিকে দেখা যাচ্ছে যারা শহরটির এই মডেল সম্পর্কে জানতে এসেছেন৷
ছবি: Gemeinde Saerbeck/Ulrich Gunka
10 ছবি1 | 10
জার্মানিও আগামী ১৫ বছরের মধ্যে কয়লা থেকে বের হইতে চাইছে৷ দেশটিতে এখনও কয়লার প্রয়োজন আছে৷ কারণ এখনও ৪০ শতাংশ বিদ্যুতের জন্য জার্মানি কয়লার উপর নির্ভরশীল৷ দেশটি দ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চলে যেতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে৷ টেকসই এনার্জি ট্রানজিশন বিশেষজ্ঞ পাও-ইয়ু-ওই বলেন, ‘‘মানসম্মত পদ্ধতি বের করা, পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগের কথা ভাবা, মানুষের ভালোমন্দ বিষয়ে যত্নশীল হওয়া, অর্থাৎ গ্রামের খুব কাছে স্থাপনা নির্মাণ না করা, পশুপাখির যত্ন নেওয়া এবং শুধু সাগরের বুকে নয়, উপকূলীয় এলাকাতেও বায়ু শক্তি উৎপাদনের সম্ভাবনা কাজে লাগানো- ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি৷’’
বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্বন নির্গমনকারী দেশ চীন৷ গত কয়েক দশকে দেশটির অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্ভব করতে বিশাল পরিমাণ কয়লার ব্যবহার ভূমিকা রেখেছে৷ কিন্তু দেশটিতে এখন আর কয়লার ব্যবহার বাড়ছে না৷ কারণ চীন বুঝতে পেরেছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিও লাভজনক হতে পারে এবং সে কারণে দেশটি এখন এই খাতে বিশ্বের অন্যতম বড় শক্তি৷ ‘‘তারা ২০৬০ সালের মধ্যে পুরো দেশকে কার্বন নিউট্রাল করতে চাইছে৷ আমার মতে, এটি একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা৷ তবে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চীন দেখিয়েছে যে, যদি তারা কিছু চায়, তাহলে এ ধরনের লক্ষ্য অর্জন করতে তারা সক্ষম,’’ বলেন পাও-ইয়ু-ওই৷
সাউথ আফ্রিকা এখনও কয়লা দিয়ে প্রায় ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপন্ন করছে৷ তবে এতে পরিবর্তন আসছে৷ সাত বছর আগে সে দেশের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় কয়লা থেকে সরে আসার পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ তবে এটি বাস্তবায়নে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রায় ৫৫০ বিলিয়ন ইউরো খরচ হবে বলে বিশ্বব্যাংক মনে করছে৷ তাই বিনিয়োগ অংশীদার বা দাতাদের সহায়তা ছাড়া এই পরিকল্পনা সফল হবে না৷