কিন্তু কাতার বিশ্বকাপের প্রেক্ষাপট এবার বাংলাদেশের জন্য কিছুটা ভিন্ন৷ অস্ট্রেলিয়ায় শুরু হয়ে গেছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, যে আসরে আছে বাংলাদেশ জাতীয় দলও৷ বিশ্বের আর সব দেশের সংস্কৃতি মেনে টি-টোয়েন্টি নিয়েই পড়ে থাকার কথা বাঙালিদের৷ বিভিন্ন মিডিয়া আউটলেটে গেলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ডামাডোল চোখে পড়ে৷ তবে সেসবে আশার চেয়ে নিরাশার দীর্ঘশ্বাসই বেশি৷
আমার পরিচিত একজন সদ্যই সিডনি গেছেন৷ সে তাঁর পরিবারের বড় একটি অংশ থাকেন৷ তাই আগে থেকে পরিকল্পনা করা, পরিবারের সঙ্গে থাকার ফাঁকে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ম্যাচও দেখবেন৷ কিন্তু আফগানিস্তানের কাছে প্রস্তুতি ম্যাচে সাকিব আল হাসানদের হারের পর ভাইবার গ্রুপে তিনি বার্তা পাঠিয়েছেন,‘তাহলে হোবার্টে গিয়ে কী করব? তারচেয়ে ভালো নাতনির সঙ্গে সময় কাটাই৷ টিভি তো আছেই৷’
ঠিক এটাই এসময়ের বাঙালির ক্রিকেটীয় আড্ডার আবহ৷ ঘাম ঝরিয়ে, গাঁটের পয়সা খরচ করে বাংলাদেশের ক্রিকেট দেখার আগ্রহ আর নেই৷ তবে খেলায় চোখ থাকে, সেটা টিভি কিংবা মোবাইলের লাইভ স্কোরে৷ অবশ্য প্রবাসীদের কাছে বাংলাদেশের খেলা দেখার তাৎপর্য ভিন্ন কারণে৷ ভিনদেশে এসব দিনে দেশের পতাকা উড়িয়ে গ্যালারি মাতিয়ে রাখার আবেগ উপেক্ষা করা যায় না৷ যায় না বলেই বাংলাদেশের ম্যাচ টিকিট বিক্রি হয়েছে হু হু করে৷ আমার পরিচিত মানুষটিও টিকিট কিনেছেন, কিন্তু খেলা দেখতে দূরের শহরে যাবেন কিনা, নিশ্চিত নই৷
সবমিলিয়ে মন ভালো নেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের৷ আচমকা এমন মন খারাপ করল কবে এবং কিভাবে? যে জাতি ‘জিতলে বাংলাদেশ, হারলেও বাংলাদেশ’ বলে ঝাঁপাঝাঁপি করেছে গ্যালারিতে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই তারা এমন ক্রিকেট-বিমুখ হলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর একটাই- সাফল্যের নিম্নগামীতা৷ হার কারোরই ভালো লাগে না৷ আবার সবদিন কী জেতা যায়? অস্ট্রেলিয়া-ভারতও হারে৷ কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হারগুলো এতই উৎকট যে, অনুসারীরা সম্ভবত এর ভার আর নিতে পারছেন না৷ হারের ধাক্কায় চোটগ্রস্ত দেখাচ্ছে বাংলাদেশ দল এবং এর ম্যানেজমেন্ট গ্রুপকেও৷
বাংলাদেশ ক্রিকেটের এমন হাড়গোড় বেরিয়ে পড়ার কারণ খুব অজানা নয়৷ ২০১৫ সাল থেকে ওয়ানডেতে দারুণ খেলছে বাংলাদেশ৷ ঘরের মাঠের পুরো সুবিধা নিয়ে টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টিতেও বড় বড় দলকে হারিয়েছে৷ কিন্তু সেসব সাফল্য যে টেকসই নয়, এটা বুঝতে চায়নি দেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা৷ সেসব সাফল্য যে স্রেফ প্রসাধন ছিল, সামান্য বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবে সব- জেনে কিংবা না জেনে বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেননি ক্রিকেটের নীতি নির্ধারকেরা৷ বরং প্রতিটি জয় তারা এমন মহাসমারোহে উদযাপন করেছেন যে, মনে হতে পারে গত এক দশকে বুঝি গোটা দুই বিশ্বকাপ জিতে ফেলেছে বাংলাদেশ!
যদিও একটি করে যুব বিশ্বকাপ আর নারীদের এশিয়া কাপ ছাড়া বড় কোন ট্রফি জেতেনি বাংলাদেশ৷ সেই নারী দল এবারের আসরের সেমিফাইনালে উঠতে পারেনি৷ আর যুবদলের সাফল্যের নিরিখে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যত অনুমান করলে মারাত্মক ভুল হবে৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্য দেশের যুবারা প্রস্ফুটিত হন৷ বাংলাদেশে হয় উল্টোটা৷ সবার নিশ্চয় মনে আছে, বিরাট কোহলি এবং এনামুল হক বিজয় একই আসরে নিজ নিজ দেশের অধিনায়ক ছিলেন৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশি তরুণের পিছিয়ে পড়ার এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে৷
এই পিছিয়ে পড়ার কারণ দুটো৷ প্রথমত উঠতি তারকার যত্নআত্তির উপযুক্ত পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি বাংলাদেশে৷ দ্বিতীয়ত, খ্যাতির সামান্য ঝলকানিতে ঝলসে যান বাংলাদেশের তরুণেরা৷
এই দুটোর পেছনে আবার লুকিয়ে আছে আসল কারণ৷ ২০১৫ সালের পর থেকে ওয়ানডে সাফল্যের ফানুস উড়িয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটের ক্ষত আড়াল করা হয়েছে৷ দেশের প্রথমশ্রেণির ক্রিকেটে প্রণোদনা বাড়ানো ছাড়া অবকাঠামোগত উন্নতি হয়েছে সামান্যই৷ প্রণোদনা ছাড়া খেলোয়াড়দেরও জাতীয় লিগের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ নেই৷ সাদা বলের দুই টুর্নামেন্ট- ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) অবশ্য ব্যাপক আগ্রহ আছে খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের৷ জাতীয় লিগের চেয়ে অনেক কম পরিশ্রমে বহুগুণ বেশি আয় করা যায় সাদা বলের ক্রিকেটে৷ কিন্তু সবচেয়ে অর্থকরী বিপিএলও এখন মরো মরো প্রায়! ২০১২ সালে ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হয়েছিল আসরটি৷ স্পট ফিক্সিংয়ের কালো দাগ পড়া সত্ত্বেও ইদানীংকার আসরের চেয়ে সেসব আসরে নামী তারকার উপস্থিতি এবং ক্রিকেট মানে ভালো ছিল৷ বর্তমান বোর্ড কর্মকর্তারাও তখন জোর দাবি করতেন যে, দর্শকপ্রিয়তায় ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) পরই বিপিএল৷
সেই বিপিএল এখন যেন ফাঁকা মঞ্চ- যে যার খুশি মতো এসে নেমে পড়তে পারেন! প্রতিদ্বন্দ্বিতার মান নেমে গেছে৷ অথচ একই সময়কালে মান বেড়েছে বিশ্বের অন্য সব দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে৷ সেসব আসরে আবার এক-দুজনের বেশি বাংলাদেশি ক্রিকেটার দল পান না৷ তাতে সর্বোচ্চ মানের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচ বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা পান শুধুই আন্তর্জাতিক ম্যাচে৷ কিন্তু স্টেজে প্রতিদিন মেরে দেয়া যায় না!
তারপরও খেলাটা চরম অনিশ্চয়তার ক্রিকেট, ফাটকা লেগেও যেতে পারে৷ তবে ভাগ্যগুণে পাওয়া সাফল্য উন্নতির সূচক হতে পারে না৷ তাই অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠানরত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল যদি ভালো করেও ফেলে, তাতে উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখে ফেলার সুযোগ নেই৷ যত দিন যাচ্ছে, টি-টোয়েন্টিতে সাকিব আল হাসানদের সঙ্গে অন্যদের সামর্থ্যের ব্যবধানে প্রভাব পড়ছে৷ বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যবধানের ব্যারোমিটারের এই ওঠানামা বাংলাদেশ দলের জন্য প্রীতিকর নয়৷ বড় দলগুলো এগিয়ে আছে শুরু থেকে৷ এতদিন পিছিয়ে থাকা দলগুলোও এখন নি:শ্বাস ফেলছে বাংলাদেশের ঘাড়ে৷
এই নিঃশ্বাসটাই উদ্বেগের৷ নেদারল্যান্ডস-নামিবিয়ার মত দল আস্তিন গুটিয়ে টি-টোয়েন্টির মাঠ দাপাচ্ছে৷ আর বাংলাদেশ কেমন যেন খোলসে ঢুকে যাচ্ছে!
এই খোলস কি বিশ্বকাপের মঞ্চে ভাঙতে পারবে বাংলাদেশ? উত্তর সমর্থনের গ্যালারিতে ছুঁড়ে দেয়া হলো৷ সঙ্গে শর্ত জুড়ে দেয়া হলো- আশাভঙ্গের দায় কিন্তু আশাবাদীকেই নিতে হবে!