জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন এখন কার্যত আছে কি নেই, তা নিয়ে চলছে বিতর্ক৷ আইনজীবী এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে দুই ধরণের মত দিচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলছেন, হাইকোর্টের আদেশ যেহেতু এখনো স্থগিত হয়নি তাই জামায়াতের নিবন্ধন কার্যত নেই৷
জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার দিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবারই, আপিলের জন্য হাইকোর্টের রায় স্থগিত করার আবেদন করেন জামায়াতের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক৷ হাইকোর্ট আপিলের জন্য সার্টিফিকেটও দেয়৷ ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া মনে করেন, যেহেতু জামায়াত আপিলের অনুমতি পেয়েছে তাই মামলাটি এখনো বিচারাধীন৷ তাই জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করার সুযোগ নেই এবং তারা নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবে৷ যদি আপিল বিভাগও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে তাহলে নিবন্ধন বাতিলের প্রশ্ন আসবে৷ জামায়াতের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকও তাই মনে করেন৷
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়েত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে৷ এদিকে দাবি উঠেছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
‘‘জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল’’
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (০১.০৮.১৩) বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনায়েতুর রহিম এবং কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রায়ে বলা হয়, ‘‘জামায়াতের গঠনতন্ত্র শুধু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
২০০৯ সালের রিটের রায়
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হাইকোর্টে রিট করেন ২০০৯ সালে৷ রিটে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়, জানান ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর৷ সেই রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করলেন আদালত৷
ছবি: Reuters
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
আদালতের রায়ের পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানান, রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ সেজন্য ইতিমধ্যে রায়ের কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেদলের কিছু নেতার হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত৷’’
ছবি: AP
ট্রাইব্যুনালে বিচার
জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে৷ এই ছবিঘর তৈরির দিন (০১.০৮.১৩) অবধি ছয়জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল৷ সর্বশেষ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়েছে৷ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও সরকার এতটা সাহসী হবে বলে আশা করেন না৷ মুনতাসির মামুনের কথায়, ‘‘জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে তা বলাও হয়েছে৷ তাই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্লগারদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণার আগেই ফেসবুকে আরিফ জিবতেক লিখেছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়টা কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া মামলা না৷ মামলাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত আইনসিদ্ধভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে বিবেচনা৷’’ এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই৷’’
ছবি: privat
এই দাবি নতুন নয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মোট তিনবার দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷
তবে অতিরিক্ত আ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার পর কার্যত রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন আর নেই৷ জামায়াত তার দলের নামে এবং দাড়িপাল্লার প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে না৷ নির্বাচন কমিশনের জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র৷ কারণ হাইকোর্টের রায়ের পর আর জামায়াতের নিবন্ধন নেই৷ তাঁর মতে, কেবল হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেই হবে না ৷ যদি আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করে অথবা আপিলের রায়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল হয়, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা৷
তবে আইনি লড়াইয়ে যদি শেষ পর্যন্ত জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়, তাহলে কে লাভবান হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আজমেদ বলেন, লাভবান হবে বিএনপি৷ তিনি বলেন, নিবন্ধন বাতিল হলে জামায়াত তার প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে না৷ কিন্তু জামায়াতের নেতা-কর্মী এবং ভোট তো আর বাতিল হয়ে যাবে না৷
ধারণা করা হয় জাময়াতের শতকরা তিন ভাগ ভোট আছে৷ কোনো কোনো এলাকায় জামায়াত বেশ প্রভাবশালী৷ তাই অধ্যাপক ইমতিয়াজ মনে করেন, এই ভোট বিএনপির ঘরে চলে যাবে৷ কারণ রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক কারণেই তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না৷ আর যে দু-এক জায়গায় জামায়াত প্রভাবশালী সেখানে বিএনপির প্রতীক নিয়েও নির্বাচন করতে পারে জামায়াত৷ মোট কথা লাভ বিএনপিরই৷
তিনি বলেন, জামায়াত ঈদের পর দুই দিনের হরতাল দিয়েছে৷ বিএনপিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে কঠোর আন্দোলন শুরু করবে৷ জামায়াত তার অস্বস্তির কারণেই এখন বিএনপির সঙ্গে যে কোনো আন্দোলনে আরো সক্রিয় হবে৷ ফলে রাজনৈতি পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হবে৷ এর ধারাবাহিকতায় সরকার যদি আরো কঠোর হয়, জামায়াতের নিবন্ধন যদি বতিল হয়, আর সরকার যদি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে, তাহলে তা জামায়াতের জন্য কঠিন পরিস্থিতি হবে৷ নতুন নামে দল হয়ত করতে পারবে৷ কিন্তু তা শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধ মামলায় দণ্ড এবং কারাবাসের কারণে কতটা সম্ভব হবে বলা মুশকিল৷ তাই বলা চলা জামায়াত এখন খাদের কিনারে৷ তবে তাতে কোনো ক্ষতি নেই বিএনপির৷ বরং বিএনপির লাভই হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক আহমেদ৷