ইউরোপীয় স্তরে শরণার্থী সংকটের সমাধানসূত্র খুঁজতে তড়িঘড়ি এক শীর্ষ বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেল৷ রবিবার ব্রাসেলসে ১৬ দেশের শীর্ষ নেতারা সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোনো বোঝাপড়ায় আসতে পারলেন না৷
বিজ্ঞাপন
ইউরোপীয় স্তরে শরণার্থী সংকটের সমাধানসূত্র খুঁজতে তড়িঘড়ি কিছু দেশের এক শীর্ষ বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেল৷ রবিবার ব্রাসেলসে ১৬ দেশের শীর্ষ নেতারা সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোনো বোঝাপড়ায় আসতে পারলেন না৷
ইউরোপে শরণার্থী সংকটকে ঘিরে রাজনৈতিক সংকট চরমে উঠেছে৷ অনেক দেশের সরকার কড়া হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছে৷ জনমতও উদার নীতির বদলে শরণার্থীদের প্রবেশ আরও কঠিন করে তোলার পক্ষে৷ বিশেষ চাপের মুখে পড়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ জোটসঙ্গী বাভেরিয়ার সিএসইউ দল এই প্রশ্নে তাঁর বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে৷ চলতি মাসেই ইউরোপীয় স্তরে সমাধানসূত্র খুঁজে না পেলে তারা ম্যার্কেলকে উপেক্ষা করে জার্মান সীমান্ত থেকে সেই সব শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর হুমকি দিয়েছে, যারা অন্য কোনো ইইউ দেশে নিজেদের নথিভুক্ত করেছে৷ অর্থাৎ ম্যার্কেল বিফল হলে চ্যান্সেলর হিসেবে তাঁর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে৷ সেই সঙ্গে জার্মানির রক্ষণশীল ইউনিয়ন শিবিরে অভূতপূর্ব ভাঙনের জের ধরে দেশের রাজনৈতিক সমীকরণ আমূল বদলে যেতে পারে৷ গোটা ইউরোপে তার প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে৷
রবিবার ব্রাসেলসে কয়েকটি ইইউ দেশের ‘মিনি' শীর্ষ বৈঠকে ম্যার্কেল সেই সমাধানসূত্র সম্পর্কে ঐকমত্য অর্জন করতে পারেননি৷ ১৬টি দেশের শীর্ষ নেতা শরণার্থী সংকটের সার্বিক ইউরোপীয় সমাধানসূত্র সম্পর্কে সদিচ্ছা প্রকাশ করলেও এই মুহূর্তে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি৷ ম্যার্কেল নিজেও এত দ্রুত অগ্রগতির আশা করেননি৷ বৃহস্পতিবার ইইউ শীর্ষ সম্মেলনের আগেই, অর্থাৎ আগামী কয়েক দিনের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করার চেষ্টা করতে চান তিনি৷ এমনকি শীর্ষ সম্মেলনেও চূড়ান্ত বোঝাপড়ার বিষয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন নি তিনি৷ তার বদলে দ্বিপাক্ষিক অথবা ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে আপাতত নিজের ঘর সামলানোর চেষ্টা করতে চান ম্যার্কেল৷
ইউরোপের রাজনৈতিক আঙিনার বর্তমান কঠিন বাস্তব সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ম্যার্কেল৷ তাই তিনি বলেন, কোনো সমাধানসূত্রের জন্য ইইউ-র ২৮টি সদস্য দেশের সম্মতির জন্য সব সময়ে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়৷ তবে একই সঙ্গে যে সব দেশকে শরণার্থীদের ঢল সামলাতে হচ্ছে, তাদের প্রতি সংহতির উপর জোর দিয়েছেন তিনি৷ তারা একাই সমস্যার সমাধান করবে, এমনটা হতে পারে না৷ অন্যদিকে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, যে শরণার্থীরা পছন্দমতো ইইউ দেশে আশ্রয়ের আবেদন করতে পারবে না৷ উল্লেখ্য, এতকাল ডাবলিন চুক্তি অনুযায়ী যে দেশে শরণার্থীরা প্রথম পা রাখতেন, সেখানেই তাদের নথিভুক্ত করে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে৷ ইটালির নতুন সরকার সেই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দাবি করছে৷ গত সপ্তাহে তারা প্রায় ৬০০ শরণার্থীসহ একটি জাহাজ ইটালির ভূখণ্ডে নোঙর করতে দেয় নি৷
ইটালির প্রধানমন্ত্রী জুসেপে কন্টে শরণার্থী সংকট সমাধানে ১০ দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন৷ তার আওতায় এমনকি ইউরোপে শরণার্থীদের আগমন রুখতে পদক্ষেপের উল্লেখ রয়েছে বলে জানা গেছে৷ জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংগঠনের সহায়তায় ইইউ-র বাইরেই শরণার্থী সুরক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে৷ মাল্টাও কড়া পদক্ষেপের দাবি করেছে৷ তবে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাস বলেন, এমন সব প্রস্তাব আগেও পেশ করা হয়েছে৷
এমন প্রেক্ষাপটে ম্যার্কেল কী করবেন? ইইউ শীর্ষ সম্মেলনের পর আগামী সপ্তাহান্তে তিনি দলীয় নেতাদের বৈঠক ডাকবেন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ তারপর সোমবার সিএসইউ নেতা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হর্স্ট সেহোফার-এর সঙ্গে বৈঠকে তিনি তাঁর অর্জন সম্পর্কে জানাবেন৷ সেহোফার সেই প্রস্তাব মেনে না নিলে ইউনিয়ন শিবিরে ভাঙন অনিবার্য – এমনটাই আপাতত ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ অন্যদিকে বাভেরিয়ার সিএসইউ দল শেষ পর্যন্ত এত বড় ঝুঁকি নেবে কিনা, চলতি সপ্তাহেই তাদের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷
এসবি/এসিবি (ডিপিএ, রয়টার্স)
শরণার্থী সংকটের কিছু আইকনিক ছবি
ইউরোপে ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী প্রবেশের ছবি গোটা বিশ্বে ছড়িয়েছে এবং মানুষের মতামত সৃষ্টিতে প্রভাব বিস্তার করেছে৷ অভিবাসন এবং অভিবাসনের ফলে সৃষ্ট ভোগান্তির এত ছবি আগে দেখেনি বিশ্ব৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/E. Morenatti
লক্ষ্য: টিকে থাকা
অনিশ্চিত যাত্রার ধকল সামলাতে হয় শারীরিক এবং মানসিকভাবে৷ ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে হাজার হাজার সিরীয় নাগরিক তুরস্ক হয়ে গ্রিসে জড়ো হয়েছেন৷ সে দেশের তিনটি দ্বীপে এখনো দশ হাজারের মতো শরণার্থী বসবাস করছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস অবধি ছয় হাজার নতুন শরণার্থী এসেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Messinis
পায়ে হেঁটে ইউরোপে
২০১৫ এবং ২০১৬ সালে এক মিলিয়নের বেশি মানুষ গ্রিস ও তুরস্ক থেকে পশ্চিম ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেছে৷ ম্যাসিডোনিয়া, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, অর্থাৎ বলকান রুট ব্যবহার করে তাদের এই যাত্রার অধিকাংশই ছিল পায়ে হেঁটে৷ অভিবাসীদের এই যাত্রা বন্ধ হয়ে যায়, যখন রুটটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং কয়েকটি দেশ সীমান্তে বেড়া দিয়ে দেয়৷
ছবি: Getty Images/J. Mitchell
বৈশ্বিক আতঙ্ক
এই ছবিটি গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ তিন বছর বয়সি সিরীয় শিশু আয়লান কুর্দির মরদেহ তুরস্কে সমুদ্রতটে ভেসে ওঠে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে৷ ছবিটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং শরণার্থী সংকটের প্রতীকে পরিণত হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/DHA
বিশৃঙ্খলা এবং হতাশা
শেষ সময়ের ভিড়৷ ইউরোপে প্রবেশের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শুনে ক্রোয়েশিয়াতে এভাবে ট্রেনে এবং বাসে উঠতে দেখা যায় অসংখ্য শরণার্থীকে৷ ২০১৫ সালের অক্টোবরে হাঙ্গেরি সীমান্ত বন্ধ করে দেয় এবং শরণার্থীদের জন্য কন্টেইনার ক্যাম্প তৈরি করে৷
ছবি: Getty Images/J. J. Mitchell
বিবেকবর্জিত সাংবাদিকতা
হাঙ্গেরির এক সাংবাদিক এক শরণার্থীকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়ার ভিডিও নিয়ে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সমালোচনার ঝড় ওঠে৷ সার্বিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন হাঙ্গেরির একটি এলাকার সেই ঘটনায় আলোচিত সাংবাদিকের চাকুরি চলে যায়৷
ছবি: Reuters/M. Djurica
উন্মুক্ত সীমান্ত নয়
২০১৬ সালের মার্চে বলকান রুট আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়ার পর সীমান্তগুলোতে আরো আবেগপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়৷ হাজার হাজার শরণার্থী বিভিন্ন সীমান্তে আটকা পড়ে এবং তাদের সঙ্গে বর্বর আচরণের খবর পাওয়া যায় বিভিন্ন স্থান থেকে৷ অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে৷
ধুলা এবং রক্তে ঢাকা এক শিশু৷ পাঁচবছর বয়সি ওমরানের এই ছবিটি প্রকাশ হয় ২০১৬ সালে৷ আয়লান কুর্দির ছবির মতো এই ছবিটিও গোটা বিশ্বকে আরেকবার নাড়িয়ে দেয়৷ সিরীয়ায় গৃহযুদ্ধ কতটা বিভৎস পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে এবং সিরীয়রা কতটা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, তার এক প্রতীক হয়ে ওঠে ছবিটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Aleppo Media Center
অজানা নতুন ঠিকানা
গ্রিক-ম্যাসিডোনিয়া সীমান্তের ইডোমিনিতে নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় হাঁটছেন এক সিরীয় নাগরিক৷ ইউরোপে তাঁর পরিবার নিরাপদ থাকবে, এমনটাই প্রত্যাশা ছিল তাঁর৷ ডাবলিন রেগুলেশন অনুযায়ী, একজন শরণার্থী প্রথম ইউরোপের যে দেশে প্রবেশ করেন, সে দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করতে হবে৷ ফলে যারা আরো ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন, তাদের অনেককে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷
ছবি: Reuters/Y. Behrakis
সহযোগিতার আশা
বিপুল সংখ্যক শরণার্থী প্রবেশের কারণে জার্মানি অভিবাসন নীতি আরো কড়া করে ফেললেও এখনো শরণার্থীদের প্রথম পছন্দ জার্মানি৷ ইউরোপের আর কোনো দেশ জার্মানির মতো এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থী নেয়নি৷ ২০১৫ সালে সঙ্কট শুরুর পর থেকে দেশটি ১২ লক্ষ শরণার্থী নিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরা
ইউরোপে শরণার্থী প্রবেশের সংখ্যা চলতি বছর কমেছে, তবে থেমে যায়নি৷ বরং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরছে অনেকে৷ বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারের হিসেব অনুযায়ী, চলতি বছর এখন অবধি সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মারা গেছে প্রায় দু’হাজার মানুষ৷ গতবছর এই সংখ্যা ছিল ৫ হাজার৷