বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছে তার পরিবার৷ আবেদনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের খবর অনুযায়ী, বুধবার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উদযাপন নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ তথ্য জানান৷
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘খালেদা জিয়ার পক্ষে আবেদন পেয়েছি, তার পরিবার আবেদন করেছেন৷ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে৷’’ এ নিয়ে পঞ্চমবারের মতো খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করা হলো৷ সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে তার দণ্ডের কার্যকারিতা ছয় মাসের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত দেয় সরকার৷ সেই মেয়াদ ২৪ মার্চ শেষ হবে৷
খালেদা জিয়াকে প্রতিবার একই শর্তে কারাগারের বাইরে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে৷ শর্ত অনুযায়ী, মুক্ত থাকার সময়ে তাকে ঢাকায় নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে এবং তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না৷ দুর্নীতির দুই মামলায় দণ্ডিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে করোনা মহামারির মধ্যে গতবছর ২৫ মার্চ নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেয় সরকার৷ দণ্ডের কার্যকারিতা ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হলে তিনি কারামুক্ত হন৷ পরে চার দফায় দুই বছর তার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো হয়৷
বর্তমানে তার গুলশানের ভাড়া বাসা ‘ফিরোজায়' আছেন ৭৬ বছর বয়সি খালেদা জিয়া৷তিনি আর্থারাইটিস, ডায়াবেটিস, চোখের সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছেন৷ গতবছর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন৷
সর্বশেষ গত ১৩ নভেম্বর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তার ‘পরিপাকতন্ত্রে' রক্তক্ষরণ এবং লিভার সিরোসিসের কথা জানান চিকিৎসকেরা৷ দীর্ঘ ৮১ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে গত ১ ফেব্রুয়ারি বাসায় ফেরেন তিনি৷
পরিবারের পক্ষ থেকে সে সময় খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চাওয়া হলে দণ্ড স্থগিতের শর্তের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তা নাকচ করে দেয় সরকার৷
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তখন বলেছিলেন, শর্তসাপেক্ষে মুক্ত থাকা অবস্থায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রার আবেদন বিবেচনার সুযোগ নেই৷ তাকে কারাগারে ফিরে তবেই আবেদন করতে হবে৷
সিআরপিসির ৪০১(১) ধারায় বলা আছে, যখন কোনো ব্যক্তিকে অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়া হয়, তখন সরকার যে কোনো সময় শর্ত ছাড়াই অথবা শর্তসাপেক্ষে শাস্তি স্থগিত করতে পারে অথবা তাকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তার পুরো বা যে কোনো অংশ স্থগিত করতে পারে৷
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজায় কারাজীবন শুরু করেন খালেদা জিয়া৷ পরে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও তার সাজার রায় হয়৷ এছাড়াও এই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রয়েছে আরও ৩৪টি মামলা৷
এনএস/এসিবি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
গত বছরের ছবিঘরটি দেখুন
খালেদা জিয়ার চার বছর
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সাজাপ্রাপ্ত হন খালেদা জিয়া৷ এরপর থেকে তিনি কারাগার, হাসপাতাল ও বাসায় আছেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
মামলার রায়
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত৷ একই মামলায় তারেক রহমানসহ অন্য আসামিদের ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ পরে আপিলে খালেদার কারাদণ্ডের মেয়াদও বেড়ে ১০ বছর হয়৷ সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ৩ জুলাই ঢাকার রমনা থানায় মামলাটি করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন৷ ছবিতে খালেদা জিয়াকে আদালতে যেতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A.M. Ahad
অভিযোগপত্রে যা বলা হয়েছিল
১৯৯১ সালে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে এতিমদের সহায়তায় গঠিত ‘প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলে’ চার কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার ২১৬ টাকা জমা হয়েছিল৷ কিন্তু ১৯৯৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঐ অর্থ দেশের প্রতিষ্ঠিত কোনো এতিমখানায় দেয়া হয়নি৷ পরে ‘জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’ গঠন করে সেখানে দুই কোটির বেশি টাকা ট্রান্সফার করে সেটা আসামিরা আত্মসাত করেন বলে মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
রায় ঘোষণার দিনটি যেমন ছিল
পুরো রাজধানীতে পুলিশের সতর্ক পাহারা ছিল৷ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, হাইকোর্ট ও বকশিবাজারে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল৷ দুপুর ১২টায় গুলশানের বাসা থেকে বকশিবাজারের আদালতের উদ্দেশ্যে রওনা হন খালেদা জিয়া৷ পথে কাকরাইল ও চাঁনখারপুলে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়৷ এই সময় বিএনপির বেশ কয়েকজন কর্মীকে আটক করা হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
আদালত থেকে কারাগারে
রায় ঘোষণার পর খালেদা জিয়াকে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ২০১৬ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা ঐ কারাগারটিকে ‘সাবজেল’ ঘোষণা করেছিল সরকার৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
কারাগার থেকে হাসপাতালে
চিকিৎসকদের পরামর্শে ২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল৷ সেখানে টানা এক মাস দুই দিন চিকিৎসা নেয়ার পর ৮ নভেম্বর তাকে কারাগারে ফিরিয়ে নেয়া হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
বিএসএমএমইউতে যেতে আপত্তি
২০১৯ সালের ১০ মার্চ খালেদার চিকিৎসার জন্য বিএসএমএমইউ প্রস্তুত করা হয়েছিল৷ কিন্তু তিনি সেখানে যেতে রাজি হননি৷ খালেদা জিয়াকে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার দাবি জানিয়েছিল বিএনপি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/ANN/The Daily Star
অবশেষে আবারও বিএসএমএমইউ
কারাগারে অসুস্থ হওয়ায় ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ২০২০ সালের ২৫ মার্চ মুক্তির আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন৷
ছবি: Bdnews24.com
আবারও কারাদণ্ডের রায়
২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াসহ চার জনকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলাটি করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন৷ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ আনা হয় মামলায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Jahan
অবশেষে মুক্তি
শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি পেয়ে ২৫ মাস কারাভোগের পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ মুক্তি পান খালেদা জিয়া৷ একদিন আগে খালেদাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক৷ শর্ত হলো এই সময়ে খালেদাকে ঢাকায় নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে৷ তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না৷
ছবি: bdnews24
নির্বাহী আদেশে মুক্তি
খালেদা জিয়ার বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে নির্বাহী আদেশে তাকে মুক্তি দিয়েছেন বলে সেই সময় জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের৷
ছবি: Asif Mahmud Ove
চার দফা সময় বৃদ্ধি
২০২০ সালের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়াকে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়া হয়েছিল৷ এরপর চার দফায় তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়৷ ছবিতে খালেদা জিয়ার বাড়ি দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/S. Hossain
এটা এখন আইনের ব্যাপার: প্রধানমন্ত্রী
১৭ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘খালেদা জিয়াকে যে কারাগার থেকে বাসায় থাকতে দিয়েছি, চিকিৎসা করতে দিয়েছি এটাই কি বেশি নয়?’’ তিনি বলেন, ‘‘আমার হাতে যেটুকু পাওয়ার, সেটুকু আমি দেখিয়েছি৷ ... এখানে আমার কিছু করার নাই৷ আমার যেটা করার, আমি করেছি৷ এটা এখন আইনের ব্যাপার৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
স্মারকলিপি
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে স্মারকলিপি দেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা৷
ছবি: bdnews24
তিনবার হাসপাতালে
২০২০ সালের মার্চে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে এ নিয়ে তিনবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন খালেদা জিয়া৷ এর মধ্যে গত এপ্রিলে তিনি করোনা ভাইরাসেও আক্রান্ত হয়েছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
খালেদা কী অসুখে ভুগছেন
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বৃহস্পতিবার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘খালেদা জিয়া এখন ক্রনিক কিডনি ডিজিজে যেমন ভুগছেন তেমনি ক্রনিক লিভার ডিজিজেও ভুগছেন৷ এখন তার লিভারের সমস্যা বেশি হচ্ছে৷ যার কারণে জিআই (পরিপাকতন্ত্র) ব্লিডিং বেশি হচ্ছে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘খালেদা জিয়ার আগে থেকেই আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস আছে৷ আর রাইট হার্ট ফেইলিউরসহ আরো কিছু শারীরিক অসুস্থতা বা জটিলতা আছে৷’’
ছবি: Bdnews24.com
স্লো পয়জনিং?
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘...একটি সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে দুই বছরের বেশি সময় আটক রাখা হয়েছিল৷ পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি৷ এখন অনেকের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, সেই সময়ে খালেদা জিয়াকে কোনো স্লো পয়জনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল কি না, আমরা পরিষ্কার করে জানতে চাই৷’’
ছবি: Asif Mahmud Ove
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সংবাদ সম্মেলন
খালেদা জিয়াকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী৷ এরপর বুধবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘‘আমি এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে খালেদা জিয়াকে দেখে এসেছি৷ যা দেখেছি, সাম্প্রতিককালে এত মর্মান্তিক ঘটনা আমি দেখিনি৷ খালেদা জিয়া কতক্ষণ, কয় দিন, কয় মিনিট বাজবেন, তা আমি বলতে পারব না৷ এটা বলতে পারি, তিনি ক্রান্তিকালে আছেন, তাকে হত্যা করা হচ্ছে৷’’