খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি রদ করার সিদ্ধান্ত নেয়ায়, দিল্লির আম আদমি পার্টির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বিতর্কের মুখে৷ অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, এটা ভুল সিদ্ধান্ত৷
বিজ্ঞাপন
এতে বেকারত্ব বাড়বে, খাদ্য সামগ্রীর দাম বাড়বে আর ক্ষুণ্ণ হবে গ্রাহকদের স্বার্থ৷
ভারতের রাজধানি নতুন দিল্লিতে বিদেশি খুচরো ব্যবসা চালানোর অনুমতি না দেবার যে সিদ্ধান্ত নব নির্বাচিত আম আদমি সরকার নিয়েছে, তা অবিবেচকের মতো কাজ৷ এর ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে না, গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা হবে না, এমনকি আন্তর্জাতিক বিপণি ‘চেন' খোলার নীতি নিয়ে দেখা দেবে অনিশ্চয়তা৷ এর সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের কাছে যাবে ভুল বার্তাও৷
এ সিদ্ধান্ত এমন একটা সময়ে নেয়া হলো, যখন ভারতের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনে ব্রিটেনের টেস্কোর মতো মাল্টি-ব্র্যান্ড সংস্থাকে সামনে রেখে বিশ্বের আরো অনেক সংস্থা খুচরো ব্যবসায় ভারতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছিল৷ এ সময় এই লাল সংকেতের অর্থ এই যে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের লড়াই দুর্বল হয়ে পড়বে – এমনটাই মনে করছেন দেশের অনেক অর্থনীতিবিদ৷
ভারতে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সুফল কী হতে পারে? আর্থ-সামাজিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি মাল্টি-ব্র্যান্ড সংস্থাগুলি গুদামঘর, হিমঘর ও সাপ্লাই চেন যেভাবে বানাবে, তাতে শাক-সবজি, ফল-ফলাদির মতো পচনশীল সামগ্রীর প্রায় ৪০ শতাংশ অপচয় রোধ করা যাবে৷ এতে সরবরাহ যেমন বাড়বে, তেমনি এর ফলে খাদ্যদ্রব্যের দামও কমার কথা৷ এছাড়া, বিভিন্ন কর ও শুল্কবাবদ সরকারের অতিরিক্ত রাজস্ব বাড়বে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷
দিল্লিতে সাধারণ মানুষের জয়
দুর্নীতিবিরোধী দল ‘আম আদমি পার্টি’ দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে চমক দেখিয়েছে৷ ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে হারিয়ে শুধু দিল্লির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেনি, ভারতের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিয়েছে তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিকল্পে স্বস্তি খোঁজা
আত্মপ্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টিতে জিতেছে আম আদমি পার্টি৷ অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক নতুন একটি দলের এমন সাফল্যকে দেখছেন ‘সাধারণ মানুষের জয়’ হিসেবে৷ তাদের এ জয় কংগ্রেস তো বটেই, এমনকি এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ৷আম আদমি পার্টি লোকসভা নির্বাচনের জন্য ভোটারদের সামনে বিকল্প পছন্দ হিসেবে উঠে এসেছে৷
ছবি: Getty Images/Afp/Narinder Nanu
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ
আম আদমি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, তাঁর দল ৩২টি আসন পাওয়া ডানপন্থী দল বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে রাজ্য সরকারে অংশীদার হবে না৷ ঘুস কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল আম আদমি পার্টি৷ অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছিলেন সেই আন্দোলনের পুরোভাগে৷ দিল্লির নির্বাচনে এ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: Reuters
কংগ্রেসের ভরাডুবি
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে বড় দল কংগ্রেস৷ এবারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে সেই দল হেরে গেছে নবাগত আম আদমি পার্টির কাছে৷ ভোটাররা যে দিল্লিতে অন্তত কংগ্রেসের শাসনে ক্ষুব্ধ এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই৷ মুখ্যমন্ত্রী শীলা দিক্ষিতের নেতৃত্বে টানা ১৫ বছর রাজ্য সরকার পরিচালনা করেছে কংগ্রেস৷ এবার শীলা দিক্ষিত নিজেই হেরেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাছে৷ মাত্র ৮টি আসন পেয়েছে কংগ্রেস৷
ছবি: Reuters
নতুন পথের বাঁকে
ভারতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু করেছিলেন আন্না হাজারে৷ ৭৪ বছর বয়সি এই সমাজকর্মী সংসদে ‘জন লোকপাল বিল’ পাস করানোর দাবিতে শুরু করেছিলেন অনশন৷ অরবিন্দ কেজরিওয়ালও ছিলেন তখনকার সেই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে৷ পরে আম আদমি পার্টি গড়েন৷ ‘আম আদমি’, অর্থাৎ সাধারণ জনগণের সমর্থন নিয়ে কেজরিওয়াল এবার এক নতুন পথের বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছেন ভারতের রাজনীতিকে৷
ছবি: Reuters
‘গণতন্ত্রবিরোধী’ দাবি!
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা দুর্নীতিকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলেও এর সমাধানের উপায় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অদূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন৷ কংগ্রেস সমর্থকরা বলছেন, আম আদমি পার্টি এবং এর বাইরের সমাজকর্মীরা প্রকারান্তরে অনির্বাচিতদের কর্তৃত্বের কথা বলছেন, অথচ গণতন্ত্র নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপরই জনগণের সেবার দায়িত্ব অর্পণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ধর্ষণের বিরুদ্ধে রায়
গত এক বছরে বেশ কয়েকটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দিল্লিতে৷ ধর্ষণ রোধ করে দিল্লির নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার৷ এ ব্যর্থতার জন্য দিল্লির ভোটাররা রাজ্য সরকারকেই দায়ী মনে করে৷ বিশ্লেষকদের মতে, নারীর নিরাপত্তা বিধানে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতার কারণে জনমনে জন্ম নেয়া হতাশারও প্রতিফলন ঘটেছে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে৷
ছবি: Reuters
নতুন চ্যালেঞ্জার
দিল্লির মতো রাজস্থান, ছত্তিশগড় আর মধ্য প্রদেশের নির্বাচনেও বিজেপির কাছে হেরেছে কংগ্রেস৷ আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সেলে এমন পরাজয় কংগ্রেসের জন্য নিশ্চয়ই খুব বড় ভাবনার বিষয়৷ আম আদমি পার্টি বিধানসভা নির্বাচনে শুধু দিল্লিতেই অংশ নিয়েছে৷ তবে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনেও অংশ নেয়ার পরিকল্পনার কথা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে দলটি৷ বিজেপির জন্যও এটা কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জ!
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
এরকমটা হলে কৃষিজীবীরা ১০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি দাম পেতেন তাঁদের কৃষিপণ্য বিক্রি করে৷ সব থেকে বড় কথা, এতে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ তৈরি হতো৷ অথচ এর ফলে কাজের সুযোগ কমে যাবে – এই জিগির কিছু রাজনৈতিক নেতাদের তৈরি৷ বিগ বাজারের মতো দেশজ মাল্টি-ব্র্যান্ড রিটেলের জন্য কি কাজের সুযোগ কমে গেছে? না, যায়নি৷
সমীক্ষায় দেখা গেছে, অসংগঠিত খুচরো বাজারের চেয়ে সংগঠিত খুচরো বাজারে কর্মসংস্থান হয় বেশি৷ পাড়ার দোকানদারদের মতো অসংগঠিত ক্ষেত্র চেষ্টা করে কম কর্মচারি রাখতে এবং কম মজুরি দিতে৷ ভারতীয় শিল্প মহাসংঘের মতে, মাল্টি-ব্র্যান্ড রিটেলে সরাসরি ৩০ থেকে ৪০ লাখ চাকরি এবং পরোক্ষভাবে ৪০ থেকে ৬০ লাখের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতো৷ পরোক্ষ বলতে যাঁরা বণ্টন এবং রিপ্যাকেজিং-এর ক্ষেত্রে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক৷
যাঁরা মনে করেন বিদেশি মাল্টি-ব্র্যান্ড রিটেল ব্যবসা দেশে এলে বেকারি বাড়বে, সেই ধারণা ভ্রান্ত বলে মনে করেন টেকনোপ্যাক কনসাল্টেনসি সংস্থার চেয়ারম্যান৷ খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সুফল যে কতটা তার জলন্ত উদাহরণ চীন৷ ২০০৫ সাল থেকে মাল্টি-ব্র্যান্ডের দরজা খুলে দিয়েছে. চীন৷ তবে শুধু নীতি প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, নজর রাখতে হবে গ্রাহক ও কৃষি উৎপাদকদের স্বার্থ যেন দীর্ঘমেয়াদে সুরক্ষিত থাকে৷
খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির ব্যাপারে আগেকার কংগ্রেস সরকারের সিদ্ধান্ত উল্টে দিয়ে আম আদমি সরকার যদি মনে করে থাকে যে এটা জনগণের রায়, তাহলে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল আম জনতার রায় বুঝতে ভুল করেছেন৷ আম জনতা চেয়েছে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, প্রতিযোগিতা-বিরোধী সংরক্ষণবাদ নয়৷ এই ধরণের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আম আদমি পার্টি যদি জাতীয় দল হয়ে উঠতে চায়, তাহলে এই রকম অনেক সিদ্ধান্তকে একতরফাভাবে পাল্টাতে হবে৷ তাতে আখেরে ক্ষতি বৈ লাভ হবে না!