খালি হাতে তেল তুলে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে অসংখ্য মানুষ
হারুন উর রশীদ স্বপন, ঢাকা১৮ ডিসেম্বর ২০১৪
সুন্দরবনের শেলা নদীতে ফার্নেস অয়েল বোঝাই ট্যাংকার ডুবে যাওয়ার পর, নারী-পুরুষ-শিশু সবাই ঝাপিয়ে পড়ে খালি হাতে সেই তেল তুলতে৷ কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে তাঁরা ইতিমধ্যেই ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
গত ৯ই ডিসেম্বর তেল বোঝাই ট্যাংকারটি শেলা নদীতে ডুবে যায়৷ এরপর ৩০ টাকা লিটার দরে তেল কিনে নেয়ায় কথা জানানো হলে, দেশীয় পদ্ধতিতে হাড়ি-পাতিল নিয়ে তেল তোলার কাজ শুরু করে দেন স্থানীয়রা৷ সুন্দরবনের জয়মনি ঘোল এলাকার ফরিদা বেগম তেল সংগ্রহ করতে নামেন অন্য সবার মতো৷ স্বামী আবুল হোসেনের মাছ ধরা বন্ধ৷ তাই উপায় না দেখে স্বামীর সঙ্গে ফরিদাও ছড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহ করে তা বিক্রির কাজে লেগে যান৷ কিন্তু নদী থেকে তেল সংগ্রহের কাজে নামার দু'দিনের মধ্যেই ডায়রিয়া আর প্রচণ্ড বমিতে আক্রান্ত হন ফরিদা৷ চিকিত্সা করাতে যা আয় করেছেন তা তো গেছেই, উপরন্তু ঋণগ্রস্ত হয়েছেন তিনি৷ আর ধারও মিলছে না৷ কিন্তু এখনও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি তিনি৷ তারপরও আশঙ্কা স্বামী আবুল হোসেন না আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ কারণ এর মধ্যে তিনিও মাথা ব্যথায় আক্রান্ত হয়েছেন৷
একই অবস্থা শিশু মিরাজের৷ সে তার বন্ধু মাসুদ ও লিটনের সঙ্গে ‘তেল ধরার' কাজে নেমে এখন অসুস্থ৷ তারও ডায়রিয়া এবং মাথাব্যথা৷ তারা সবাই খালি হাতে তেল সংগ্রহ করছিল৷ এতে সারা শরীরে স্বাভাবিকভাবেই তেল লেগে যাচ্ছিল, যাকে বলে একেবারে তেলে মাখামাখি৷ এখন তারা বুঝতে পারছে এটা তাদের শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর৷এ কাজ করে তারা যা আয় করেছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা খরচ হয়ে যেতে পারে চিকিত্সার পেছনে৷ শুধু ফরিদা মিরাজ, লিটন বা মাসুদ নয়, শেলা নদী ও তার আশেপাশের এলাকায় যে সব দরিদ্র জেলে এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা তেল অপসারণের কাজ করছেন, তাঁদের অনেকেই জানান যে, নদী থেকে তেল তুলে আনার কাজ করতে গিয়ে তাঁরা ডায়রিয়া, বমি, অ্যাসিডিটিসহ খাওয়ার অরুচি, অনিদ্রা, চোখ ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জ্বালা করা এবং চুলকানির মতো নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় পড়েছেন৷
শাহীনুর বেগম জানান, দুর্ঘটনার পর তিনি নিজেও তেল তুলতে নেমেছিলেন৷ তেল তুলতে গিয়ে হয়েছে বড় বিড়ম্বনা৷ হাত-পায়ে এখনও জ্বালাপোড়া করছে৷ তিনি জানান, বনবিভাগের লোকজন তাদের সতর্ক করেনি যে, খালি হাতে তেল তুললে অসুখ করতে পারে৷ বরং উল্টে যে যেভাবে পারে, তাকে সেভাবে তেল তুলতে নেমে যাতে বলেছে৷
ঠিকাদাররা এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে মাত্র ৪৮ হাজার ৪০০ লিটার তেল কিনেছে বলে জানা গেছে৷ ওদিকে দুর্ঘটনাকবলিত ট্যাংকারে ৩ লাখ ১৫ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল ছিল৷
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, ‘‘ফার্নেস অয়েল তেলের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর তেল৷ বিটুমিনের পরই ফার্নেস অয়েলের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর কেমিকেল রয়েছে৷ এই তেল ছড়িয়ে পড়ার পর, কোনো ‘প্রটেকশন' না নিয়ে খালি হাতে তা তুলে আনা মানে হলো শরীরের জন্য ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনা৷ বিশেষ করে নারী ও শিশুরা এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পরবে৷ দীর্ঘমেয়োদেও এর ক্ষতির দিক আছে৷''
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য কি ধ্বংস হয়ে যাবে?
‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের অয়েল ট্যাংকারটির তলদেশ ফেটে যাওয়ায় ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল শেলা নদী থেকে পশুর নদী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে৷ এদিকে স্থানীয় পদ্ধতিতে এ যাবৎ সামান্য পরিমাণ তেল অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
শ্বাসমূলীয় বন ও পশুপাখির জীবন বিপন্ন
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সুন্দরবনে তেলবাহী জাহাজডুবির ঘটনায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হবে৷ এর ফলে সুন্দরবনের গাছপালা, মাছ ও পশুপাখির প্রাণ বিপন্ন হতে পারে৷ এছাড়া তেল সরানোর কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া গেলে দীর্ঘ মেয়াদে শ্বাসমূলীয় বন ও বনের পশুপাখির জীবনে বিপর্যয় বয়ে আসতে পারে৷ অথচ নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান দাবি করেছেন যে, তেলের প্রভাবে সুন্দরবনের তেমন ক্ষতি হবে না৷
ছবি: STRDEL/AFP/Getty Images
যে দুটি কাজ করা উচিত ছিল
সুন্দরবনে জাহাজ ডুবে সাড়ে তিন লাখ লিটারেরও বেশি তেল নদীতে ছড়িয়ে পড়ার পর অন্তত দুটি কাজ দ্রুত করা উচিত ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷ প্রথমত, নদীতে ফ্লোটিং বুমের সাহায্যে ভাসমান তেল যেন ছড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যবস্থা করা৷ দ্বিতীয়ত, নিয়ন্ত্রণে আনা ভাসমান তেল তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করা৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
মন্ত্রণালয়ের নীতি লঙ্ঘন
সাম্প্রতিক কালে ফার্নেস তেল আমদানি অন্তত ২০ গুণ বেড়েছে বাংলাদেশে৷ এ সব বিপজ্জনক পদার্থকে বলা হয় ‘হ্যাজম্যাট’ (হ্যাজারডাস ম্যাটেরিয়াল বা ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থ) এবং এর পরিবহনে প্রয়োজনীয় সতর্কতা নেওয়া সাধারণ রীতি৷ মন্ত্রণালয় এই রীতি লঙ্ঘন করেছে৷ কোনো দুর্ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি তাদের ছিল না৷
ছবি: DW/M, Mamun
জাহাজ চলাচলের অনুমোদন কেন
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যান্ত্রিক যান চলা দেশের ও আন্তর্জাতিক নিয়মের লঙ্ঘন৷ সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচলের অনুমোদন কেন দেওয়া হলো, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন৷
ছবি: DW/M, Mamun
ডলফিনের মৃত্যু
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ দুর্ঘটনার পর সুন্দরবন এলাকা ঘুরে এসেছেন৷ তাঁদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী কাঁকড়া, কচ্ছপ, ডলফিনসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী মরতে শুরু করেছে৷
ছবি: Ingrid Kvale
জেলেদের কর্ম বিপর্যয়
সুন্দরবনে শেলা নদীতে তেল ছড়িয়ে বিপর্যয়ের পর সেখানকার কয়েক হাজারেরও বেশি জেলে পরিবারের দিন কাটছে অলস৷ নদী ও খালে তেল ভেসে থাকায় এসব জেলেরা জাল পেতে মাছ শিকার করতে পারছেন না৷ এর ফলে তাঁদের সংসার চালাতে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে৷
ছবি: STRDEL/AFP/Getty Images
শেলা নদীতে ট্যাংকার দুর্ঘটনা
৯ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ভোরের দিকে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কাছে শেলা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটারের ফার্নেল ওয়েলবাহী ট্যাংকার ডুবির পর, ছড়িয়ে পড়েছে তেল৷ সুন্দরবনের ৩৪ হাজার হেক্টর এলাকায় এরই মধ্যে তেল ছড়িয়ে পড়েছে বলে বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
তিনি জানান, ‘‘ফার্নেস অয়েল ভারি হওয়ায় এই তেল উড়ে না গিয়ে পানিতে ভেসে রয়েছে৷ ফার্নেস অয়েলও অবশ্য বাতাসে উড়ে যায়৷ কিন্তু তাতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে৷ তাই এটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অপসারণ না করলে সামনে আরো ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে৷''
মহাবিপর্যয়ের মুখে সুন্দরবন
সুন্দরবনের শেলা নদী থেকে পশুর নদী পর্যন্ত তেল ছড়িয়ে পড়েছে৷ সাড়ে তিন লাখ লিটারের বেশি তেল সুন্দরবনের ৩৪ হাজার হেক্টর এলাকায় এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে৷ দেখা দিয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়৷
ছবি: Ingrid Kvale
শেলা নদীতে ট্যাংকার দুর্ঘটনা
৯ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ভোরের দিকে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কাছে শেলা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটারের ফার্নেল ওয়েলবাহী ট্যাংকার ডুবির পর, ছড়িয়ে পড়েছে তেল৷ সুন্দরবনের ৩৪ হাজার হেক্টর এলাকায় এরই মধ্যে তেল ছড়িয়ে পড়েছে বলে বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
পরিবেশ বিপর্যয়
তেল ছড়িয়ে পড়ায় পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করে বন সংরক্ষক জানিয়েছেন, এই তেলের ক্ষতিকর প্রভাব এখনই বোঝা যাবে না৷ একটু সময় লাগবে৷ তেলের কারণে সুন্দরবনের গাছপালা আস্তে আস্তে শুকিয়ে মারা পর্যন্ত যেতে পারে৷ সুন্দরবনের নদী-খালে অন্তত ৩০০ প্রজাতির মাছের বিচরণ রয়েছে ছোট প্রজাতির কিছু মাছ এরই মধ্যে মরতে শুরু করেছে৷
ছবি: DW/M, Mamun
বিশ্ব ঐতিহ্যের জন্য বিপর্যয়
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তেল ক্রমেই যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে এই বিশ্ব ঐতিহ্যের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে৷
শেলা নদীর জয়মনি এলাকাটি ডলফিনদের অভয়াশ্রম৷ সেখানে একটু পর পর ডলফিন লাফিয়ে উঠত৷ স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছেন, তেল ছড়িয়ে পড়ার পর মঙ্গলবার বিকাল থেকে আর কোনো ডলফিন উঠতে দেখা যাচ্ছে না৷ তেলের কারণে তারা হয় মরে গেছে অথবা দূরে কোথাও সরে গেছে৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
গাছে গাছে তেলের আবরণ
বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সুন্দরবনের ওই সব এলাকায় সুন্দরী গাছ বেশি৷ শেলা নদী সংলগ্ন বনের সুন্দরী, কেওড়া, বাইনসহ গুল্ম জাতীয় গাছের পাতায় তেলের আবরণ লেগে রয়েছে৷ কোথাও কোথাও জোয়ারের পানি বনভূমিতে উঠে বনের গাছের শ্বাসমূলে লেগে আছে তেল৷
ছবি: DW/M, Mamun
ডলফিনদের রক্ষা
নদী থেকে তেল দ্রুত অপসারণ করা না গেলে বিরল প্রজাতির ডলফিনের এই অভয়াশ্রম রক্ষা করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা৷
ছবি: Ingrid Kvale
7 ছবি1 | 7
ঢাকার সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালের নারী ও শিশু বিষয়ক চিকিত্সক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘কোনো প্রতিরোধক ছাড়া খালি হাতে তেল তুলতে দিয়ে সুন্দরবন এলাকার সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘তাঁরা স্বল্পমেয়াদে গ্যাস্ট্রিক, নিউমোনিয়া, চোখের প্রদাহ ও চর্মরোগে আক্রান্ত হবেন বা হয়েছেন৷ এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে পাকস্থলি ও চোখ চরম ক্ষতির মুখে পড়তে পারে৷''
ডা. শাহরিয়ার কথায়, ‘‘এই তেল যাঁরা তুলেছেন তাঁদের শরীরের ভিতরেও তা প্রবেশ করেছে৷ তেলের যে ধাতব উপাদান আছে, তা শরীরের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে যাবে৷ ফলে তাঁরা দীর্ঘমেয়াদে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারেন৷ তাঁদের খাবার রুচি থাকবে না, ঝিমুনিও হতে পারে৷''
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমির হোসাইন চৌধুরীও স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা স্বীকার করেন৷ তবে তিনি দাবি করেন যে, তারা ‘হ্যান্ড গ্লাভ্স' বা দস্তানা এবং গাম বুটের ব্যবস্থা রেখেছিলেন৷ কিন্তু কেউ তা ব্যবহার করেননি৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখনো কেউ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেছেন বলে আমার জানা জানা নেই৷''
তবে সুন্দরবনের জয়মনির নিকটবর্তী চিলা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের চিকিত্সক ডা. রফিকুল জানান, ‘‘এখানকার মানুষ প্রাণসংশয় না হওয়া পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে যেতে চান না৷''