পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং চা ভুবন-বিখ্যাত। অপরূপ চা বাগানের ভিতরে ঢুকলে অন্ধকারের কাহিনি সামনে আসে। ডিডাব্লিউ-র বিশেষ রিপোর্ট।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি দার্জিলিংয়ে গিয়ে চা-পর্যটনের কথা বলে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যা শুনে মাথায় হাত চা বাগানের লাখ লাখ শ্রমিকের। প্রকাশ্যে তাদের অনেকে এর বিরোধিতা শুরু করেছেন। বিরোধিতা করেছেন চা বাগান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরাও।
দার্জিলিং পাহাড় থেকে পাহাড়ের পাদদেশে তরাই এবং ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ জমি চা বাগানের জন্য বিখ্যাত। খাতায় কলমে প্রায় ২৮৩টি চা বাগান আছে এই অঞ্চলে। বাস্তব সংখ্যা আরো বেশি। পাহাড়ের চেয়ে ডুয়ার্স-তরাইয়ে চা বাগানের সংখ্যা বেশি। চা বাগানের আয়তনও বেশি। দার্জিলিং পাহাড়ের চা বিশ্বখ্যাত হলেও পরিমাণে অনেক বেশি চা তৈরি হয় ডুয়ার্স এবং তরাইয়ে। দিগন্ত বিস্তৃত সেই চা বাগান দৃশ্যত অপূর্ব হলেও সাম্প্রতিককালে এই শিল্প চরম সংকটের মুখোমুখি। গত এক দশকে একের পর এক বাগান বন্ধ হয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ চরমে পৌঁছেছে। চা বাগানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
সংকটের কাহিনি
চা মালিকদের একটি বড় অংশের দাবি, চা বিক্রি করে যথেষ্ট লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না তারা। বিরাট বিরাট চা বাগান রক্ষাণাবেক্ষণ করে, শ্রমিকদের পাওনা মিটিয়ে চা বাগান চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িযেছে। সে কারণেই গত এক দশকে একের পর এক বাগান বন্ধ হয়েছে বলে তাদের দাবি। বছর দশেক আগে বাগান বন্ধ করে দেওয়া এক মালিক নাম প্রকাশ করা যাবে না এই শর্তে ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''সরকার কেবলমাত্র শ্রমিকের স্বার্থ দেখে। মালিকদের সমস্যাগুলি বোঝার চেষ্টা করে না। সে কারণেই চা বাগানের সমস্যার কোনো সমাধানসূত্র মেলে না।'' বস্তুত, চা বাগান থেকে যে লাভ কমে গেছে, তা মেনে নিয়েছেন বিখ্যাত বাগান গিদ্দাপাহাড়ের মালিকও। ১৮৮০-র দশকে তৈরি এই বাগানের চতুর্থ প্রজন্মের মালিক শুধাংশু সাউ ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''চা থেকে আগের মতো আর লাভ পাওয়া যায় না। করোনাকালে বাজারের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বহু বছর সময় লাগবে।'' শুধাংশুর বক্তব্য, চা বাগানের সমস্যার নানা পরত আছে। বিষয়গুলি জটিল। সকলের স্বার্থের কথা না ভাবলে বাগান বাঁচানো কঠিন।
দুর্দশা, যন্ত্রণার আরেক নাম চা শ্রমিক
ধীরে ধীরে খুলছে বহু বন্ধ বাগান। কিন্তু শ্রমিকের দুর্দশা কমছে না। ন্যূনতম পারিশ্রমিকটুকুও পান না পশ্চিমবঙ্গের চা শ্রমিকেরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
একনজরে বাগান
পাহাড়, ডুয়ার্স এবং তরাই মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কমবেশি ২৮৩টি চা বাগান আছে। তার মধ্যে হিমালয়ের পাদদেশে তরাই এবং ডুয়ার্সে বাগানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রায চার লাখ কর্মী চা বাগানের সঙ্গে যুক্ত। তারা বিভিন্ন চা বাগানের বস্তিতে থাকেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বন্ধ বাগান
গত এক দশকে প্রায় একশটি চা বাগান বিভিন্ন সময়ে বন্ধ হয়েছে। দার্জিলিং পাহাড়, ডুয়ার্স, তরাই সর্বত্র চা বাগান বন্ধ হয়েছে। কাজ হারিযেছেন হাজার হাজার শ্রমিক। অভাবে মৃত্যু হযেছে বহু শ্রমিকের। তারই মধ্যে এসেছে করোনাকাল। কাজ বন্ধ থেকেছে খোলা বাগানেরও। তবে ২০২২ সাল থেকে ফের খুলতে শুরু করেছে বহু বন্ধ বাগান। আগামী কয়েকমাসের মধ্যে প্রায় সব বাগানই খুলে যাবে বলে মনে করছেন চা বাগান আন্দোলনের কর্মীরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
যন্ত্রণার শেষ নেই
বাগান খুললেও যন্ত্রণা কমেনি শ্রমিকদের। বহু বাগানে কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রতিটি বাড়ি থেকে কেবল একজন বাগানে কাজ করতে পারবেন। কর্মীদের অভিযোগ, তাদের নিয়মিত সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে না বাগান মালিকেরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কী কী পাওয়ার কথা
মজুরি ছাড়া বাগান শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, রান্নার কাঠ, স্বাস্থ্য পরিষেবা, কর্মীর সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা-সহ একাধিক পরিষেবা দেয়ার কথা বাগান মালিকদের। এর জন্য কর্মীদের মজুরি থেকে টাকাও কাটা হয়। কিন্তু বাস্তবে সব পরিষেবা পাওয়া যাচ্ছে না বলে কর্মীদের অভিযোগ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
১৫ শতাংশ বৃদ্ধি
কয়েকমাস আগেও চা কর্মীরা ২০২ টাকা দৈনিক মজুরি পেতেন। অতি সম্প্রতি ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে তা ২৩২ টাকা করা হযেছে। এই টাকাও তারা সবসময় পান না বলে অভিযোগ। ভারতে এখন অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ৩৬৯ টাকা। কিন্তু চা শ্রমিকদের এই তালিকায় ফেলা হয় না। তাদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি এর চেয়ে অনেক কম। চা কর্মীরা এখন দৈনিক ২৩২ টাকা পান।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অক্লান্ত পরিশ্রম
সকাল সাড়ে সাতটায় বাগানে পৌঁছাতে হয় চা শ্রমিকদের। দুপুরে আধঘণ্টার বিরতি পান তারা। তারপর ফের কাজে নেমে পড়তে হয়। ছুটি হয় চারটের সময়। পাতা তোলার কাজ করেন মূলত মেয়েরা। বাড়ি থেকে জল নিয়ে বাগানে যান কর্মীরা। অভিযোগ, সেই জল শেষ হয়ে গেলে সামান্য খাওয়ার জলটুকুও তাদের দেয়া হয় না। বাগানে জলের ট্যাঙ্ক যাওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ সময় তা পাওয়া যায় না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
এভাবেই থাকে শিশুরা
বাগানের ধারে এভাবেই শিশুদের রেখে কাজে চলে যান মায়েরা। সারাদিন শিশুদের খোঁজও নিতে পারেন না তারা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মায়ের অপেক্ষায়
মায়ের জন্য অন্তহীন অপেক্ষায় কোলের শিশু। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে তারা। তাদের কান্নাটুকু শোনার জন্যেও কেউ নেই।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বন্ধ বাগানের কর্মীরা
বন্ধ চা বাগানের কর্মীরা এভাবেই অন্য বাগানে চলে যান ভাগ খাটতে। প্রয়োজন মতো বিভিন্ন বাগান তাদের দিয়ে কনট্রাক্টে কাজ করায়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ওজন এবং পরোটা
প্রতিদিন দুইবার পাতার ওজন হয়। দিনে গড়ে ২৪ কেজি পাতা তুলতে হয় শ্রমিকদের। বেশি তুললে কেজি প্রতি সাড়ে তিন টাকা করে অতিরিক্ত টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু কম তুললেই পরোটা। প্রো রেটা বেসিসে মজুরি কমানো হয়। চা বাগানে সেই প্রো রেটা মুখে মুখে হয়ে গেছে 'পরোটা'।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রেশনের লাইন
আগে চা বাগান থেকে কর্মীদের রেশন দেওয়া হতো। এখন সরকার দেয়। তাই বাগান আর দেয় না। সপ্তাহের চাল-ডাল নেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে কর্মীরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মাসের রোজগার
প্রতিদিন কাজ করতে পারলে মাসে হাজার চারেক টাকা রোজগার হয় একজন কর্মীর। সেই টাকা থেকেই বিদ্যুতের বিল, ছেলেমেয়ের স্কুলে খরচ, রান্নার গ্যাস, ওষুধপত্রের টাকা দিতে হয় কর্মীদের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সরকার কোথায়
চা বাগান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বক্তব্য, বহু আন্দোলনের পর সরকারের হস্তক্ষেপে ১৫ শতাংশ মজুরি বেড়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় যা নেহাতই কম। চা শ্রমিকদের বক্তব্য, কোনো রাজনৈতিক দলই তাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না।রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারও তাদের কথা ভাবছে না বলে অভিযোগ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
হতাশ কর্মীদের কথা
হতাশ কর্মীরা পরের প্রজন্মকে আর চা বাগানে রাখতে চান না। চা কর্মীদের নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের বক্তব্য, গত কয়েকদশকে বাগান থেকে পালাতে গিয়ে নারীপাচার চক্রের হাতে পড়তে হয়েছে বহু মেয়েকে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
14 ছবি1 | 14
মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের জের
এই পরিস্থিতির মধ্যেই চা বাগান নিয়ে মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চা বাগানের লাভ বাড়ানোর জন্য চা পর্যটনের কথা বলেছেন তিনি। চা বাগানগুলিতে হোম স্টে তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। বস্তুত, কিছুদিন আগেও চা বাগানের সমস্যায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য সরকারের তরফে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করেছিলেন তিনি। যার জেরে এখন ২৩২ টাকা দৈনিক মজুরি পাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের চা শ্রমিকরা।
দার্জিলিংয়ের কোনো কোনো চা বাগানে ইতিমধ্যেই হোম স্টে তৈরি হয়েছে। পর্যটকরা সেখানে বেড়াতেও যাচ্ছেন। কিন্তু আদৌ কি এই ভাবে চা শিল্পকে বাঁচানো যাবে? এ প্রশ্ন তুলছেন খোদ বাগানের শ্রমিকরা। তাদের বক্তব্য, চা গাছ কেটে সেখানে হোটেল তৈরি করে চা বাগানকে বাঁচানো যাবে না। এতে বাগানের ক্ষতি আরো বাড়বে। দীর্ঘদিন ধরে চা বাগানে ট্রেড ইউনিযন আন্দোলন করেন বামপন্থী রাজনীতিক সমন পাঠক। শিলিগুড়িতে সিপিএমের পার্টি অফিসে বসে ডিডাব্লিউকে তিনি জানিয়েছেন, ''চা শ্রমিকদের সমস্যা না মিটলে চা বাগান বাঁচানো কঠিন। সরকার এবং মালিকপক্ষ ওই বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। বাগানে পর্যটন গড়ে তুলে সাময়িক সমস্যার সমধান হতে পারে কিন্তু চা বাগানের ভবিষ্যত বদলানো যাবে না।''
চা শ্রমিকদের বিষয়টি যে গুরুত্বপূর্ণ তা মানেন পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা অলোক চক্রবর্তী। তিনিও দীর্ঘদিন ধরে চা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। ডিডাব্লিউকে তিনি জানিয়েছেন, ''চা বাগানের উন্নতির বিষয়টি নিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মাথা ঘামাচ্ছেন। সে কারণেই দৈনিক মজুরি বাড়ানো হয়েছে। বন্ধ চা বাগানগুলি খোলার উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য সরকার। আগামী এক মাসের মধ্যে প্রায় সবকটি বাগান নতুন করে খুলে যাবে।'' বস্তুত, গত কয়েকমাসে অধিকাংশ বন্ধ বাগানই নতুন করে খুলেছে। একাধিক বাগানে নতুন মালিক এসেছে।
শ্রমিকদের বক্তব্য
পাঁচবছর, দশবছর ধরে বন্ধ থাকার পর নতুন করে বাগান খুলতে শুরু করেছে। শিলিগুড়ি শহর থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে তেমনই এক চা বাগান গঙ্গারাম। ২০১২ সালে বাগান বন্ধ হয়ে গেছিল। অতি সম্প্রতি নতুন মালিক বাগানে আসতে শুরু করেছে। বাগানের সবকটি সেকশনে কাজ শুরু না হলেও ধীরে ধীরে বাগান নতুন করে সেজে উঠছে। গঙ্গারাম যখন বন্ধ হয়ে গেছিল, বাগানের শ্রমিকরা তখনো নিজেদের মতো করে বাগান চালিয়েছিলেন। পাতা তুলে কনট্রাক্টরের মাধ্যমে তারা অন্য কারখানায় পাতা পাঠাচ্ছিলেন। দাঁতে দাঁত চেপে তারা লড়াই চালিয়ে গেছেন। নতুন করে বাগান খোলার খবরে তারা খুশি। কিন্তু একইসঙ্গে তাদের প্রশ্ন, পুরনো পাওনাগুলি মিলবে তো?
বাগান থেকে ‘চা’-এর কাপে আসার গল্প
শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে চোখ জুড়ানো বেশ কিছু চা বাগান৷ সেসব বাগানের চা বাগান থেকে কিভাবে চায়ের কাপে আসে তারই গল্প থাকছে এই ছবিঘর-এ৷
ছবি: DW/M. Mamun
চা বাগান
চা বোর্ডের হিসেবে পুরো বাংলাদেশে চা বাগান রয়েছে মোট ১৬২টি৷ তার মধ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাগানসহ মৌলভীবাজার জেলায় মোট বাগানের সংখ্যা ৯০টির মতো৷
ছবি: DW/M. Mamun
চা শ্রমিক
সেই কাক ডাকা ভোরে উঠে চা শ্রমিকরা পাতা তুলতে শুরু করেন৷ যাঁর চা পাতার ঝুলির ওজন বেশি হয়, তিনি পারশ্রমিক বেশি পান৷ তাই তাঁদের মধ্যে সব সময় এক ধরনের তাড়া কাজ করে৷
ছবি: DW/M. Mamun
চা কন্যা
চা শ্রমিকদের মধ্যে নারীই বেশি৷ চা শ্রমিক, চা শিল্পী, চা কন্যা বা পাতিয়ালী – যে নামেই তাদের ডাকা হোক না কেন, তাঁরা কঠোর পরিশ্রমী৷
ছবি: DW/M. Mamun
এবার মাপার পালা
পাতা তোলার পর কে কতটা তুলেছেন তা মাপা হয় বাগানেরই কাছের ছোট এক কুটিরে৷ চা পাতার ওজন অনুপাতেই শ্রমিকরা তাঁদের পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন৷ পাতা মাপার পর এক ফাঁকে ঝটপট বাড়ি থেকে নিয়ে আসা নাস্তাটা তাঁরা সেরে নেন৷ আবার যে বাগানে যেতে হবে !
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
কারখানায় যাচ্ছে পাতা
মাপার পর এবার পাতা যাচ্ছে চা কারখানায়৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
পাতা বহমান
কারখানায় পৌঁছানোর পর ছোট ছোট ব্যগে করে ইলেক্ট্রিক মেশিনের সাহায্যে ঘুরে ঘুরে পাতা যাচ্ছে আরেক জায়গায়৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
ছড়ানো পাতা
এখানে পাতাগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ভালো করে পরিস্কার করে বেছে নেওয়া হবে৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
পাতার সোঁদা গন্ধ
পাতা পরিস্কারের পর এবার যাচ্ছে মেশিনে৷ কয়েকটি মেশিনে একসাথে কাজ হচ্ছে৷ মেশিনে ‘প্রসেস’ হওয়ার সময় সবুজ পাতা কেমন যেন এক সোঁদা আর মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
বদলে যায় রং
এবার চা পাতা শুকানোর পালা৷ এরই মধ্যে এই মেশিনের গরম তাপে চা পাতার রং বদলে গিয়ে গাঢ় বাদামী হয়ে গেছে৷ চা বাগানে ঘোরাঘুরির পর তৈরি গরম চায়ের গন্ধ, চেহারা আর হাত দিয়ে ধরে দেখার অনুভূতি কিন্তু চা প্রেমীদের কাছে দারুণ রোমাঞ্চকর !
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
গুণগত মান পরীক্ষা
গুড়ো চা শুকিয়ে যাবার পর এবার গুণগত মান পরীক্ষার পালা৷ চা টেস্টের পর সব ঠিক থাকলেই কেবল তা বড় বড় বস্তায় ভরে প্যাকিং এবং রপ্তানির জন্য পাঠানো হয় চট্টগ্রামে৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
শেষ ধাপ: ‘চা’ এলো কাপে
চট্টগ্রামের কারখানা থেকে প্যাকেট হয়ে বাজারে আসে চা৷ তারপর তো দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির সেই চা আমাদের কাপে৷ ‘চা’-এর তুলনা শুধু চা-ই৷
ছবি: DW/N. Sattar
সব সময়ের সঙ্গী ‘চা’
উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় ‘চা’৷ ফিনলে চা কারখানার দেয়ালে লাগানো বোর্ডের এই কথাগুলো কতটা সত্যি, তা মনে হয় যে কোনো চা প্রেমীই জানেন৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
12 ছবি1 | 12
চা বাগানের হিসেব
চা বাগানের মজুরি বরাবরই কম। দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের দৈনিক ন্যূনতম মজুরির চেয়ে অনেক কম দৈনিক মজুরি পান চা শ্রমিকরা। মালিকদের বক্তব্য, দৈনিক মজুরির পাশাপাশি একাধিক সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় চা শ্রমিকদের। সেই বিষয়টিকেও হিসেবের মধ্যে আনতে হবে। বস্তুত ব্রিটিশদের তৈরি চা বাগানের মূল কাঠামো এখনো একই আছে। কর্মবিভাজন থেকে শুরু করে শ্রমিকদের জন্য ব্যবস্থা, সবই ঔপনিবেশিক আমলের নিয়মে চলে। দৈনিক মজুরির পাশাপাশি চা শ্রমিকদের বাসস্থান দেওয়া হয়, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, বাড়ি সংস্কারের টাকা, জ্বালানি-সহ আরো বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার বিষয়টিও চা মালিকদের দেখার কথা। একসময় শ্রমিকদের রেশনও দেওয়া হতো। এখন সরকার বিনামূল্যে রেশন দেয় বলে মালিকরা তা দেয়া বন্ধ করেছেন।
শ্রমিকদের বক্তব্য, খাতায় কলমে এইসব সুযোগ সুবিধার কথা বলা হলেও বাস্তবে এর অধিকাংশই মিলছে না। সুযোগ সুবিধা দেওযার নামে দুর্নীতি হচ্ছে বলেও অভিযোগ করছেন কেউ কেউ। গঙ্গারাম চা বাগানের কর্মী দুর্গা ওরাও ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''পরিস্থিতি এমনই যে স্বামীর চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারিনি। চা বাগান কোনোরকম সাহায্য করেনি। ইউনিয়নের নেতাদেরও দেখতে পাইনি। ওরা শুধু ভোটের সময় আসে।'' চা বাগানের ধারে ছোট্ট দোকান বানিয়েছেন দুর্গা। দোকানের পাশে প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দলের পতাকা। সে দিকে তাকিয়ে রাজনীতিবিদদের প্রতি নিজের ক্ষোভ উগড়ে দিলেন দুর্গা।
ডুযার্স-তরাইয়ের অধিকাংশ চা বাগানের কর্মীর বক্তব্যের সঙ্গে দুর্গার কথা মিলে যায়। আলিপুরদুযারে ভুটান সীমান্তে ছবির মতো সুন্দর চা বাগান তুরতুরি। বছরদুযেক আগে মালিক বদলেছে। কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্যে চাপা ঘোরেনি। শ্রমিকেরই মজুরি থেকে কেটে নেওয়া গ্র্যাচুইটির টাকা দিচ্ছে না মালিক। ওই টাকাই অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। তুরতুরির চা কোয়ার্টর্সে কেবলই হাহাকার। সম্প্রতি একাধিক অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক মারা গেছেন। কিন্তু এখনো তাদের গ্র্যাচুইটির টাকা ঢোকেনি। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাও বছরের পর বছর ধরে আটকে আছে অনেকের। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। ঘরের চাল ফুটো, বাড়ি পাকা হয়নি, ছেলে মেয়েকে পড়ানো যাচ্ছে না-- এমন ঘটনা চা বাগানের ঘরে ঘরে।
চা শিল্পীদের জীবন যেমন
সস্তা পানীয় চা৷ সেই পানীয়ের তৃপ্তি দিতে সবচেয়ে সস্তায় শ্রম দেন তাঁরা৷ তাঁরা চা শ্রমিক৷ চা শিল্পের প্রকৃত শিল্পী৷ তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু ছবি তুলে এনেছেন খোকন সিং৷
ছবি: Khukon Thaunaujam
দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি
চা গাছের এমন দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি থেকেই আমরা পাই সুপেয় চা৷ বাংলাদেশে এক সময় শুধু বৃহত্তর সিলেট জেলাতেই চা বাগান ছিল৷ সিলেটের অন্য নাম তাই ‘দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ’৷ ধীরে ধীরে বাংলাদেশে চায়ের রাজ্য বেড়েছে৷ চা বোর্ডের হিসেব অনুযায়ী, এখন মোট ১৬২টি চা বাগান রয়েছে বাংলাদেশে৷ এর মধ্যে ৯০টি মৌলভীবাজার জেলায়, ২৩টি হবিগঞ্জ, ১৮টি সিলেট, ২১টি চট্টগ্রাম এবং বাকি ৯টি পঞ্চগড় জেলায়৷
ছবি: Khukon Singha
চা শিল্পী
তাঁদের অক্লান্ত শ্রমেই গড়ে ওঠে চা বাগান, বাগান থেকে তাঁদের হাতই তুলে আনে ‘দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি’, তাঁদের শীর্ণ পিঠে চড়েই কারখানায় যায় সোঁদা গন্ধের পাতার বোঝা৷ তাঁরা চা শ্রমিক৷ চা শিল্পের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিল্পীও তাঁরা৷ বাংলাদেশে এমন ‘শিল্পী’ এখন ১ লাখ ২২ হাজারের মতো৷
ছবি: DW/K. Thaunaujam
বেশি ঘাম, অল্প আয়
চা শিল্পের সূচনালগ্নে ফিরে যাওয়ার দরকার নেই৷ তিন দশক আগের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলেও চা শিল্পের বিস্তারের সঙ্গে শ্রমিকের অবস্থার উন্নতির দৃষ্টিকটু পার্থক্যটা স্পষ্ট হবে৷ তিন দশক আগে একজন চা শ্রমিক পাহাড়ি বাগানের রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সারাদিনের কাজ শেষে পেতেন সাত টাকা, এখন ‘হাজিরা’ বা মজুরি ৮৫ টাকা৷ এই দুর্মূল্যের বাজারে চা শ্রমিকের মাসিক আয় দু’হাজার টাকার চেয়ে সামান্য বেশি৷
ছবি: Khukon Thaunaujam
‘লেবার লাইনের’ ঘুপচি
চা বাগানেই চা শ্রমিকদের বাস৷ বাগানের ‘লেবারার’, অর্থাৎ শ্রমিকেরা এক পাড়ায় থাকেন বলে পাড়ার নাম হয়ে গেছে ‘লেবার লাইন’৷ ৮ হাত বাই ১২ হাতের এক টুকরো জমির ওপর গড়ে তোলা মাটির ঘরে গাদাগাদি করে থাকে শ্রমিক পরিবার৷ কোনো কোনো পরিবারে ৮ থেকে ১০ জন সদস্য৷ ওই ৮ বাই ১০ বাই ১২ হাতের জায়গাটুকুই কিন্তু সম্বল!
ছবি: Khukon Thaunaujam
শিশু শিক্ষায় শত দুর্ভোগ
২০০৭ সালেও চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ছিল মাত্র ৩৫ টাকা৷ এখন তা বেড়ে ৮৫ টাকা হয়েছে৷ এ আয়ে সংসারই চলে না, সন্তানদের লেখাপড়া শেখাবেন কী! কোনো কোনো বাগানে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে৷ অনেকগুলোরই ছাদ আছে তো, দেয়াল নেই৷ প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষকও অনেক কম৷
ছবি: Khukon Thaunaujam
চিকিৎসাসেবা
বেশির ভাগ বাগানে শ্রমিকের চিকিৎসার সুব্যবস্থাও নেই৷ জটিল রোগের চিকিৎসা তো দূরের কথা, সর্দি-জ্বারের চিকিৎসাও সময়মতো পাওয়া মুশকিল৷ হাসপাতালের বারান্দায় বসে ডাক্তারের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে গুণতেই বেলা বয়ে যায়৷
ছবি: Khukon Thaunaujam
উৎসবের আনন্দে
রিলে, হাজরা, হারাম, সাঁওতাল, সাধু, টগর, মুন্ডাসহ অনেকগুলো নৃগোষ্ঠীর মানুষ আছে চা শ্রমিকদের মাঝে৷ তাই ছোট-বড় নানা ধরণের উৎসব লেগেই থাকে সারা বছর৷
ছবি: Khukon Thaunaujam
টিকে থাকার সংগ্রাম
চা বাগানের মজুরিতে সংসার চলে না বলে বাড়তি উপার্জনের জন্য শ্রমিকদের অবসর সময়েও কিছু না কিছু করতে হয়৷ ঘরে তৈরি বিভিন্ন পণ্য বাজারে বিক্রি করেও দ্রব্যমূ্ল্যের ঊর্ধগতির সময়ে টিকে থাকছেন অনেকে৷
ছবি: Khukon Thaunaujam
পরের জায়গা পরের জমি...
দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে চা-বাগান সংলগ্ন জমিকেই নিজের জমি মনে করে সেখানে বংশ পরম্পরায় চাষবাষ করে আসছে শ্রমিক৷ সেই জমিও হাতছাড়া হলে ৮৫ টাকা মজুরির শ্রমিক বাঁচবে কী করে? গত বছর তাই বাগানের লিজ নেয়া জমিতে সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক জোন করার পরিকল্পনা করায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল হবিগঞ্জের কয়েকটি বাগানের শ্রমিক৷ মৌলভীবাজার এবং সিলেটের অনেক শ্রমিকও যোগ দিয়েছিল ভূমি রক্ষার সে আন্দোলনে৷
ছবি: Khukon Singha
9 ছবি1 | 9
সামসিং চা বাগানের অনিল প্রধান বলছিলেন, ''মালিক বদলালেও চা শ্রমিকদের কোনো সুবিধা হচ্ছে না। পুরনো বাগান নতুন মালিক কিনছেন ঠিকই কিন্তু পুরনো মালিকের দায় তিনি নিচ্ছেন না। কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে, শর্ত চাপিয়ে দেওযা হচ্ছে। ফলে শেষপর্যন্ত চা শ্রমিক গরিব থেকে আরো গরিব হচ্ছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে। কোনো শ্রমিক পরবরতী প্রজন্মকে বাগানে পাঠাতে চান না।''
চা বাগান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন আইআইটি-র গবেষক অনির্বাণ নন্দী। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেছেন, ''ঔপনিবেশিক গঠন থেকে চা বাগান বেরিয়ে আসতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে বাগান বাঁচানো অসম্ভব। চা শ্রমিকদের উন্নতি করতেই হবে। নইলে পরবর্তী প্রজন্মকে পাওয়া যাবে না। আর শ্রমিক ছাড়া চা বাগান চলবে না।'' অনির্বাণ জানিয়েছেন, গত কযেকবছরে বাগানে নারীপাচারের ঘটনা ঘটেছে। নাবালক ছেলেমেয়েদের লেবারের কাজে পাঠিয়ে দিয়েছেন বহু চা শ্রমিক। চা শ্রমিকদের সার্বিক দুর্দশা দৃশ্যত প্রকট।
চা বাগানের সমস্যা একটা নয়, অনেক। আবহাওয়াও সমস্যা তৈরি করছে। আগে যে পরিমাণ চা পাতা পাওয়া যেত, এখন তা পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন মালিকরা বাগানে বিনিয়োগ করে চটজলদি লাভের কথা ভাবছেন। শ্রমিকদের উপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে এক ভযাবহ পরিস্থিতি। এখান থেকে উত্তরণ হবে কীভাবে, তা কেবল অদৃষ্টই জানেন।