তুরস্ক সীমান্তে শরণার্থী সংকটের মাধ্যমে ব্রাসেলসের উপর চাপ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট৷ সোমবার ইইউ নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় তেমন কোনো সমাধানসূত্র উঠে আসে নি৷
বিজ্ঞাপন
সিরিয়ায় বেকায়দায় পড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর কাছে সাহায্য চেয়ে বিফল হয়েছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ান৷ চাপ বাড়াতে তিনি গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি ইউরোপে শরণার্থীদের প্রবেশের পথ খুলে দিয়েছিলেন৷ ফলে গ্রিস সীমান্তে নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়৷ গ্রিসের বেশ কয়েকটি দ্বীপেও শরণার্থীর ঢল নামে৷ দুই পক্ষের মুখরক্ষা করে বর্তমান সংকট কাটানোর উদ্যোগের আওতায় সোমবার ব্রাসেলসে ইইউ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট৷ তবে ইইউ ও ন্যাটোর কাছ থেকে কোনো ছাড় আদায় করতে পারলেন না তিনি৷
ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্কের সঙ্গে শরণার্থী চুক্তি চালু রাখার পক্ষে সওয়াল করেছে৷ এই মর্মে বর্তমান চুক্তি এখনো বৈধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন৷ স্থির হয়েছে, এই চুক্তির মূল্যায়ন নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বর্তমানে যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে, তা দূর করতে ইইউ পররাষ্ট্র বিষয়ক কর্মকর্তা ও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এক বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে কাজ করবেন৷ ইইউ সরকার পরিষদের প্রেসিডেন্ট শার্ল মিশেল ও কমিশনের প্রেসিডেন্ট ফন ডেয়ার লাইয়েন এর্দোয়ানের সঙ্গে আলোচনা সম্পর্কে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন৷ তবে সংকটের সমাধানসূত্র হিসেবে তাঁরা কোনো স্পষ্ট ফলাফল দেখাতে পারেন নি৷ এমনকি সোমবার কোনো সংবাদ সম্মেলনে এর্দোয়ান উপস্থিত ছিলেন না৷ দুই পক্ষের মধ্যে শীতল সম্পর্ক ঢেকে রাখার কোনো প্রচেষ্টা এ দিন দেখা যায় নি৷
সোমবার এর্দোয়ান ন্যাটোর মহাসচিব ইয়েন্স স্টল্টেনবার্গের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন৷ তিনি মোট দশটি অনুরোধের তালিকা পেশ করেন৷ সরাসরি সিরিয়ায় তুরস্কের অভিযানে সহায়তার প্রত্যাশা না করলেও তিনি চান তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে ন্যাটোর আরও বিমান ও ড্রোন মোতায়েন করা হোক৷ ভূমধ্যসাগরের পূর্বাংশে আরও রণতরী পাঠানোরও অনুরোধ করেছেন এর্দোয়ান৷ স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ন্যাটো বর্তমানে তুরস্কের সহায়তা করছে, ভবিষ্যতেও এমনটা করে যাবে৷ অর্থাৎ তুরস্ককে নতুন কোনো সহায়তার আশ্বাস দেন নি ন্যাটোর মহাসচিব৷
মোটকথা এর্দোয়ান খালি হাতেই দেশে ফিরেছেন বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন৷ ইইউ ও ন্যাটোও তুরস্কের কাছ থেকে তেমন কোনো ছাড় আদায় করতে পারে নি৷ তবে সর্বোচ্চ স্তরে সংলাপ চালু থাকায় অনেকে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন৷
ব্রাসেলসে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় থাকলেও গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী তুরস্কের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে ছাড়েন নি৷ বার্লিনে এক অর্থনৈতিক সম্মেলনে যোগ দিতে এসে কিরিয়াকস মিটসোটাকিস স্পষ্ট জানিয়ে দেন, যে গ্রিস ও ইইউ তুরস্কের ‘ব্ল্যাকমেল'-এর সামনে নতি স্বীকার করবে না৷ তাঁর অভিযোগ, তুরস্ক হাজার হাজার শরণার্থীকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীতে পরিণত করছে৷ এমন পরিস্থিতিতে ইইউ-র বহির্সীমানার সুরক্ষা জোরদার করতে হবে, বলেন গ্রিক প্রধানমন্ত্রী৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেন, কোনো অবস্থাতেই ২০১৫ সালের শরণার্থী সংকটের পুনরাবৃত্তি হবে না৷ তিনি বলেন, ‘‘২০২০ মোটেই ২০১৫ হতে পারে না৷'' তুরস্কের পদক্ষেপ একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়, বলেন জার্মান চ্যান্সেলর৷
সাগর পথে এখনো ইউরোপে ঢুকছেন বাংলাদেশিরা
ভূমধ্যসাগর থেকে শরণার্থীদের উদ্ধার করা জাহাজ ওশান ভাইকিংসে কিছুদিন কাটিয়েছেন ডয়চে ভেলের সাংবাদিক মিওদ্রাক জরিচ৷ সেখানে তিনি অন্যান্য দেশের শরণার্থীদের সঙ্গে বাংলাদেশিদেরও দেখেছেন৷
ছবি: DW/M. Soric
ওশান ভাইকিংয়ে চড়ে সমুদ্রে
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝির দিকে ওশান ভাইকিংসের ক্রুদের দুই সপ্তাহের সঙ্গী হই আমি৷ জাহাজটিতে থাকা একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে আমি লিবীয় উপকূলে ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স এবং এসওএস মেডিট্রেনির কার্যক্রম একেবারে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি৷ দেখেছি, সাগর থেকে উদ্ধার করা বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশের শরণার্থীদের অবস্থাও৷
ছবি: DW/M. Soric
সবসময় সাগরে চোখ
লিবিয়া উপকূলে থাকাকালে আমি দেখেছি, ওশান ভাইকিংসে অবস্থানরত ক্রু এবং মানবাধিকার কর্মীরা সবসময় সমুদ্রের দিকে চোখ রাখতেন৷ ভূমধ্যসাগরে এই জাহাজের ভেসে বেড়ানোর উদ্দেশ্য একটাই আর তা হচ্ছে, ইউরোপে আসার পথে সাগরে দুর্ঘটনায় পড়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা৷
ছবি: DW/M. Soric
উদ্ধার তৎপরতা
আমাদের মিশনের প্রথম দিনেই লিবিয়া উপকূল থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে সাগরে ভাসতে থাকা দু’টি নৌকা থেকে জরুরি সাহায্যের আকুতি শুনতে পাই৷ মানবাধীকার কর্মীরা অশান্ত সাগরের মাঝেই উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত সব মানুষকে জাহাজে তুলে আনতে সক্ষম হন৷
ছবি: DW/M. Soric
ইউরোপে আসতে মরিয়া তারা
সমুদ্র থেকে ওশান ভাইকিংসে তুলে আনা অধিকাংশ অভিবাসনপ্রত্যাশীই পুরুষ৷ দুই সপ্তাহের মিশনে আমরা অনেক বাংলাদেশি এবং মরোক্কানকে দেখেছি৷ এছাড়া সাব-সাহারান দেশগুলো থেকে আসা মানুষও ছিল৷ তারা ইউরোপে পৌঁছাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেন৷ তবে, উদ্ধারের পর তাদেরকে বেশ ভারমুক্ত মনে হয়,কেননা, তারা তখন নিশ্চিত হন যে আর লিবিয়ায়ফিরে যেতে হবে না৷
ছবি: DW/M. Soric
ইউরোপে নতুন জীবন
ওশান ভাইকিংসে ওঠার পর শরণার্থীরা তাদের মানসিক অস্থিরতা থেকে কিছুটা মুক্তি পান এবং ভবিষ্যৎনিয়ে ইতিবাচক ভাবনার সুযোগ পান৷ যে মহাদেশে পৌঁছাতে ঘরবাড়ি, পরিবার ছেড়ে এসেছেন তারা,শীঘ্রই সেখানে প্রবেশের সুযোগ হবে তাদের৷ আমি মাঝে মাঝে তাদের ভাবনা বোঝার চেষ্টা করি৷ তারা কি অতীত নিয়ে ভাবেন, নাকি ভবিষ্যৎ নিয়ে?
ছবি: DW/M. Soric
জীবন বাঁচাতে বদ্ধপরিকর এরিক কনিন্সবের্গার
আমি এখানে ক্রুদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি৷ ১৪টির বেশি দেশের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি এবং ধর্ম থেকে আসা মানুষদের নিয়ে গড়া এই দলের একটাই উদ্দেশ্য – অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জীবন বাঁচানো৷ অতীতে তারা যা- করুক না কেন এই জাহাজের ডেক কিংবা বাথরুম পরিষ্কার করাতেও তাদের কোনো আপত্তি নেই, কথাগুলো বলেন এরিক কনিন্সবের্গার৷ দু’বছর আগেও তিনি ছিলেন একজন অভিনেতা৷
ছবি: DW/M. Soric
উদ্ধারকর্মী ইলিনা এন্গেলোভা
‘‘আমি অন্য কোথাও কাজ করার কথা কল্পনাও করতে পারি ,’’ বলেন ইলিনা এন্গেলোভা৷ ওশান ভাইকিংস জাহাজের মানবিক সহায়তা বিষয়ক কর্মকর্তা তিনি৷ তরুণ এই বেলজিয়ান সেই দলের সদস্য,যারা একসময় প্রায় নিশ্চিত ডুবতে বসা ২৭৪ শরণার্থীকে উদ্ধারে সক্ষম হয়েছিলেন৷ বর্তমানে শরণার্থীদের উদ্ধারের পর জাহাজে তাদের দেখভালের দায়িত্ব তাঁর৷
ছবি: DW/M. Soric
এক নিরাপদ স্বর্গ
অভিবাসীদের জাহাজে তোলার পর খাদ্য, পানীয় জল, এক ব্যাগ কাপড় এবং একটি কম্বল দেয়া হয়৷ আমি যখন জাহাজে ছিলাম,তখন অভিবাসীদের এই কন্টেইনারগুলোতে থাকতে দেখেছি৷
ছবি: DW/M. Soric
জাহাজে সাময়িক আবাস
অভিবাসীদের ইটালিতে নিয়ে আসার পর জাহাজে থাকা তাদের সাময়িক আবাসন দেখার সুযোগ দেয়া হয় আমাকে৷ অভিবাসীদের স্ট্রেস দূর করতে সহায়তার উদ্দেশ্যে সেখানে একটি বক্সিং রিং তৈরি করে দিয়েছেন ক্রুরা৷ আর সেখানকার দেয়ালে অভিবাসীরা ছবি এঁকেছেন, ক্রুদের ধন্যবাদ দিয়ে নানা বার্তা লিখেছেন৷
ছবি: DW/M. Soric
বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে
ওশান ভাইকিং ত্যাগ করার আগে উদ্ধারকৃত অভিবাসীরা সেটির দেয়ালে স্বাক্ষর দিয়ে গেছেন৷ এখানে বাংলাদেশ থেকে আসা একজন তারিখ লিখেছেন ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২০৷ কেউ কেউ আবার ধন্যবাদসূচক নানা বার্তা এবং প্রাথনাও লিখেছেন৷ তাদেরকে সিসিলি বন্দর থেকে কোথায় নেয়া হবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷
ছবি: DW/M. Soric
জাহাজে চিকিৎসক
ইতালি কর্তৃপক্ষ সিসিলিতে ওশান ভাইকিং জাহাজটিকে কোয়ারেন্টাইন করেছে৷ তারা আশঙ্কা করছে যে, শরণার্থীরা করোনা ভাইরাস নিয়ে আসতে পারে৷ জাহাজে অবস্থানরত চিকিৎসক ড. স্টেফান কে. হল আমাদের তাপমাত্রা এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন৷ ২০১৩ সাল থেকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে আসা এই মার্কিন নাগরিক এর আগে দক্ষিণ সুদান, মিয়ানমার, বাংলাদেশ এবং সিরিয়ায় ছিলেন৷
ছবি: DW/M. Soric
আশা এবং হতাশা
এই শরণার্থী শিশুরা আইভরি কোস্ট থেকে এসেছেন৷ তাদের অভিভাবকরা কোথায় তা জানা যায়নি৷ ওশান ভাইকিংয়ের উদ্ধারকারীরা উদ্ধারের পর তাদের খেলনা দিয়েছেন৷ তবে, এই শিশুরা খুব দ্রুতই হতাশ হয়ে পড়েছিল৷ কারণ, তারা জাহাজত্যাগের সময় ইতালীয় কর্তৃপক্ষ করোনা ভাইরাসের ভয়ে তাদের কাছ থেকে খেলনাগুলো নিয়ে গেছে৷
ছবি: DW/M. Soric
জাহাজে সুস্থ থাকা
ইতালীয় উপকূলে বেশ কয়েকদিন ঝড়ের সঙ্গে লড়ার পর দেশটির কর্তৃপক্ষ আমাদের সিসিলিতে নোঙ্গরের অনুমতি দেয়৷ কিন্তু করোনভাইরাস আতঙ্কের কারণে আমি এবং ক্রুরা জাহাজ থেকে নামার অনুমতি পাইনি৷বলা হয়েছে, আমাদের এভাবেই দু’সপ্তাহ কাটাতে হবে৷ এই সময়টায় সুস্থ থাকার জন্য ক্রুদের কেউ কেউ এরকম জিম তৈরি করেছে৷
ছবি: DW/M. Soric
জাহাজের নায়ক
কোয়েরেন্টাইনে থাকাকালে আমি বেশ কয়েকজন ক্রুর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছি৷ তাদের মধ্যে নায়ক হচ্ছেন টঙ্গুই৷ ৩৮ বছর বয়সি এই ফরাসি যত মানুষকে উদ্ধার করেছেন তা অন্য কোনো ক্রু করতে পারেননি৷ কারো কারো হিসেবে এই মানুষটা দশ হাজারের বেশি শরণার্থীকে ডুবে মরা থেকে বাঁচিয়েছেন৷
ছবি: DW/M. Soric
একটি বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি
এই চমৎকার হাসিটা দিয়ে মিরিয়াম উইলিস জাহাজের সবার মন জয় করে নেন৷ যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজের এই বাসিন্দা শরণার্থীদের খাদ্য, পানীয়, পোশাক, ঘুমানোর স্থান থেকে গোসল অবধি সবকিছুর দেখভাল করেন৷
ছবি: DW/M. Soric
জীবন বাঁচাতেও খরচ আছে
তবে, মানুষ জীবন বাঁচানোর এই অভিযান অর্থের বিবেচনায় মোটেই সস্তা নয়৷ জাহাজটিতে প্রতিদিন চৌদ্দ হাজার ইউরো খরচ হয়৷ এই খরচের মধ্যে জাহাজের ভাড়াও অন্তর্ভূক্ত আছে৷ উদ্ধারকারীদের জন্য নতুন লাইফবোট এবং অন্যান্য সামগ্রী প্রয়োজন৷ কিন্তু অর্থের অভাবে সেগুলো কেনা যাচ্ছে না৷