এ মৌসুমে ঢাকার রাস্তায় শীতের পিঠা বিক্রি করেন খুরশিদ আলম৷ বিক্রি ভালো হচ্ছে না৷ জীবনেরও নিরাপত্তা নেই৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন কিশোর৷ মাঝ বয়সে আরেক বিজয় দিবসে এসে তাঁর আক্ষেপ, ‘কেউ সাধারণ মানুষের কথা ভাবছে না৷’
ছবি: National Monument of Savar
বিজ্ঞাপন
আক্ষেপটা রাজনীতিবিদদের নিয়ে৷ খুরশিদ আলম বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে দেখেছেন৷ স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময় নিজের চোখে দেখেছেন, এক মুক্তিযোদ্ধার বাবাকে রাজাকারদের ধরে নিয়ে যেতে৷ খুরশিদ আলম তখন সাত বছরের কিশোর৷ প্রতিবেশী মুক্তিযোদ্ধার বাবা পরে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন৷ সেই রাজাকারদের একজন এখনো ভালোই আছে৷ খুরশিদ আলমের এ নিয়েও আক্ষেপ৷ স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করার মতো অভিযোগের প্রমাণিত যু্দ্ধাপরাধীদের পক্ষে দেশময় চলছে তাণ্ডব, তিনি এবং তাঁর মতো সাধারণ মানুষেরা রাস্তায় নামলে হচ্ছেন ককটেল কিংবা পেট্রোল বোমা হামলার শিকার, আয়-রোজগার বন্ধ হবার জোগাড়৷ বিজয় দিবসে তাই তাঁদের বিজয়ের আনন্দ কোথায়! ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিজয় দিবস নিয়ে তাই কোনো খুশির কথা বলতে পারেননি খুরশিদ আলম৷
[No title]
This browser does not support the audio element.
কোনো কোনো খ্যাতিমান রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতো খুরশিদ আলমও মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকাতেই দুর্ভোগ বাড়ছে সাধারণ মানুষের৷ জামায়াত-শিবির তো নয়ই, এমনকি দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিও জনদুর্ভোগ, দেশের মানুষ এবং সম্পদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে না৷ তাঁর ধারণা, দুই নেত্রী জনগণের কথা ভাবলে একটু ছাড় দিয়ে হলেও চলমান সংকট নিরসনে ভূমিকা রেখে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতেন৷
পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে মানবতা
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের জন্য বিরোধীদলের কর্মসূচিতে পুড়ছে যানবাহন, ধ্বংস হচ্ছে সম্পদ, মরছে মানুষ৷ হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো অনেকে এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সারি সারি পোড়া মানুষ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট এখন হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো জীবিকার তাগিদ কিংবা দৈনন্দিন প্রয়োজনে রাস্তায় নামা মানুষে ভরে গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
শিশুর কষ্ট বোঝেনা তারা!
কোলের শিশুও বাঁচতে পারছেন না জ্বালাও-পোড়াওয়ে হাত থেকে৷ প্রতিপক্ষের আদর্শকে ভুল প্রমাণ করে শ্রেয়তর আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নয়, প্রতিপক্ষকে আঘাত করে, হত্যা করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা অনেক দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ স্বাধীন দেশে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে পোড়ানোও দেখতে হচ্ছে৷ ৩ নভেম্বর আট বছরের সুমি দাদীর সঙ্গে নেত্রকোনা থেকে ঢাকা আসছিল৷ জয়দেবপুর চৌরাস্তায় তাদের বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বোবা কান্না...
নির্মমতার আরেকটি ছবি হয়ে আছে মজিবরের পোড়া শরীর৷ মজিবর বাকপ্রতিবন্ধী৷ কুমিল্লার দেবিদ্বারের এক ট্রাকের হেলপার৷ পিকেটারদের বোমা হামলায় বাসের সঙ্গে তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ সবাই শুনে বুঝবে এমনভাবে কথা তিনি বলতে পারেন না, বোবা কান্নায় শুধু পারেন অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে, আর্তনাদ করতে আর এ অন্যায়ের প্রতিকার আশা করতে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মেয়েকে দেখতে গিয়ে মা হাসপাতালে
জাহানারা বেগম৷ বয়স ৫২৷ পেশা – ফেরি করে কাপড় বিক্রি করা৷ হরতাল-অবরোধ থাকলে বিক্রি কমে যায় বলেই হয়তো সেদিন কাপড় নিয়ে বাড়ি বাড়ি না ঘুরে জাহানারা গিয়েছিলেন শ্যামপুরে৷ সেখানে তাঁর মেয়ের বাড়ি৷ মেয়েকে দেখে অটো রিক্সায় ফেরার সময়েই বিপদ৷ বিরোধী দলের কিছু সমর্থক সেই অটোরিক্সাতেও ছুড়ে মারে পেট্রোল বোমা৷ সন্তানের প্রতি অপত্য স্নেহের মূল্য আগুনে পুড়ে চুকাচ্ছেন জাহানারা বেগম!
ছবি: Mustafiz Mamun
তালহার অসহায়ত্ব
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা৷ শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় আবু তালহা সেই থেকে ১ নম্বর বার্ন ইউনিটে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
রাজমিস্ত্রী
রাজমিস্ত্রী ও ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদের শরীর পুড়েছে গত ১২ নভেম্বর৷ সেদিন ঢাকার রায়েরবাগেও একটি চলন্ত বাসে ছোড়া হয় পেট্রোল বোমা৷ সেই থেকে তাঁরও ঠিকানা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বাসচালক
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় শাহবাগে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো সেই বাসটি চালাচ্ছিলেন মাহবুব৷ যাত্রীদের মতো তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ তাঁর দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময়, অর্থাৎ ১৯৭১ সালেই জন্ম মাহবুবের৷ স্বাধীনতার ৪২ বছর পর দেশ পুড়ছে, তিনিও পুড়েছেন৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ঘুমের মাঝেই আগুন...
৭ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া ফেরিঘাটে বাসে ঘুমাচ্ছিলেন হেলপার আলমগীর৷ থামানো বাসেই দেয়া হয় আগুন৷ পোড়া দেহ নিয়ে এখন তিনি হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেগুনার যাত্রী
১০ নভেম্বর ঢাকার লক্ষীবাজারে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো হয় একটি লেগুনা৷ লেগুনা পুড়ে শেষ, লেগুনার যাত্রী কামাল হোসেন ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন৷ তবে শরীরের ৩৫ ভাগেরও বেশি অংশ পুড়ে গেছে৷ ৩৬ বছরের এ তরুণ লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে৷ চিকিৎসকদের চেষ্টা এবং সুস্থ মানসিকতার প্রতিটি মানুষের শুভকামনায় তিনি শিগগিরই হয়তো ফিরবেন স্বাভাবিক জীবনে৷ কিন্তু এই দুর্ভোগ, এই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো কি কোনোদিন ভুলতে পারবেন?
ছবি: Mustafiz Mamun
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুভও ছিলেন রায়েরবাগের সেই বাসে৷ তাই ১২ নভেম্বর থেকে তিনিও পোড়া শরীর নিয়ে পড়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
10 ছবি1 | 10
কোনো রকমে নিজের নাম লিখতে পারেন খুরশিদ আলম৷ সগর্বে বলার মতো পুঁথিগত বিদ্যা তাঁর নেই৷ সাত-আট বছর ধরে রাজধানীর পথচারীদের গ্রীষ্মে শরবত আর শীতে পিঠা খাইয়ে নিজের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মোটামুটি সুখের জীবনই যাপন করছিলেন৷ কিন্তু লাগাতার হরতাল-অবরোধের কারণে স্ত্রী-সন্তানকে আর নিজের সঙ্গে রাখতে পারেননি৷ আয় কমছে, দ্রব্যমূল্য বাড়ছে৷ ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, আগে যেখানে শীতে প্রতিদিন তিন হাজার টাকার পিঠাও বিক্রি হতো, সেখানে এ বছর সাকুল্যে আসে গড়ে আটশ থেকে এক হাজার টাকা৷ রাজধানীতে পরিবার নিয়ে আর থাকা হয়নি৷ খরচ কমাতে হবিগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন পরিবারের অন্য সদস্যদের৷
গ্রামেও যে স্ত্রী-সন্তান নিরাপদে, নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে তা-ও নয়৷ রাজনীতির বিষবাস্প গ্রামাঞ্চলকেও গ্রাস করেছে৷ ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ সেখানেও হয়৷ ঢাকায় নিজের চোখে গাড়ি পোড়াতে দেখেন, দেখেন ফুটপাতে উঠে পড়া গাড়িতে চাপা পড়ে পথচারীকে হাসপাতালে যেতে, নিজের আর স্ত্রী-সন্তানের জীবন নিয়ে দুর্ভাবনা সব সময় তাড়া করে তাঁকে৷ তবুও ভ্যান নিয়ে রাস্তায় নামতে হয় প্রতিদিন৷ পিঠার ভ্যানের চাকা না ঘুরলে তো খুরশিদ আলমের জীবনের চাকাও ধীরে ধীরে থেমে যাবে!