সাংবাদিক জামাল খাশগজি হত্যাকাণ্ডে পাঁচ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং আরও তিনজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে সৌদি আরবের একটি আদালত৷ তবে প্রাথমিকভাবে দণ্ডপ্রাপ্তদের নাম প্রকাশ করা হয়নি৷
বিজ্ঞাপন
সোমবার রিয়াদের অপরাধ আদালত এই রায় দেয়৷ সৌদি আরবের ডেপুটি পাবলিক প্রসিকিউটর শালান আল-শালান এ রায় পড়ে শোনান৷ অভিযুক্ত ১১ জনের মধ্যে বাকি তিনজনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে৷
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক খাশগজি দ্বিতীয় বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে গত বছর ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে গিয়েছিলেন৷ সেখান থেকে তিনি আর বের হননি৷ পরে জানা যায় তাঁকে কনস্যুলেটের ভেতরে হত্যা করে মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়৷ আজ পর্যন্ত তার দেহাবশেষ সনাক্ত হয়নি৷
সৌদি রাজ পরিবারের এক সময়ের ঘনিষ্ঠজন থেকে কড়া সমালোচক হয়ে গিয়েছিলেন ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট খাশগজি৷ বিশেষ করে নিজের শেষ কয়েকটি কলামে সৌদি যুবরাজ মোহামেদ বিন সালমানের দেশকে আধুনিক করার নানা উদ্যোগের সমালোচনা করেছিলেন তিনি৷
খাশগজি নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই তুরস্ক তাঁকে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে হত্যা করা হয়েছে এবং সৌদি যুবরাজ সালমান ওই হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন বলে দাবি করেছিল৷ আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করা হয়৷
শুরুতে অস্বীকার করলেও সৌদি আরব পরে হত্যার দায় স্বীকার করে৷ যদিও তাদের দাবি, যুবরাজ হত্যা পরিকল্পনার বিষয়ে কিছুই জানতেন না৷ তবে সিআইএ ও আরো কয়েকটি পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে খাশগজি হত্যাকাণ্ডে সৌদি যুবরাজের জড়িত থাকার ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ‘ পাওয়ার কথা বলা হয়৷
খাশগজি হত্যায় জড়িত সন্দেহে সৌদি আরব ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে৷ আরও ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছিল৷ জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ১১জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে রাজধানী রিয়াদে তাদের গোপন বিচার শুরু হয়৷
সোমবারের রায়ে যে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তারা ‘খাশগজি হত্যাকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত ছিলেন'৷ বাকি তিনজনকে মোট ২৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত৷ তারা ‘এই অপরাধ গোপন করে আইন লঙ্ঘন করেছেন' বলে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে৷
তবে তদন্তে খাশগজি ও দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে কোনো 'পূর্ব শত্রুতার' প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলেও রায়ে বলা হয়৷ তবে কী কারণে খুন হতে হলো খাশগজিকে?
গত নভেম্বরে সৌদি রাজপরিবারের সাবেক প্রভাবশালী উপদেষ্টা সৌদ আল-কাহতানি এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারেন বলে বলা হয়েছিল৷ তখন প্রসিকিউটর বলেছিলেন, কাহতানি সৌদি কনস্যুলেটের ভেতর একদল লোকের সঙ্গে খাশগজির কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করেছিলেন৷ ওই দলই পরে খাশগজি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়৷
প্রসিকিউটরের দাবি অনুযায়ী, সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার উপ প্রধান আহমেদ আল-আসিরি খাশগজিকে তুরস্ক থেকে যে কোনো উপায়ে দেশে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ হত্যার দিন কনস্যুলেটের ভেতর প্রথমে এটা নিয়েই দেনদরবার চলছিল এবং এক পর্যায়ে খুনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ আল-কাহতানি ওই আলোচনায় আল-আসিরির সঙ্গে সমন্বয়কারীর ভূমিকায় ছিলেন৷
পরে উভয়কেই তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়৷ আসিরিকে বিচারের মুখোমুখি করা হলেও কাহতানিকে তা হতে হয়নি৷ যদিও বিচারে আসিরিও প্রমাণের অভাবে খালাস পেয়েছেন৷
দণ্ডপ্রাপ্তরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পাবেন৷
এসএনএল/কেএম (রয়টার্স)
জামাল খাশগজি: রহস্যময় অন্তর্ধান ও মৃত্যু
সৌদি সাংবাদিক তিনি৷ ছিলেন সরকারের সমালোচক৷ ইস্তানবুলে সৌদি দূতাবাস থেকে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলেন৷ বারবার বদলেছে তাঁর নিখোঁজ হওয়া বা মৃত্যু নিয়ে কর্তৃপক্ষের ভাষ্য৷ ছবিঘরে দেখুন কী কী ঘটেছে এ পর্যন্ত৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Martin
যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন
তুর্কি বাগদত্তা হাতিজে জেঙ্গিসকে বিয়ে করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে ২ অক্টোবর ইস্তানবুলের সৌদি দূতাবাসে যান সাংবাদিক জামাল খাশগজি৷ কিন্তু এরপর আর বের হননি৷ তাতেই বাইরে অপেক্ষা করতে থাকা তাঁর বাগদত্তা হাতিজে উদ্বিগ্ন হয়ে খবরটি ছড়িয়ে দেন৷
ছবি: Reuters TV
সংশয়ের ডালপালা মেলা শুরু
৩ অক্টোবর: তুর্কি ও সৌদি কর্তৃপক্ষ ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরেন খাশগজি সম্পর্কে৷ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ দাবি করে, কাজ শেষে বেরিয়ে গেছেন খাশগজি৷ তুর্কি কর্তৃপক্ষ বলে যে, দূতাবাস থেকে বেরই হননি তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. Mayo
হত্যার অভিযোগ
৬ অক্টোবর: তুরস্কের প্রশাসন জানায়, সৌদি দূতাবাসের ভেতর খাশগজিকে হত্যা করা হয়েছে৷ যে পত্রিকায় খাশগজি নিয়মিত লিখতেন, সেই মার্কিন পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, তাঁকে হত্যা করতে সৌদি আরব থেকে ১৫ সদস্যের একটি দল আসে ইস্তানবুলে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/H. Jamali
আঙ্কারা চায় প্রমাণ
৮ অক্টোবর: তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ান সৌদি আরবের কাছে খাশগজি যে বেরিয়ে গেছেন সে প্রমাণ দেয়ার দাবি জানান৷ তুরস্ক দূতাবাস প্রাঙ্গন তল্লাশি করার অনুমতি চায়৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/T. Kovacs
অনুমতি দেয় রিয়াদ
৯ অক্টোবর: দূতাবাস প্রাঙ্গন তল্লাশির অনুমতি দেয় সৌদি আরব৷ স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, ২ অক্টোবর একটি ভ্যান দূতাবাসে প্রবেশ করে৷ এরপর সেটি সৌদি রাষ্ট্রদূতের বাসায় যায়৷ এতে বিতর্ক আরো মাথাচাড়া দেয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/P. Giannakouris
অর্থনীতিতে ধাক্কা
১২ অক্টোবর: খাশগজির ঘটনায় ব্রিটিশ বিলিওনেয়ার রিচার্ড ব্রানসন তাঁর ভার্জিন গ্রুপের মহাকাশ প্রকল্পে সৌদি আরবের এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের বিষয়ে আলোচনা থামিয়ে দেন৷ রিয়াদে অনুষ্ঠেয় বিনিয়োগ সম্মেলন যোগ দেয়াও বাতিল করেন তিনি৷ উবার, জেপি মর্গানসহ বড় বড় কোম্পানির বিনিয়োগকারীরাও একই সিদ্ধান্ত নেন৷
ছবি: picture alliance/dpa
অনুসন্ধান বন্ধ নেই
১৫ অক্টোবর: তুর্কি তদন্তকারী দল দূতাবাসে তল্লাশি চালায়৷ প্রায় আট ঘন্টা ধরে এই তল্লাশি চলে এবং তদন্তকারীরা ভবন, বাগানের মাটি ও একটি ধাতব দরজা থেকে কিছু নমুনা নিয়ে আসেন৷
ছবি: Reuters/M. Sezer
হাতাহাতি থেকে মৃত্যু
১৯ অক্টোবর: সৌদি আরব এবার খাশগজির মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকার করে৷ তারা বলে যে, হাতাহাতি করতে গিয়ে দূতাবাসে মারা যান খাশগজি৷ তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল কঠোর ভাষায় জানিয়ে দেয় যে, ‘হত্যার কোনো আষাঢ়ে গল্প’ মেনে নেবে না আঙ্কারা৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল রিয়াদের ব্যাখ্যা ‘অপর্যাপ্ত’ বলে আখ্যা দেন৷
ছবি: Getty Images/C. McGrath
‘চরম ভুল’
২১ অক্টোবর: সৌদি আরব এবার আবার কথা পাল্টায়৷ তারা বলে, ওই সাংবাদিকের মৃত্যু দুর্বৃত্তদের কারণে হয়৷ এটাকে ‘বিরাট ও চরম ভুল’ বলে আখ্যা দেয় তারা৷ সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এই ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না বলে দাবি করে তারা৷ রিয়াদ বলে যে, সাংবাদিকদের লাশ কোথায় তা তাদের জানা নেই৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/C. Owen
অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয় জার্মানি
২১ অক্টোবর: আঙ্গেলা ম্যার্কেল ঘোষণা দেন যে, জামাল খাশগজির হত্যার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সৌদি আরবে অস্ত্র রপ্তানি করবে না জার্মানি৷ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের পর সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র রপ্তানি করে জার্মানি৷