জার্মানির একটি কয়লা খনি শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যাবে৷ তবে বিপত্তি বেধেছে সেখানকার পানীয় জল নিয়ে৷ সুপেয় পানি পাওয়ার স্বার্থে খনির পাম্পগুলো চালু রাখতে হবে৷ কতদিন? সম্ভবত অনন্তকাল৷
বিজ্ঞাপন
সুপেয় পানির স্বার্থে বন্ধ খনি চালু
04:54
জার্মানির আর মাত্র চারটি খনি চালু আছে৷ শওনা যাচ্ছে, আগামী চার বছরের মধ্যে এসেন শহরের কাছের খনিটিও বন্ধ হয়ে যাবে৷ তবে রুয়র অঞ্চলে ৬০ মিলিয়ন টনের মতো কয়লা আছে৷
সমস্যা হচ্ছে গত কয়েক দশক ধরে কয়লা উৎপাদনে ভরতুকি দিয়েছে সরকার৷ কিন্তু এখন খনি আর লাভজনক নয়৷ তার চেয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা, রাশিয়া – এমনকি অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আমদানি করলে খরচ কম হয়৷
খনি বন্ধের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা
খনি বা টানেল বন্ধের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হচ্ছে পানির অন্তঃপ্রবাহ৷ এসেনের খনিটির মধ্যে থাকা কয়েক হাজার পাম্প টানেলের মধ্যে বন্যা রোধ করে৷ এগুলো কয়েকশত কিলোমিটার লম্বা৷ কারণ ভূ-পৃষ্ঠের নীচে পাথরের ফাটলে পানি জমতে থাকে৷ খনিটির কর্মকর্তা ইওয়াখিম বক এই বিষয়ে বলেন, ‘‘আমাদের চারপাশে পানি রয়েছে৷ আর পাম্পগুলো সুড়ঙ্গ শুষ্ক রাখে৷ প্রক্রিয়াজাত পানিও আমরা বের করে ফেলি৷ আমরা যদি এই প্রক্রিয়া বন্ধ করি, তাহলে সব পানি আবারও ফিরে আসবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এখানকার পানি লবণাক্ত৷ কারণ শিলাগুলো প্রাচীন এক সমুদ্র থেকে সৃষ্টি হয়েছে৷ এতে লবণ রয়েছে৷ আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে এমন পানি যেনো আমাদের ভূগর্ভস্থ পানীয় জলের আধারে পৌঁছাতে না পারে৷''
গার্জভাইলারের উন্মুক্ত কয়লা খনি
জার্মানিতে জ্বালানি কোম্পানিগুলোর আগ্রাসনের কারণে রাইনের নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দাদের বাড়ি ছাড়তে হয়েছে৷ গত বছর সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের ফলে পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে বটে৷ তবে অনেকেই মনে করেন এটা ‘যথেষ্ট নয়’৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অধিকার রক্ষায় সক্রিয় সুপ্রিম কোর্ট
গার্জভাইলারের লিগনাইট খনি নিয়ে মামলা চলেছিল কয়েক বছল ধরে৷ গত বছর জার্মানির কার্লসরুয়েতে অবস্থিত সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, কয়লা খনিতে কাজ করার ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা অবশ্যই অভিযোগ দাখিলের সুযোগ পাবেন এবং তাঁদের সঙ্গে আগেভাগেই পুর্নবাসনের ফয়সালা চূড়ান্ত করতে হবে৷ আদালত অবশ্য একইসঙ্গে কয়লা খনির কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ারও অনুমতি দিয়েছে৷
ছবি: DW/S. Dege
যেভাবে সংগ্রহ করা হয় কয়লা
রাইন অঞ্চলে একটু মাটি খুড়লেই পাওয়া যায় লিগনাইট বা ব্রাউন কয়লা৷ উদ্ভিদ অঙ্গারে পরিণত হওয়ার আগের অবস্থাকে বলা হয় ‘লিগনাইট’৷ এই নরম, বাদামি, কালচে রঙের কয়লা এক ধরনের বিশালাকৃতির খননযন্ত্র ব্যবহার সংগ্রহ করা হয়৷ বিশেষ বেল্ট ব্যবহার করে কয়লার বড় বড় টুকরাগুলো একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখা গুদামে নিয়ে যাওয়া হয়৷ তারপর সেগুলো পুড়িয়ে তৈরি হয় বিদ্যুৎ৷
ছবি: Reuters
শ্রমিকের বদলে যন্ত্র
জার্মানির এই কয়লা খনিতে শ্রমিকের সংখ্যা কম৷ কয়লা তোলার মূল কাজটা করে এ রকম বিশাল আকারের যন্ত্রগুলো৷ আর সেগুলো চালাতে প্রয়োজন হয় মাত্র অল্প কয়েকজন কর্মীর৷
ছবি: pommes.fritz123/flickr cc-by-sa 2.0
পরিবেশ হত্যাকারী
গার্জভাইলার খনির পরিধি ১১৪ বর্গ কিলোমিটার৷ ফ্রিমার্সডর্ফ পাওয়ার প্লান্টের সঙ্গে অবস্থিত খনিটি ইউরোপের দশটি ‘পরিবেশ হত্যাকারী’, মানে ভীষণমাত্রায় পরিবেশ দূষণকারী খনির একটি৷ লিগনাইট কয়লা অন্য যে কোনো জ্বালানি উৎসের চেয়ে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন করে৷ এরপরও অবশ্য জার্মানির একটি বড় অংশ এ ধরনের কয়লার উপর নির্ভরশীল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নিষ্ফল প্রতিবাদ
উন্মুক্ত এই কয়লাখনি এমন একটি জায়গায় প্রতিষ্ঠা হয়েছে, যেখানে একসময় জনবসতি ছিল৷ তাই শুরুর দিকে এ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে অনেক৷ ‘ফ্রেন্ডস অফ দ্য আর্থ’ নামের পরিবেশ বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার (সংক্ষেপে ‘বুন্ড’) শাখা রয়েছে জার্মানিতেও৷ তাদের তৈরি একটি তাঁবুর ছবি এটি৷ জার্মানিতে এভাবে প্রতিবাদ জানানোর পরও কোনো কাজ হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ভুতুড়ে শহর
কয়লা খনির আগ্রাসনের শিকার যে গ্রামগুলো, সেগুলো ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়৷ এরকেলেঞ্জ শহরের প্রত্যন্ত জেলা বোর্শেমিখের কথাই ধরুন৷ যাঁরা এখানে থেকে যেতে চান, তাঁদের ওপর মানসিক চাপ বাড়তে থাকে৷ ফলে একসময় সবই চলে যান নিজের আবাস ছেড়ে৷ তাঁদের জন্য বিকল্প বাড়ির ব্যবস্থা করা হয় ঠিকই, কিন্তু নিজের ঘর ছাড়ার ব্যথা তাতে কি কমে?
ছবি: DW/K. Jäger
সবুজ চারণভূমি?
ইমেরাথ গ্রামটি গড়ে উঠেছিল সেই ১২ শতকে৷ কিন্তু ৮২৬তম জন্মদিনে এসে গ্রামটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়৷ সেখানকার ৪০০ বাসিন্দাকে সরিয়ে আনা হয় ‘নিউ ইমেরাথে’৷ ছবিটি সেখানকারই সবুজ চারণভূমির৷
ছবি: DW/K. Jäger
নির্যাতিত ল্যান্ডস্কেপ
বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়লা উত্তোলনের এই আকাঙ্খা শুধু মানুষকেই তাঁদের নিজ বাসভূমি থেকে সরিয়ে দিচ্ছে না, তাদের অধিগ্রহণকৃত এলাকাতে অন্য কোনো জীবও টিকতে পারছে না৷ জার্মানির নর্থ রাইন ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্যের অন্যতম বড় জঙ্গলটি একসময় এখানে ছিল৷ অথচ আজ এই দৃশ্য৷ এখানে আবারো বনায়ন করা হবে, জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ৷ কিন্তু তাতে যে লেগে যাবে কয়েক দশক৷
ছবি: DW/T. Thor
এনার্জি জায়ান্ট
জানা গেছে, ২০২২ সাল নাগাদ পারামাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরে আসবে জার্মানি৷ আর তারপর ২০৫০ সাল নাগাদ দেশটির ৮০ শতাংশ বিদ্যুতের উৎস হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি৷ তবে বর্তমানের প্রচলিত জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম সে’সময় পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
খনির পাম্পগুলো পানির স্তর নীচে রাখে৷ এগুলো বন্ধ হলে ২০ বছরের মধ্যে সেখানে বড় লেক তৈরি হবে৷ তবে পাম্পগুলো চালু রাখতে কোটি কোটি ইউরো প্রয়োজন৷ কিন্তু কে সেই টাকা দেবে? জার্মানির সাবেক অর্থমন্ত্রী ও জার্মানির বৃহত্তম খনি কোম্পানির প্রধান ভ্যার্নার ম্যুলার-এর উদ্যোগে একটি ফাউন্ডেশন গড়ে তোলা হয়৷ রুয়র অঞ্চল চিরকাল শুষ্ক রাখতে চান তিনি৷ পাম্প চলবে
ভ্যার্নার ম্যুলার বলেন, ‘‘এই অঞ্চলে যতদিন মানুষ বসবাস করবে, আমরা ততদিন পানি পাম্প করবো৷ আমি বিশ্বাস করি মানুষ এখানে চিরকাল বসবাস করবে৷ তাই আমরাও চিরকাল পাম্প করে যাবো৷''
বর্তমানে তাঁর আরএজি-ফাউন্ডেশনের দুই বিলিয়ন ইউরোর মতো সম্পদ রয়েছে৷ মূলত ‘রিয়েল এস্টেট' বিক্রি এবং স্টক বিনিয়োগ থেকে অর্থ আয় করে এটি৷ যতক্ষণ পর্যন্ত সূচক উপরের দিকে উঠছে, ততক্ষণ এটি সফল বিজনেস মডেল৷ কাগজে-কলমে ম্যুলারের পরিকল্পনা কাজ করতে পারে৷ তবে ভবিষ্যতের ঝুঁকি এখনই ধারণা করা কঠিন৷ যদি টাকা শেষ হয়ে যায়, তখন কী হবে?
ভ্যার্নার ম্যুলার বলেন, ‘‘আমাদের ধারণা আগামী ছয় বছরে আমাদের আয় হবে সাড়ে তিনশো থেকে চারশো মিলিয়ন ইউরোর মতো৷ আমাদের জানা মতে সব কিছু হিসেবে করলে পাম্পের পেছনে খরচ হবে ২২০ মিলিয়ন ইউরো৷ এ ভাবে হিসেব সহজ৷ তবে বিদ্যুতের পেছনে কত খরচ হবে, তা সঠিকভাবে বলতে পারছি না৷ পাম্পগুলো অনেক বিদ্যুৎ খরচ করে৷ যতটা বুঝতে পারছি আমাদের আয় হতে হবে খরচের তুলনায় অনেক বেশি৷''
খনির আশেপাশের অনেক মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত৷ স্থানীয় কৃষকরা বলছেন উপার্জন কঠিন হয়ে যাচ্ছে৷ কারণ পাম্পগুলো কাজ করলেও জমিতে পানি ওঠা ঠেকানো যাচ্ছে না৷ বছরের পর বছর ধরে খনি খননের কারণে এখানকার মাটি বসে যাচ্ছে৷
২০১৮ সাল নাগাদ বন্ধ
প্রস্পার হানিয়েল কয়লা খনিটি ২০১৮ সাল নাগাদ বন্ধ হয়ে যাবে৷ কোম্পানিটি তখন তার কর্মীদের অন্যত্র কাজ করার প্রশিক্ষণ দেবে৷ এদের কেউ ইলেকট্রিশিয়ান, কেউ মেকানিক্স কেউ বা টেকনিশিয়ান হবেন তখন৷ কেউ কেউ পাম্প পরিচালনার চাকুরি পেতে পারেন৷
তবে টানেল শুষ্ক রাখার প্রকৃত খরচ এখনো কেউ জানে না৷ তাছাড়া শত বা হাজার বছর পর এই টানেলের কী হবে? এমন প্রশ্নও অনেকের মনে৷