বাজারের হাল হকিকত দেখলে এই মিমটাকে একটুও বাড়ানো মনে হয় না৷ যে-কোনো উৎসবে পণ্যের দাম বাড়ানো একটা রীতিতে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে৷ ২০ টাকা হালি লেবু একদিনের ব্যবধানে ৮০ টাকা৷ কারণ রমজান মাসে সবাই লেবুর শরবত খাবে৷ তাই যতটুকু মুনাফা করা যায়৷ তবে এই মুনাফা প্রান্তিক চাষী কতটুকু পায় সে বিষয়ে কোনো তথ্য কোথাও নেই৷
গত ১৫ দিনের বেশকিছু গণমাধ্যমের বাজার দর বিষয়ক সংবাদগুলোর কয়েকটা হেডলাইন তুলে ধরছি৷ এসব হেডলাইনই বলে দেবে বাজারের ত্রাহি মধুসূদন দশা:
‘চালের দাম দুই টাকা কমাতে মন্ত্রীর আহ্বান, আশ্বাস দিলেন মিলমালিকেরা', ‘চট্টগ্রামে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে, কমেছে সবজির', ‘সয়াবিন তেলের দাম লিটারে কমবে ১০ টাকা', ‘১০ দিন আগে ঘোষণা দিলেও কমেনি সয়াবিন তেলের দাম', ‘হতাশ চাষি, বাজারে গেলেই টমেটোর দ্বিগুণ দাম', ‘কেজিতে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে মসলার দাম', ‘চিনির দাম কেজিতে ৩০ টাকা বাড়ালো টিসিবি', ‘রোজার আগেই বেগুন-মুরগির দাম চড়া', ‘রোজার আগে দ্রব্যমূল্য নিয়ে বেকায়দায় মানুষ', ‘রমজানের প্রথম দিনেই লেবুর হালি ৮০ টাকা', ‘রংপুরে দেশি মুরগি ৬০০, বেগুনের সেঞ্চুরি', ‘১০০ টাকার নিচে মিলছে না শসা-ক্ষীরা'৷
কোথাও কিছু কমার কথা নেই৷ শুধু বাড়ছে৷ সাধারণ মানুষ কীভাবে জীবনযাপন করছে সেই প্রশ্ন অবান্তর৷ দুই টাকা চালের দাম কমাতে বলেছে শুনে খুশি হয়ে যাবেন না৷ ৪০ টাকার চাল ৮০ টাকা হয়ে সেটি আবার ৭৮ টাকা হলে খুশি হওয়া যায় বলুন!
কিছুদিন আগে দোকানে গিয়ে ডিম কিনছিলাম৷ পাশে একজন এসে দাম জিজ্ঞাসা করলেন এরপর ছোট্ট পার্স উলটে পালটে অনেক হিসাব-কিতাব করে তিনটা ডিমের কথা বললেন৷ সাধারণ মানুষের যে খুব সাধারণ খাবার খাওয়ার সামর্থ্য কমে আসছে, সেটা স্বীকার করতে হবে৷
ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি প্রতিদিন বাজারদর পরিবর্তন হয় এবং এটা ঊর্ধ্বমুখী হয়৷ শেষ কবে কোনো কিছুর দাম কমায় সন্তুষ্ট হতে পেরেছি মনে করা প্রায় অসম্ভব৷ বাজারদরের ভিত্তিতে নিজের খাদ্যপণ্যের দামও বাড়াতে হয়৷
গরুর মাংসের কথাই ধরা যাক৷ নির্বাচনের মাস খানেক আগে হুট করে ৫০০ টাকা কেজি মাংস বিক্রি শুরু হলো৷ পাড়ার কসাইরা দিতে নারাজ৷ ৮০০ টাকার মাংস ৫০০ টাকায় কীভাবে সম্ভব৷ পরে সিন্ডিকেট বা অ্যাসোসিয়েশন বেঁধে দিলো ৬৫০ টাকা কেজি গরুর মাংস, তবে সেটা গরুর হাড়, চর্বি মিশ্রিত৷ নিজস্ব পছন্দমত মাংস নিলে ৭৫০ টাকাই গুনতে হয়েছে৷ নির্বাচনের পরপর সেই মাংসের দাম ৮০০ টাকায় ঠেকেছে৷ তবে যারা ৫০০-৬৫০ টাকায় এখনো বিক্রির চেষ্টা করছেন তাদেরকে কাফনের কাপড় নিয়ে বসতে হয়েছে৷ কাফনের কাপড় হচ্ছে সিন্ডিকেটীয় হুমকির প্রতিবাদ৷ বাজার নিয়ন্ত্রণকারীরা খুচরা ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি৷ নিত্য হুমকির ওপর রেখেছেন৷ তবে ৫০০-৬৫০ টাকায় গোশত বিক্রি করেও যে লাভ করা যায় এটার প্রমাণ ‘খলিল কসাই'৷ তাকে আমরা বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে উদাহরণ হিসেবে রাখতে পারি৷ ভোর থেকে লাইন থাকে তার দোকানে, ঈদ-পার্বনে লাইনটা শাজাহানপুর মোড় থেকে ফ্লাইওভারের গোড়া পর্যন্ত লম্বা হয়৷ পার্থক্যটা শুধু অধিক মুনাফালোভীদের সঙ্গে তার৷
বাঙালি তার শতবর্ষের ঐতিহ্য ধরে রাখতে যে-কোনো উৎসব মানেই খাবার আয়োজনকেই বুঝে৷ এমনটাই যুগে যুগে হয়ে এসেছে৷ বাড়িতে হরেক রান্নার বাইরে খাবারের দোকানের ঐতিহ্য কিন্তু কম পুরানো না৷ প্রতিটা পুরনো বাজারে ভাতের হোটেল থেকে শুরু করে মিষ্টি নিমকির দোকান বাধ্যতামূলক৷ কিংবা ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোতে মানুষের আনাগোনা হয় মুড়ি-মুড়কি, নাড়ু, পিঠা, সন্দেশের কারণে৷ নিমকি, ছোলামাখা, ফুচকা, আলুমাখাসহ কতরকম ঝাল খাবারও থাকে৷ সেখানে রমজানের মতো মাসব্যাপী উপলক্ষ্য হলে খাওয়ার আয়োজনটা একটু বাড়তি হবে এটাই বাস্তবতা৷ ইফতার, সেহরির আয়োজনটা একটু বাড়তি হবে এটাই সবার প্রত্যাশা৷ কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও এই আয়োজনে হাত টান দিতে হচ্ছে৷
গত বছর রমজানে কাঁচামরিচের দাম ১,২০০ টাকা হয়েছিলো৷ বাজার সিন্ডিকেট দাবি করেছিলো কাঁচামরিচ নেই, বন্যার পানিতে ডুবে গেছে৷ ঠিক তেমনি এই রমজানে প্রতিটি খাদ্যপণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া৷ টমেটো, শসা, পুদিনা, লেবুর মতো কাঁচাপণ্যের দামগুলো ইতোমধ্যে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে৷ মাত্র শীত শেষ হয়েছে৷ কোনোভাবেই টমেটো-শসার দাম বাড়ার কথা না৷ কিন্তু দাম বেড়েছে৷ একটা সময় সিজনে ২০ টাকা কেজি টমেটো পাওয়া যেত এবার সেট ৪০ টাকার নিচে নামেনি৷ তেমন করে ব্রকলি, ফুলকপি ৪০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে পুরো শীতকাল৷ ফুলকপি দিয়ে মাছের ঝোলেও হাত টান দিতে হয়েছে৷
শুধু ফুলকপি চড়া না, মাছের বাজারও চড়া৷ পাঙ্গাস বা তেলাপিয়ার কেজি যতটুকু বাড়ালে একজন ৮ হাজার টাকা বেতন পাওয়া গার্ড কিনে খেতে পারবে না, সেই পর্যায়ে বেড়েছে৷ রুই, কাতলা, বোয়াল এসব এখন স্বপ্নের মাছ মধ্যবিত্তের৷ ডাল ১১৫ টাকা কেজি৷ ভাগ্যিস এক কেজি ডালে ৫ সদস্যের পরিবারে পাঁচ দিন যায়৷ সখ করে একদিন ভর্তা খেলে সেই সংখ্যা কমিয়ে আনতে হয়৷ ভাতের চালের দাম নিয়ে তো কোনো কথা হবে না৷ আপনার বাজার থেকে কেনার সামর্থ্য নেই৷ তাহলে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ তথা টিসিবির ন্যায্য মূল্যের পণ্য বিক্রির লাইনে দাঁড়াবেন৷ তবে জেনে রাখবেন সেই দর ওঠানামা করে৷ ঘোষণা দিয়ে চিনি প্রতি ৩০ টাকা কেজি বাড়িয়েছিল টিসিবি কর্তৃপক্ষ৷ আবার কমিয়েছেও শুনলাম৷ চিনির বর্তমান খুচরা মূল্য ১৬০-১৭০ কোম্পানিভেদে৷ খোলা চিনি কিনলে ১৬০ টাকাতেই পাবেন৷ তেলের দাম কমানোর ঘোষণা দিলেও সেটি আগের ঠিকানাতেই আছে৷ মানে কমেনি৷
গত দুই বছর আমদানীকৃত সয়াবিন তেলের দাম বাড়তে বাড়তে ২২০ টাকায় ঠেকেছিলো লিটারপ্রতি৷ কেনো এভাবে দাম বাড়ে তার ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত কেউ দেয়নি৷ তবে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘নিত্যপণ্যের কোনো সংকট নেই'৷ তিনি আরও বলেছেন, ‘ফিক্সড প্রাইজ' শপে কাঁচাবাজারের চেয়ে দাম কম'৷ অন্যদিকে শিল্পমন্ত্রী ইফতারে আঙুর খেজুরের পরিবর্তে বরই খেতে বলেছেন৷
খেজুর আমদানির ওপর যে কর আরোপ করা হয়েছে সেটির সুযোগ বুঝে দাম যে আকাশ ছোঁয়া করা হয়েছে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই৷ সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে দাম নির্ধারণ করে দিলেও সেটি মানা হচ্ছে না৷ মসলা থেকে শুরু করে কোনো খাদ্যপণ্যেই হাত দেওয়া যাচ্ছে না৷ নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তের প্রোটিন তালিকা থেকে ডিম তো আগেই বাদ গেছে৷ এখন মুরগির গিলা, কলিজা বা পাখনাও বাদের তালিকায় চলে যাচ্ছে৷
এত গেলো খাদ্যপ্যণের কথা৷ শুধু যে খাবারের দাম বেড়ে যায় বিষয়টা তা নয়৷ পোশাক আশাক, প্রসাধন সব কিছুর দাম বাড়ে৷ জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ প্রতিটা জিনিসে ঈদ বা পূজায় দাম বাড়ে৷ সব যে ন্যায্য দাম তা কিন্তু নয়৷ দেশখ্যাত ব্র্যান্ড শপের ঈদ উপলক্ষে বদলানো প্রাইস ট্যাগকাণ্ডের কথা মনে আছে? আমি তো এমনি এমনি খাইয়ের মতো এমনি এমনি দাম বাড়াই কারণ সামনে ঈদ৷
অবশ্য দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে রিকশাওয়ালাদের যুক্তি অকাট্য৷ চালের দাম যত বাড়ে ভাড়া তত বাড়ে৷ এই যুক্তিতে সব ব্যবসা চলছে৷ যে দেশে প্রধান খাদ্যের দাম যত বাড়বে বাকি পণ্যের দাম সেই সঙ্গে বাড়বে৷ সেক্ষেত্রে খাদ্য, বস্ত্র বাসসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার দামও বেড়েছে৷ বেসরকারি স্কুলের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো৷ ওষুধের দাম কতটা বেড়েছে তার একটি ছোট্ট উদাহরণ দেই৷ একটি আর্টিফিশিয়াল টিয়ার্স বা চোখের ড্রপের দাম ছিলো ১৭৫ সেটি এখন ৩২৫ টাকা হয়েছে৷ ডায়ালাইসিসের ওষুধের দাম, প্রেসার, ব্লাড সুগারের ওষুধ এমন কি প্যারাসিটামলের দামের ওপরও প্রভাব ফেলছে চালের দাম৷
ধরা যাক, ডলার সংকট, আমদানি-রফতানিতে প্রভাবের ফলে স্বাভাবিক সময়ে দাম বাড়ছে নিত্যপণ্যের৷ কিন্তু রমজান বা যে-কোনো উৎসব কেন্দ্র করে হুহু করে আকাশছোঁয়া কেন হয় এর কোনো ব্যাখ্যা কিন্তু নেই৷ রমজানে খেজুর, লেবু, বেগুন, নববর্ষে ইলিশ, পূজায় নারকেলের দাম বাড়াটাই ভবিতব্য এবং সেই দাম আর কমবে না এটাই অকাট্য৷
অথচ বিশ্বের অন্য দেশগুলোর দিকে একটু তাকান- আমি ব্যক্তিগতভাবে পাঁচ বছর সৌদি আরবে ছিলাম৷ সেখানে রমজান এবং ঈদের সময় প্রতিটি নিত্যপণ্যে ৩০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিতে দেখেছি৷ ক্রিসমাসে ইউরোপে এবং থাইল্যান্ডে থাকার সুযোগ হয়েছিলো৷ ছাড়ের ওপর ছাড় চলে প্রয়োজনীয় সব পণ্যে৷ পাশের দেশ ভারতে পূজা, দেওয়ালি উপলক্ষে গয়না, মিষ্টি, পোশাক, খাবারের ছাড়ের বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতেই আমরা বড় হলাম৷ এসব দেখি আর ভাবি এই দেশে দুইবেলা দুমুঠো খেয়ে গায়ে পরে বেঁচে আছি এই ঢের৷
এখনো পাশের নির্মাণাধীন বাড়ির পিলার কিংবা গাড়ির চাকার তলে পিষে মরে যাইনি এই কত৷ আবার বাজার দর নিয়ে কথা বলি!