নাজমুল আবেদিন ফাহিম ক্রিকেট কোচ এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক গেম ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার৷ কর্মরত ছিলেন বিকেএসপিতেও৷ ক্রিকেটারদের আচরণ, দায়বদ্ধতা, শিক্ষাসহ নানা বিষয়ে তিনি ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে: ক্রিকেটার তানজিম হাসান সাকিব যদিও তার ফেসবুক পোস্টের জন্য বোর্ডের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন৷ ক্রিকেটারদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত?
নাজমুল আবেদিন ফাহিম: পাবলিক ফিগার হিসেবে যে কোনো পেশারই হোক না কেন তাদের একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে৷ তাদেরকে মানুষ অনুসরণ করে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম৷ তাদের আচার, ব্যবহার, কথাবার্তা সবকিছু যেন একটা শৃঙ্খলার মধ্যে থাকে।
তারা যখন ক্রিকেট খেলা শুরু করেন তখন খেলার বাইরেও এইসব ব্যাপারে আলাদা করে যত্ন নেয়া হয় কিনা?
এসব ব্যাপার যে খুব বেশি কিছু করা হয় তা নয়৷ আমাদের এখানে যারা ক্রিকেট খেলতে আসে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে তাদের অনেক কিছুই তখন প্রকাশ পায় না৷ তখন আধুনিক জীবন-যাপন, চিন্তা এগুলোর অনেক কিছুর সাথে তাদের যোগাযোগ থাকে না৷ আস্তে আস্তে বিষয়গুলো আসে৷ এটা ওদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ৷ অনেক কম বয়সে একটা ছেলের যখন নাম হবে , অর্থ হবে এগুলোর একটা প্রভাব তো তাদের জীবনে থাকবেই৷ ফলে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে ওরা এগুলো কীভাবে সামলে উঠবে৷ জীবনকে কীভাবে সামলে নিবে৷ এগুলো ওদের কর্মসূচীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি৷ কারণ তাদের পারফর্মেন্সের ক্ষেত্রে এগুলোর একটা ভূমিকা থাকে৷ এগুলো সামলাতে না পারলে ভালো পারফর্ম করা কঠিন বা দীর্ঘ সময় পারফর্ম করা সম্ভব নয়৷ তাই তাদের আচার ব্যবহারের সঙ্গে তাদের চিন্তা ভাবনা কেমন হবে সেটাও গাইড করা দরকার৷
এসব ব্যাপারে খুব বেশি কিছু করা হয় না: ফাহিম
এই বিষয়গুলো তাদের প্রশিক্ষণে কীভাবে যুক্ত করা যায়৷ বিসিবি কীভাবে করতে পারে?
একটা তো আছে শিক্ষার মাধ্যমেই করা যায়৷ অনেক ধরনের সামাজিক প্রোগ্রামের মাধ্যমেও করা যায়৷ আমরা সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলি৷ প্র্যাকটিক্যালি ওদের অনেক জায়গায় যুক্ত করা যায়৷ একটি স্কুলে যেতে পারে৷ একটি হাসপাতালে যেতে পারে৷ এসব জায়গায় গিয়ে তারা সমাজের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মিশবে৷ অবদান রাখার চেষ্টা করবে৷ এটা তাদের উপলব্ধি বাড়াবে৷ তারা বুঝতে পারবে যে তারা মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে৷ তাদের একটি কথার সমাজে প্রভাব অনেক৷ এতে তাদের দায়িত্ববোধ বাড়বে৷ তারা বুঝবে খেলার বাইরে তাদের অনেক কিছু করার আছে।
অন্য দেশের ক্রিকেট বোর্ড কি খেলার বাইরে এই আচার ব্যবহারের বিষয়গুলো শেখায়? আপনার অভিজ্ঞতা কী?
এটা যে ক্রিকেট বোর্ডকেই করতে হবে সেরকম নয়। ওইসব দেশে ওরা যে পরিবেশে থাকে, যে স্কুলে পড়ে সেখানে সব পরিবেশেই এই ব্যাপারগুলো থাকে৷ আমাদের এখানে যেহেতু থাকে না তাই আমাদের সচেতনভাবে প্রোগ্রাম করা উচিত৷ যাতে এটার মধ্য দিয়ে ওরা বুঝতে পারে খেলার বাইরেও ওদের গুরুত্ব কতটুকু৷ ওরা খেলার বাইরেও সমাজে ভূমিকা রাখতে পারে৷ অষ্ট্রেলিয়ান একটি ছেলে যদি রাশিয়ান টিমে খেলে তার জীবন যাত্রার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসবে না৷ সে কিন্তু এই প্রথম একটা ফাইভ স্টার হোটেলে ঢুকবে বা থাকবে তা কিন্তু নয়৷ কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে সেটা হবে৷ ফলে বাইরের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য অনেক বেশি৷ এটা মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে৷
পাঠ্যপুস্তকে অনেক উপাদান ঢুকেছে যা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ বিকেএসপির পাঠ্যপুস্তকেও তাই৷ আবার সমাজে নানা নেতিবাচব উপাদান যুক্ত হচ্ছে৷ এর প্রভাবও কি তাদের উপর পড়ছে?
না আমার মনে হয় এবার যেটা ঘটেছে সেটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা৷ তা না হলে এখানে তো জাতীয় দলের অনেক খেলোয়াড় আছে৷ সবার ক্ষেত্রে তো ঘটছে না৷ ঘটছে এই কারণে যে ওদের আমরা সেই এক্সপোজারটা দিচ্ছি না৷ সচেতন করছি না৷ ওদের আমরা অনেক কিছু দেখাতে পারিনি৷ ফলে হঠাৎ করে একটা কিছু দেখলো, তার কাছে মনে হলো ওইটাই সেরা৷ ফলে ওইখানে আটকে যায়৷ তাই আমাদের তাদেরকে ওইভাবে সচেতন করতে হবে৷ যাতে তারা সঠিকটা বুঝতে পারে৷
আরো কয়েকজন তারকা ক্রিকেটারের আচরণ তো সমালোচিত হয়েছে৷ তারা অগ্রহণযোগ্য আচরণ করেছেন৷ এগুলো কি তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা? না তাদেরও সচেনত করতে হবে?
সব ক্ষেত্রেই, সব ব্যাপরে সচেতন করতে হবে৷ আমরা বলি ওরা স্কুল, কলেজে পড়েছে৷ সত্যিকারভাবে, সেই অর্থে শিক্ষিত তো তারা না৷ স্যোশাল নর্মস এর কথা বলি, ভ্যালুজ ও এথিকস-এর কথা বলি, এই শিক্ষাগুলো তো ওদেরকে আমরা দিতে পারি নাই৷ আমরা ওদের কাছ থেকে খেলাটাই আদায় করে নিয়েছি৷ এর বাইরে অন্য কিছু সেভাবে চিন্তা করি নাই৷ আসলে আরো বড় করে চিন্তা করা দরকার৷ তাদের বেড়ে ওঠা, মানবিক বিষয়, এগুলো দেখা দরকার৷ কারণ খেলাটাই তো শেষ কথা নয়৷ তাদেরকে ভালো নাগরিক হতে হবে৷ তাদের যে খেলার শক্তি সেটা মাঠের বাইরে কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেটাও ভাবা দরকার৷
তাদের প্রতি আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
আমাদের দেশে এইরকম মানুষের সংখ্যা তো খুব কম যারা রোল মডেল৷ যাদেরকে সবাই দেখে, অনুসরণ করে৷ তাই তাদের দায়িত্বটাও অনেক বড়৷ তাই তাদের খেলার বাইরেও রোল মডেলের ভূমিকা রাখার মতো প্রস্তুতি থাকা উচিত৷ তাদের সেভাবেই তৈরি করতে হবে৷
নারীঘটিত কেলেঙ্কারি, শিশু গৃহকর্মী, দর্শক, এমনকি সতীর্থ খেলোয়াড়কে মারধরের মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন বাংলাদেশের কিছু ক্রিকেটার৷ ছবিঘরে থাকছে সেইসব কথা৷
ছবি: Bdnews24.com
রুবেল হোসেন
২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর নাজনীন আক্তার হ্যাপি নামে এক নারী প্রতারণার অভিযোগে রুবেল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন৷ এই ঘটনায় ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি জেলে যেতে হয়েছিল রুবেলকে৷ এরপর বিসিবির সহায়তায় জামিন পেয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/M. Egerton
আল আমিন হোসেন
২০১৫ সালে বিশ্বকাপ চলাকালীন শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল তাকে৷ পরের বছর বিপিএলের সময় হোটেলে নারী অতিথি নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় তাকে জরিমানা করা হয়েছিল৷ নির্যাতন ও মারধরের অভিযোগ এনে গতবছর আল আমিনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার স্ত্রী ইসরাত জাহান৷ মামলাটি এখনও চলছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/F. J. Brown
শাহাদাত হোসেন
২০১৯ সালে জাতীয় লিগের ম্যাচ চলার সময় সতীর্থ খেলোয়াড় আরাফাত সানি জুনিয়রকে মারধর করায় পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন তিনি৷ তবে নিষেধাজ্ঞার দেড় বছর পর ক্যানসারে আক্রান্ত মায়ের চিকিৎসার খরচ চালাতে ক্রিকেটে ফিরতে বিসিবির কাছে আবেদন করেন শাহাদাত৷ পরে তার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়৷ এর আগে ২০১৫ সালে শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল৷ ওই মামলায় প্রায় দুই মাস জেলে থাকতে হয়ে তাকে৷
ছবি: bdnews24/T. Ahammed
আরাফাত সানি
একজন স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় নাসরিন সুলতানা নামে আরেকজনকে বিয়ে করেছিলেন সানি৷ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে সানির বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেছিলেন নাসরিন সুলতানা৷ অভিযোগে বলা হয়েছিল, ভুয়া একাউন্ট খুলে সানি তার (নাসরিন সুলতানার) আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়েছেন৷ ঐ মামলায় প্রায় দুই মাস জেল খেটে জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন সানি৷
ছবি: Bdnews24.com
মোহাম্মদ শহীদ
২০১৭ সালে বিসিবির কাছে শহীদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন স্ত্রী ফারজানা আক্তার৷ অভিযোগে বলা হয়, ২০১১ সালে তাদের বিয়ের সময় শহীদদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না, তবে সংসার ছিল সুখের৷ কিন্তু ২০১৫ সালে জাতীয় দলে অভিষেকের পর একাধিক নারী ভক্তের সঙ্গে শহীদের ঘনিষ্ঠতা হয়েছে বলে দাবি করেন ফারজানা৷ সেই সময় ‘ঝামেলা’ মিটিয়ে নেয়ার কথা বলেছিলেন শহীদ৷ পরের বছর সামাজিক মাধ্যমে নতুন বিয়ের ছবি প্রকাশ করেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
সাব্বির রহমান
২০১৭ সালে জাতীয় লিগের ম্যাচ চলার সময় কিশোর দর্শককে মারধরের অভিযোগে ২০ লাখ টাকা জরিমানা ও ৬ মাস ঘরোয়া ক্রিকেটে নিষিদ্ধ ছিলেন৷ ২০১৬ সালে বিপিএল চলার সময় হোটেল কক্ষে নারী অতিথি নিয়ে যাওয়ায় তাকে ১৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল৷ ২০১৭ সালে মেহেদী হাসান মিরাজকে মারধরের অভিযোগে তাকে দলের বাইরে রাখা হয়েছিল৷ এছাড়া আম্পায়ারকে গালি, নিজ গাড়ির চালককে পেটানোর মতো অভিযোগও উঠেছিল তার বিরুদ্ধে৷
ছবি: picture-alliance/M. Egerton
নাসির হোসেন
সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি টি-টেন লিগে দুর্নীতির অভিযোগ নাসিরসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে আইসিসি৷ নাসিরের নারীসঙ্গ নিয়ে একসময় অনেক কথাই চালু ছিল৷ নাসিরের মোবাইল সিম ও বান্ধবী সংখ্যা নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন বিসিবি সভাপতিও৷ ২০১৮ সালে নাসিরের এক কথিত মডেল বান্ধবী তাদের সম্পর্ক নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে ‘বোমা’ ফাটিয়েছিলেন তাতে সতীর্থ খেলোয়াড়েরা ছাড়াও ভীষণ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছিল বিসিবি৷
ছবি: Getty Images/AFP/U. Zaman
তানজিম হাসান সাকিব
জাতীয় দলে নতুন সুযোগ পাওয়া তানজিমের ফেসবুক পেজের বেশ কিছু পুরোনো স্ট্যাটাস নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনা হচ্ছে৷ এর মধ্যে কর্মজীবী নারীদের হেয় করে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসই বেশি সমালোচিত হচ্ছে৷ এমন স্ট্যাটাস দেওয়ার ব্যাপারে তানজিম ক্ষমা চেয়েছেন বলে জানান বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুস৷
ছবি: Ishara S.Kodikara/AFP/Getty Images
সাকিব আল হাসান
টিভি ক্যামেরার সামনে অশালীন ভঙ্গিতে বাজে ইঙ্গিত করা, স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে দর্শককে পিটিয়ে আহত করা, আম্পায়ারদের সঙ্গে অসদাচরণ ইত্যাদি৷ এছাড়া অনাপত্তিপত্র না নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিপিএল খেলতে যাওয়ার মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে আনায় টেস্ট ও ওয়ানডে দল থেকে অবসর নেওয়ার হুমকি দিয়ে ছয় মাস নিষিদ্ধ হয়েছিলেন সাকিব৷ এরপর জুয়াড়ির কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর সেটি গোপন করায়ও এক বছর নিষিদ্ধ হন তিনি৷
ছবি: Aijaz Rahi/AP/picture alliance
মোহাম্মদ আশরাফুল
বিপিএলে ম্যাচ পাতানো ও স্পট ফিক্সিংয়ের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা ২০১৩ সালে স্বীকার করেছিলেন আশরাফুল৷ এজন্য তাকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল বিসিবি৷
ছবি: Getty Images
একসঙ্গে ৬ ক্রিকেটারের জাতীয় দল থেকে পদত্যাগ
২০০৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাবিবুল বাশার, আফতাব আহমেদ, শাহরিয়ার নাফীস, ফরহাদ রেজা, ধীমান ঘোষ ও মোশাররফ হোসেন রুবেল জাতীয় দল থেকে পদত্যাগ করেন৷ পরে জানা যায়, তারাসহ ১৪ জন ক্রিকেটার ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগের (আইসিএল) নবম দল হিসেবে যোগ হওয়া ঢাকা ওয়ারিয়র্সে খেলবেন৷ ১৭ সেপ্টেম্বর ঐ ১৪ ক্রিকেটারকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল বিসিবি৷