নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে হত্যা এবং অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ র্যাব-১১'র সাবেক কমান্ডার লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ৷ তাঁকে গ্রেফতারের পর কয়েক দফা রিমান্ডে নেয়া হয়৷
বিজ্ঞাপন
নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম কে এম মহিউদ্দীনের আদালতে বুধবার বিকেলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন র্যাব-১১-এর সাবেক কমান্ডার লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ৷ তাকে মোট ছয় দফায় ৩৪ দিন রিমান্ডে নেয়ার পর তিনি শেষ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণ এবং হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার দায় স্বীকার করলেন৷ এর আগে সকাল সাড়ে আটটায় গোপনীয়তা এবং কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তাঁকে আদালতে নেয়া হয়৷
নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, ‘‘বিকেলে বিচারকের খাস কামরায় তারেক সাঈদ সাত খুনের ঘটনায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন৷ তিনি নিজে অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন৷ তবে জবানবন্দির বিস্তারিত আর কিছু জানা যায়নি৷'' জবানবন্দি দেয়ার পর বিচারক তাঁকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন৷
লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা৷ নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত মোট চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন৷ তারা হলেন র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা মেজর আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার এম এম রানা এবং প্রধান আসামি নূর হোসেনের দেহরক্ষী চার্চিল৷
র্যাবের দুই কর্মকর্তা আগে দেয়া তাদের জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তারাসহ মোট ১১ জন র্যাব সদস্যের নাম প্রকাশ করেছেন৷ তারা জানিয়েছেন, অপহরণের পরই সাতজনকে ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করা হয়৷ পরে রাতে লাশ গুম করার জন্য শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়া হয়৷
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
গত ২৭শে এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়৷ ৩০শে এপ্রিল তাদের লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা নদীতে৷ এই ঘটনায় নিহত নজরুলের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, নজরুলের প্রতিপক্ষ নূর হোসেন র্যাব-১১'র কমান্ডার লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ এবং মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এম এম রানাকে মোট ৬ কোটি টাকা ঘুস দিয়ে সাতজনকে হত্যা করায়৷ অভিযোগের পর তিন র্যাব কর্মকর্তাকে র্যাব থেকে প্রত্যাহার এবং সেনা ও নৌবাহিনীর চাকরি থেকে অবসরে পাঠানো হয়৷ এরপর আদালতের নির্দেশে তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ৷
এই মামলার প্রধান আসামি আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন ঘটনার পর পরই ভারতে পালিয়ে যান৷ গত শনিবার তাকে কোলকাতার পুলিশ আটক করে৷ নূর হোসেনকে ৮দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সেখানকার পুলিশ৷ তাকে ভারত থেকে ফেরত আনার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেদেশের সরকারকে চিঠি দিয়েছে৷
বুধবার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেনকে কলকাতায় গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়েছে ভারত৷ ওই চিঠিতে নূর হোসেনকে গ্রেফতারের বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়ে তার ব্যাপারে আরো তথ্য চাওয়া হয়েছে৷