বাড়িতে খাবার নেই। তাই স্কুলে আসা বন্ধ করে দিচ্ছে শ্রীলঙ্কার বাচ্চারা। স্কুলও বলছে, খাবার না থাকলে বাচ্চাদের পাঠানোর দরকার নেই।
বিজ্ঞাপন
ভয়ংকর সমস্যায় পড়েছেন নাদিকা প্রিয়দর্শিনী। নাদিকা শ্রীলঙ্কার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে একটি বস্ত্র কারখানার কর্মী। তিনি বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে পারছেন না। কারণ, বাড়িতে খাবার নেই।
প্রবল অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে, তার পরিবার দিনে এখন একবার কিছু সবজি দিয়ে ভাত খাচ্ছে। কোনো কোনো দিন তা-ও জুটছে না। বাড়িতে খাবার নেই। চাল-ডাল কেনার পয়সা নেই। এই অবস্থায় বাচ্চাদের কী করে স্কুলে পাঠাবেন তিনি?
প্রিয়দর্শিনী একা নন, একই অবস্থার মুখে পড়েছেন অনেকে। অভূতপূর্ব আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে শ্রীলঙ্কার মানুষের চাকরি গেছে, ব্যবসা লাটে উঠেছে। খাবার, ওষুধ, জ্বালানি কেনার পয়সা নেই বহু পরিবারের। বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার প্রায় শূন্য। তাই বিদেশ থেকে দানাশস্য আমদানি করা যাচ্ছে না। ২০২১ সালে তড়িঘড়ি করে সরকার অর্গানিক কৃষির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তাই এই বছর ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ফসল কম হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কায় খাদ্যশস্যের উপর মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৯৪ শতাংশের বেশি।
অর্থনৈতিক সংকটে যেভাবে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার নিম্নবিত্ত মানুষ
অর্থনৈতিক অস্থিরতায় বিপাকে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ৷ পরিস্থিতি এমন যে দিনে দুই বেলা খাবারের খরচ মেটাতেও পারছেন না তারা৷ বিস্তারিত জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
চাল নেই ঘরে
রাজধানী কলম্বোর কাছে ওয়ান্টামুলায় তিন সন্তান আর নাতি-নাতনি নিয়ে থাকেন এই নারী৷ রান্নার গ্যাস বিস্ফোরণে আহত হওয়ার পর স্বামী ছেড়ে যান তাকে৷ স্থায়ী কোনো চাকরি না থাকায় ছুটা কাজ করে পরিবারের খরচ চালান তিনি৷ এখন তার মতো কয়েক লাখ মানুষের পক্ষে এমনকি তিন বেলার খাবার জোগাড় করাও বড় এক চ্যালেঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
প্রোটিনের ঘাটতি
৪৯ বছর বয়সি নিলান্থি গুনাসেকারার ঘরে মাছ বলতে এই শুটকিটুকুই অবশিষ্ট রয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘অর্থনৈতিক সংকটের আগে আমরা ভালোই খেতাম৷ সন্তানদের সপ্তাহে অন্তত তিন বা চারদিন মাংস বা মাছ খাওয়াতে পারতাম৷ এখন মাছ আমাদের পরিবারের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ গেছে, একই অবস্থা মাংসেও৷’’
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
করোনার উপর নতুন খাঁড়া
৬০ বছর বয়সি গামাগে রূপাওয়াথির (ডানে) কলম্বোতে ফলের দোকান ছিল৷ সেখান থেকে আয় দিয়ে স্বামী (মাঝে), সন্তান (বামে) নিয়ে ভালোভাবেই চলছিল তাদের সংসার৷ কিন্তু মহামারি চলাকালীন দীর্ঘ লকডাউনের কারণে তার দোকান বন্ধ হয়ে যায়৷ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সেটি আর পুনরায় চালু করতে পারেননি তিনি৷
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
এক কাপ চা, দুটি বিস্কুট
গামাগে রূপাওয়াথির স্বামীর জন্য কোনো কোনোদিন এটিই একমাত্র খাবার৷ দ্বীপ রাষ্ট্রটির সোয়া দুই কোটি বাসিন্দার এক চতুর্থাংশই বর্তমানে দুই বেলা খাবার জোগাতে হিমশিম খান৷
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
ওষুধের সংকট
হৃদরোগে আক্রান্ত মানেল পাইরিস তার ওষুধের খরচ বহন করতে হিমশিম খাচ্ছেন৷ ৬৮ বছর বয়সি এই নারী একটি সরকারি হাসপাতাল থেকে আগে নিয়মিত তিন মাসের ওষুধ পেতেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন আমাদের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে মাসে তিন হাজার ৪০০ রুপি খরচ হয়, যা আমার পক্ষে বহন সম্ভব না৷ আমি বড়জোর এক সপ্তাহের ওষুধ কিনতে পেরেছি৷ কখনো কখনো আমার স্বামীকে টাকা ধার করতে হয় বা অগ্রিম মজুরির আবেদন করতে হয়৷’’
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
জলের অভাব
‘‘আমাদের কলে জলের সংযোগ আছে, কিন্তু খাবারের ক্রমবর্ধমান খরচ ছাড়াও জল আর বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করা খুব কঠিন৷ তাই এখন টাকা বাঁচানোর জন্য আমি প্রায়ই একটি পাবলিক কূপে স্নান করি,’’ বলেছিলেন শিবরাজা সঞ্জীওয়ান নামে ৩১ বছর বয়সি অটোরিকশা চালক৷
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
বিপদে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা
৫৩ বছরের প্রিয়ানি ধম্মিকা পান বিক্রি করেন৷ এর ভিতরে থাকে বাদাম৷ তিনি বলেন, ব্যবসা এখন খুব কঠিন, কেননা, বাদামের দাম তিনগুণ আর পাতার দাম আটগুণ বেড়েছে৷
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
কী দিয়ে রান্না করবেন?
বিদ্যাথিপাতিগে নিহাল আর তার পরিবারের গ্যাসের ট্যাংক আর চুলা চুরি গেছে৷ এর ফলে খোলা চুলায় রান্না করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা৷ কিন্তু গ্যাসের ঘাটতির কারণে জ্বালানি কাঠের চাহিদা দ্রুত বেড়েছে৷ বেড়েছে দামও।
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
8 ছবি1 | 8
খাবার পাওয়া যাচ্ছে না, পেলেও দাম খুবই বেশি, তাই সবচেয়ে অসুবিধার মধ্যে পড়েছেন প্রিয়দর্শিনীর মতো গরিব মানুষেরা। তারা তাদের প্রতিদিনের আয়ের উপরই বেঁচে থাকেন। ফলে এখন তাদের কাছে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। গতমাসে শ্রীলঙ্কার ৩৬ শতাংশ পরিবার নিয়মিত খাবার পায়নি। গত জুনে ইউনিসেফ জানিয়েছিল, শ্রীলঙ্কার ৫৬ হাজার বাচ্চা অপুষ্টিতে ভুগছে।
খালি পেটে পড়া হয় না
বাচ্চারা তাই স্কুলে যেতে পারছে না। খালি পেটে পড়াশুনা হয় না। প্রিয়দর্শিনী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, স্কুলে কিছু বাচ্চা টিফিনের ব্রেকে খাবার খাচ্ছে। কিন্তু আমার বাচ্চাদের কাছে কোনো খাবার নেই। তাই আমি কী করে ওদের স্কুলে পাঠাব?
তার ১৩ বছর বয়সি ছেলে তা-ও জোর করে স্কুলে গেছিল। সে বলেছিল, খালি পেটেই সে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ছয় বছরের মেয়ে কী করে যাবে? ওই বাচ্চা মেয়ে তো খিদে ভুলে পড়তে পারে না।
ছবিতে অর্থনৈতিক মন্দা আর গণবিক্ষোভে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কা
প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রীয় ভবন দখলে নিয়ে বিক্ষোভকারীরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা না ছাড়া পর্যন্ত তারা সেখান থেকে যাবেন না৷ অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক বিপর্যয় আর রাজনৈতিক অস্থিরতার দেশ শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থা দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Eranga Jayawardena/AP/picture alliance
রাজনৈতিক সংকটের আবর্তে শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কার আইনসভা জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহেই পদত্যাগ করবেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে৷ দেশব্যাপী চলমান বিক্ষোভে গত কিছুদিন ধরে এ দাবিই উঠে আসছে৷ বিক্ষোভকারীরা বলছেন, দেশের ইতিহাসের চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে নিজের দায়িত্ব স্বীকার করে প্রেসিডেন্টকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে৷
ছবি: Amitha Thennakoon/AP Photo/picture alliance
বিক্ষোভকারীদের আস্তানা
কলম্বোয় কয়েকদিন আগেও যে ভবন ছিল রাষ্ট্রপতির রাষ্ট্রীয় ভবন, এই মুহূর্তে তা এখন বিক্ষোভকারীদের আস্তানা৷ পুরো ভবনই এখন তাদের দখলে৷ শনিবার কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী ভবনে ঢুকে পড়লে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে দ্রুত সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হন৷ শ্রীলঙ্কা সরকারের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানান, ‘‘প্রেসিডেন্টকে বিশেষ প্রহরায় নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷’’
ছবি: Dinuka Liyanawatte/REUTERS
সুইমিংপুলে শান্তি
ওপরের ছবিতে প্রেসিডেন্ট ভবনের সুইমিং পুলে বিক্ষোভকারীদের শরীর জুড়ানোর দৃশ্য৷ তবে শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ জ্বালানি সংকট এবং দ্রব্যের অগ্নিমূল্য জনমনে যে উত্তাপ ছড়িয়েছে তা এখনো প্রশমিত হয়নি৷ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া গণরোষের মুখে ইতিমধ্যে বিভিন্ন পদ থেকে তার নিকটাত্মীয়দের সরাতে শুরু করেছেন৷ সেই তালিকায় তার দুই ভাই মাহিন্দা এবং বাসিলও রয়েছেন৷ মাহিন্দা ছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী আর বাসিল অর্থমন্ত্রী৷
ছবি: AFP
জ্বলছে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি
গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়া রনিল বিক্রমাসিংহের বিরুদ্ধেও জনতার ক্ষোভ দানা বেঁধেছে ৷ তাই তার নিজস্ব বাড়িতেও জ্বলেছে বিক্ষোভের আগুন৷ রনিল ইতিমধ্যে তার দলের নেতাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন৷ আরো জানিয়েছেন, তিনি ক্ষমতা ছাড়তে এবং সর্বদলীয় সরকার গঠনে সার্বিক সহায়তা করতে প্রস্তুত৷
ছবি: Eranga Jayawardena/AP Photo/picture alliance
ব্যর্থ টিয়ারগ্যাস
ভেঙে পড়া অর্থনীতি এবং বাঁধভাঙা বিক্ষোভের দেশটিতে বিক্ষোভকারীদের রুখতে শনিবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে৷ তবে তাতে বিক্ষোভ দমানো যায়নি৷
ছবি: Amitha Thennakoon/AP/picture alliance
‘দেউলিয়া’ শ্রীলঙ্কা
বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রীয় বাসভবনে ঢুকে পড়ার আগে দেশের অর্থনীতির চরম দুরবস্থার কথা সরকারি পর্যায় থেকেই স্বীকার করে নেয়া হয়৷গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বলেন, মোট ঋণ ৫০ বিলিয়নও ছাড়িয়ে যাওয়ায় শ্রীলঙ্কা এখন ‘দেউলিয়া দেশ'৷দুই কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার দেশটির বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে এক বছর বা তার চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা৷
ছবি: Saman Abesiriwardana/Pacific Press/picture alliance
জ্বালানি সংকটে বিকল্প সন্ধান
তেল আর গ্যাসের চরম সংকট দেখা দেয়ায় বাধ্য হয়ে কাঠ পুড়িয়ে রান্না এবং গাড়ি ছেড়ে সাইকেলে যাতায়াত শুরু করেছেন শ্রীলঙ্কার অনেক মানুষ৷ তাতে গাছ কেটে পরিবেশের ক্ষতি করার প্রবণতা বেড়েছে৷ অন্যদিকে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সাইকেলের দামও বাড়ছে হু হু করে৷
ছবি: Ishara S. KODIKARA/AFP
ভয়াবহতম অর্থনৈতিক বিপর্যয়
শ্রীলঙ্কা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৪৮ সালে৷ গত ৭৪ বছরে আর কখনো এমন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়েনি দেশটি৷ সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের আমলেই চরমে ওঠা সংকট গত মে মাসে দায়িত্ব নেয়া রনিল বিক্রমাসিংহে দৃশ্যত একেবারেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি৷ দু’ মাসের মধ্যে দেশকে ‘দেউলিয়া’ ঘোষণা করে তিনিও এখন পদ ছাড়ার অপেক্ষায়৷
ছবি: Eranga Jayawardena/AP/dpa/picture alliance
8 ছবি1 | 8
খেতে না পাওয়ার জন্য কতজন বাচ্চা স্কুলে যেতে পারছে না, সেই সংখ্যাতত্ত্ব সরকার দেয়নি। তবে গত জুন মাসে জাতিসংঘের রিপোর্ট বলছে, যে সব স্কুলে খাবার দেয়া হয় না, সেখানে বাচ্চারা যাচ্ছে না।
ইউনিসেফের মুখপাত্র ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, কিছু এলকায় স্কুলে বাচ্চাদের যাওয়ার হার কমে দাঁড়িয়েছে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশে।
শ্রীলঙ্কার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব তারা ডি মেল বলেছেন, খাবার পেলেই বাচ্চারা স্কুল যাবে। না হলে গ্রামের দিকে বা যে সব স্কুলে গরিব বাচ্চারা পড়ে, সেখানে তারা খালি পেটে স্কুলে যাবে না।