খসড়া ভোটার তালিকা নিয়ে উদ্বেগে পশ্চিমবঙ্গের লাখো ভোটার
১৪ ডিসেম্বর ২০২৫
নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে এক মাসের বেশি সময় ধরে চলছে স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন৷ এই প্রক্রিয়ার প্রথম পর্যায় শেষ হলে প্রকাশিত হবে খসড়া ভোটার তালিকা৷
সংশোধনের প্রথম ধাপ
নভেম্বরের গোড়ায় শুরু হয়েছিল ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন৷ ৮০ হাজারের বেশি বুথ লেভেল অফিসার (বিএলও) বাড়ি বাড়ি গিয়ে এনিউমারেশন ফর্ম বিলি করেছেন৷ প্রথমে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফর্ম বিলি করার কথা ছিল৷ পরবর্তীতে এই তারিখ সাত দিন পিছিয়ে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফর্ম বিলি করা হয়েছে৷
এখন নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকরা এই ফর্মগুলি খতিয়ে দেখছেন৷ তার ভিত্তিতে ১৬ ডিসেম্বর খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে৷ ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত সর্বশেষ ভোটার তালিকায় যাদের নাম আছে, তাদের সকলের নাম খসড়ায়ে থাকার কথা নয়৷ এর মধ্যে মৃত বা স্থানান্তরিত ভোটারদের নাম বাদ চলে যাবে৷ সেই সংখ্যাটা কত, তা নিয়ে তুমুল জল্পনা চলছে৷
যারা এই এনিউমারেশন ফর্ম পূরণ করে বিএলওর কাছে জমা দিয়েছেন, তাদের তথ্য খতিয়ে দেখে খসড়া তালিকায় জায়গা দেয়া হবে৷ যদি তথ্যে অসংগতি থাকে, তাহলে খসড়া তালিকায় নাম না থাকার সম্ভাবনা রয়েছে৷ যাদের ক্ষেত্রে নাম বাদ পড়বে, তাদের ডাকা হবে কমিশনের শুনানিতে৷ সেই শুনানির পরে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশিত হবে৷ খসড়া তালিকা প্রকাশের পর থেকে শুরু হবে শুনানির প্রক্রিয়া৷ আপাতত ৭ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের দিন নির্দিষ্ট রয়েছে৷
নাম থাকবে কি
খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হওয়ার মাঝে আর একটা দিন৷ পশ্চিমবঙ্গের লাখ লাখ ভোটার চিন্তার মধ্যে রয়েছেন, তাদের নাম থাকবে তো!
২০০২ সালের ভোটার তালিকা যাদের নাম রয়েছে বা যাদের বাবা-মায়ের নাম রয়েছে, তাদের মধ্যে উদ্বেগ কম৷ কিন্তু কোটি কোটি ভোটার এমন আছেন, যাদের নাম বা বাবা-মায়ের নাম সেই তালিকায় ছিল না৷ নানা ধরনের জল্পনা, সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা এই ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করছে বেশি৷
সাংবাদিক প্রসূন আচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘কত ভোটার মারা গিয়েছেন, কত ভোটার বাদ পড়বেন, এ বিষয়ে যে খবর বেরোচ্ছে কমিশনের সূত্র বলে, সেগুলো কোথায় পাওয়া যাচ্ছে? যারা কমিশনের অফিসে যাচ্ছেন, তারা বলছেন, কমিশনের অফিসাররা এগুলো বলছেন৷ আসলে নির্বাচন কমিশন একটা ন্যারেটিভ তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ বিহারে এসআইআর-এর সময় বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা ইত্যাদি অনেক কথা বলা হয়েছিল৷ পরবর্তীকালে একজনও পাওয়া যায়নি৷ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সূর্যকান্ত প্রশ্ন তুলেছিলেন, তারা কোথায় গেলেন! তার উত্তর কমিশন দিতে পারেনি৷ এসবের মাধ্যমে কমিশন মুসলিম বিরোধী, বিজেপির সমর্থন একটা প্রচার গড়ে তুলতে চাইছে৷''
তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র মৃত্যুঞ্জয় পাল ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘এই কাজ করতে গিয়ে তথ্যে ভুল হওয়া স্বাভাবিক৷ যে কাজ দুই বছরে করার কথা, সেটা দুই-তিন মাসের মধ্যে করতে গেলে ভুল হতেই পারে৷ এখানে বিজেপি লক্ষ্যমাত্রা করেছে এক কোটি ভোটার বাদ দিতে হবে৷ সেটাকে সামনে রেখে কমিশন কাজ করবে৷ এটাকে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস মেনে নেবে না৷ ভোটার তালিকার সংশোধন হলে মৃত ভোটার এর নাম বাদ যাবে, এটাই স্বাভাবিক৷ কেন সেটাকে এত বড় করে প্রচার করা হচ্ছে৷ কিন্তু বৈধ ভোটার বাদ দেয়া যাবে না৷ ডিটেক্ট, ডিলিট অ্যান্ড ডিপোর্ট পশ্চিমবঙ্গে করা যাবে না৷''
কেন নাম বাদ পড়ার আশঙ্কা?
বিহারে এসআইআর-এর সময় যেমন বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছিল, পশ্চিমবঙ্গেও একই ছবি দেখা যাচ্ছে৷ এই প্রচারের বাস্তদতা নাসলে কতোটা?
বিজেপি মুখপাত্র, অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘এসআইআর-এর মাধ্যমে প্রাপ্তি কতটা সেটা প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে৷ ৫৮ লাখ নাম শুরুতেই বাদ পড়েছে৷ এটাই তো আমরা জানতাম না৷ এই ভোটার তালিকায় গলদ আছে৷ এসআইআর সেটাকেই তুলে আনছে৷ এখানে মৃত ভোটার, স্থানান্তরিত ভোটারের নাম বাদ দেয়া হয়নি৷ এটা শোনা যাচ্ছে, দেড় কোটি ভোটারের নাম বাদ পড়তে পারে৷ কোথাও বাবার বয়স ছেলের থেকে ১৫ বছর বেশি, কোথাও একজনের ২০০ সন্তান! এ সব গরমিল উঠে আসছে সমীক্ষায়৷’’
প্রসূন বলেন, ‘‘আমাদের দেশে এত গরিব মানুষ, নিরক্ষর মানুষ, আদিবাসী, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, তাদের অনেকের জন্ম নিবন্ধন সনদ নেই৷ অনেকের নথিপত্র ভেসে গিয়েছে দুর্যোগে৷ তাদের তথ্যের ক্ষেত্রে গরমিল থাকতেই পারে৷ তাই সাধারণ মানুষ আগামী দেড়-দুই মাস আশঙ্কার মধ্যে থাকবেন৷ কার নাম থাকবে, আর কার থাকবে না, এই দোলাচল থেকে যাবে৷’’
কিন্তু এই ধরনের কোনো তথ্য নির্বাচন কমিশন জানায়নি৷ তারা এ ধরনের কোনো প্রেস রিলিজ দেয়নি৷
তাহলে কেন এই তথ্যগুলো নিয়ে এতটা প্রচার করা হচ্ছে এমন প্রশ্নে জবাবে বিমলশঙ্কর বলেন, ‘‘মিডিয়া সূত্র উদ্ধৃত করে খবর প্রকাশিত হচ্ছে৷ তারা কার কাছ থেকে খবর পাচ্ছে, সেটা সাংবাদিকরা বলতে পারবেন৷ মিডিয়া তো সোর্স বলতে চায় না৷ আমরা ব্যক্তিগত স্তরে বিএলএ ২-এর সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, এক একটি বুথে ১০০ জন মৃত ভোটার, কোথাও ১৩০ জন৷ তাদের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করলে সূত্রের খবর মিলে যাচ্ছে৷''
এসব তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করে প্রসূন বলেন, ‘‘১ কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি, রোহিঙ্গার যে প্রচার গত ৬ মাস, এক বছর ধরে এই রাজ্যে তুলে ধরা হয়েছে, বাস্তবে সেটা দেখা যাচ্ছে না৷ তাহলে এটা অসত্য ছিল ধরে নিতে হবে৷ কিন্তু এখনো নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন সূত্র মারফত একই জিনিস প্রচার করছে৷ বিহারের বিরোধী নেতা তেজস্বী যাদব এই সূত্রটাকে বলেছিলেন মূত্র৷ এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল৷''
রাজনৈতিক দলের বুথ লেভেল এজেন্ট (বিএলএ) এই প্রক্রিয়ার অংশীদার৷ তাদের দেয়া তথ্যের কথা উল্লেখ করে বিমলশঙ্কর বলেন, ‘‘প্রত্যেক রাজনৈতিক দল যতটা সম্ভব সব জায়গায় বিএলএ দেয়ার চেষ্টা করেছে৷ তারা বিএলও-দের সঙ্গে ঘুরেছেন৷ সেইসব তথ্য এক জায়গায় করার পর দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন দলের তথ্যে মিল আছে৷ তৃণমূলের বিএলএ কেন সই করতে রাজি হলেন না? তারা জানেন কী ঘটেছে৷ দলের নির্দেশে তারা সই করেননি৷ ফলে এসব তথ্য পাওয়া কঠিন নয়৷ একটা রাজনৈতিক দল তার কর্মীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সেগুলো জুড়ে দিলেই তো ছবিটা স্পষ্ট হয়ে যায়৷ এটা খুব কঠিন কাজ নাকি?’’