করোনা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন৷ এরই মধ্যে নয়া বিপত্তি৷ জলপথে অন্য রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে ভেসে আসছে মৃতদেহ৷ এতে কোভিড সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা আছে?
বিজ্ঞাপন
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেসামাল ভারত৷ দেশে দৈনিক সংক্রমণ কমলেও পশ্চিমবঙ্গে তা বাড়ছে৷ শুক্রবার সন্ধ্যার হিসেব অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ২০ হাজার ৮৪৬ জন৷ মারা গেছের ১৩৬ জন৷ এরই মধ্যে নতুন সমস্যা তৈরি করেছে ভাসমান দেহ৷
উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড ও বিহারে গঙ্গায় অনেক দেহ একসঙ্গে ভাসতে দেখা যাচ্ছে৷ এই দেহগুলির অধিকাংশ অর্ধদগ্ধ৷ কোথা থেকে এলো এত দেহ? অনেকে মনে করছেন, অতিমারিতে মৃত মানুষের দেহ সৎকার করতে না পেরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ এই ভাসমান দেহ চিন্তায় ফেলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে৷ ঝাড়খণ্ড লাগোয়া মালদহের মানিকচক দিয়ে গঙ্গা এই বাংলায় প্রবেশ করেছে৷ দেহ ভাসতে ভাসতে এখানে এলে কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হবে? এ নিয়ে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে রাজ্য সরকার৷ জেলা পুলিশ-প্রশাসন নজরদারি রাখছে পরিস্থিতির উপর৷ নদীতে নামানো হয়েছে নৌকো, স্পিড বোট৷ রাতে আলো জ্বালিয়ে নজরদারি চালানো হচ্ছে৷ স্থানীয় মাঝিদের সাহায্য নিচ্ছে প্রশাসন৷ জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করছে পুলিশ৷ তাদের বাহিনীর সঙ্গে থাকছে বিশেষ দল৷ দেহ ভেসে আসার খবর পেতে পাশের রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়েছে৷ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে জেলা প্রশাসন৷ দেহ ভেসে এলে দ্রুত তা উদ্ধার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন৷
শিবকিঙ্কর দাস
ভাসমান দেহ কোভিডে মৃতদের কি না, তা স্পষ্ট নয়৷ মালদহ জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, দেহ উদ্ধার হলে তার করোনা পরীক্ষা করানো হবে৷ তারপর নির্দিষ্ট বিধি মেনে ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন৷ মৃতদেহ কোভিড রোগীর বলে নিশ্চিত হলে তা জীবাণুমুক্ত করা হবে৷ তারপর সমাহিত করা হবে মাটির গভীরে৷ এই দেহগুলি করোনা রোগীর কি না, তা পরীক্ষাসাপেক্ষ৷ যদি তাই হয়, তাহলে সংক্রমণ কি ছড়িয়ে পড়তে পারে? ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক সিদ্ধার্থ জোয়ারদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে কোষের সাহায্য নেয়৷ মৃতদেহগুলি যদি করোনা রোগীর হয়, তাহলে সেই শরীরে ভাইরাস থাকতেই পারে৷ জলে দ্রব হয়ে গেলে করোনা ভাইরাস মানুষের মধ্যে ফিরে না আসারই কথা৷ কারণ করোনা ভাইরাসের ইনার পার্টিকল নষ্ট হয়ে গেলে সেটা কিছু থাকবে না৷ কিন্তু জলদূষণ বা ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণ তো হবেই৷’’
ভারতের কয়েকটি রাজ্যে বহু মানুষের জীবন-জীবিকার কেন্দ্রে রয়েছে গঙ্গা৷ দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের কাছে কুম্ভের মতো ধর্মীয় তাৎপর্যও বহন করে চলেছে এই নদী৷ আপাতত গঙ্গার জলকে ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক কাজে না লাগাতে বলছেন মৎস্যবিজ্ঞানের অধ্যাপক শিবকিঙ্কর দাস৷ তার যুক্তি, ‘‘এই সময় নদীর জল তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে৷ ফলে মৃতদেহগুলি জলে ডাইলুটেড হচ্ছে না৷ তাই এত সংখ্যায় মৃতদেহ দূষণ করছে মারাত্মক৷ এতে নদীর বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে৷ জল আন্ত্রিক সমস্যা বাড়াতে পারে৷ তাই দূষিত হিসেবেই গঙ্গার জলকে দেখা উচিত৷’’ তাহলে কি মাছ খাওয়া নিরাপদ হবে? অধ্যাপক দাস বলেন, ‘‘আঞ্চলিক স্তরে দূষণের দিকটাও মাথায় রাখতে হতে পারে৷ সেখানে মাছ ধরার ক্ষেত্রে মৎস্যজীবীরা এই দূষণের গ্রাসে পড়বেন৷ আমরা মাছ যখন খাই, সেটা হয়তো জীবাণুমুক্ত হয়ে যাবে৷ কিন্তু মৎস্যজীবী যারা খালি হাতে মাছ ধরেন বা বিক্রি করেন, তারা বড় সমস্যায় পড়তে পারেন৷’’
সিদ্ধার্থ জোয়ারদার
কাজেই করোনা সংক্রমণের দুর্ভাবনা সরিয়ে রাখলেও রেহাই নেই৷ এত মৃতদেহ দীর্ঘ সময় ভাসতে থাকলে জলদূষণের আশঙ্কা রয়েছে৷ নদীদূষণ আটকাতে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, শিলিগুড়ির মহানন্দা, মুর্শিদাবাদের জলঙ্গী ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিদ্যাধরীর অবস্থা খুব খারাপ৷ কলকাতার একটা বড় অংশের মানুষ নদীর জলের উপর নির্ভরশীল৷ উন্নত প্রযুক্তির প্লান্টে নদীর জল শোধন করে তা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়৷ পরিবেশের উপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী? পরিবেশকর্মী নব দত্ত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘শুধু শবদেহ কেন? গত দুই বছর ধরে যথেচ্ছ পিপিই, কিট থেকে শুরু করে নানা কোভিড বর্জ্য তোর্সা, তিস্তা সহ বিভিন্ন নদীতে সরাসরি ফেলা হচ্ছে৷ কেউ তো প্রতিবাদ করেননি৷ দীর্ঘদিন ধরে আমরা নদী দূষণ নিয়ে আন্দোলন করে আসছি৷ কোনো সুরাহা হয়নি৷’’
জলবায়ু পরিবর্তন: পালটে যাচ্ছে নদীও
কেবল খাবার পানি নয়, অন্য নানা কাজেই নদীর ওপর নির্ভর করতে হয় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে৷ কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ এই জল সরবরাহ প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দিচ্ছে৷
ছবি: AFP/Rammb/Noaa/Nesdis
পানির অপর নাম...
বিশ্বের মোট জলের বেশিরভাগই রয়েছে সমুদ্রে৷ মোট জলের কেবল ১০০ ভাগের এক ভাগ নদী দিয়ে বয়ে যায়৷ কিন্তু এই নদীগুলো ছাড়া ভূপৃষ্ঠে মিষ্টি পানি অন্যসব উৎস, যেমন হ্রদ ও জলাভূমি শুকিয়ে যাবে৷ এরই মধ্যে এমন আলামত দেখা যেতে শুরু করেছে৷ কেবল মানবজাতি নয়, প্রাণিজগত ও উদ্ভিদজগতেও পড়ছে এর প্রভাব৷
ছবি: picture-alliance/APA/B. Gindl
দশকের পর দশক
ওপরে আফ্রিকার শাড হ্রদের ১৯৬৩, ১৯৭৩, ১৯৮৭ এবং ১৯৯৭ সালের ছবি দেখানো হয়েছে৷ দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৬০ বছরে হ্রদটির আকার ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার থেকে কমে দুই হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও নীচে নেমে এসেছে৷ দীর্ঘদিন ধরে এর জন্য বাঁধ ও সেচব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়েছে৷ কিন্তু গবেষকরা জানতে পেরেছেন, এই অঞ্চলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নদী কোমাদুগুর জলও ধীরে ধীরে তাপমাত্রার ওঠানামার কারণে কমে এসেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NASA
জীববৈচিত্র্য এবং খাদ্য সংকট
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষ কিভাবে বাধ্য হচ্ছে খাদ্য ও জলের নতুন উৎস খুঁজে নিতে, শাড হ্রদ তার অন্যতম উদাহরণ৷ কৃষক এবং পশু খামারের মালিকেরা জলের জন্য ধীরে ধীরে উর্বর জমির সন্ধানে যাচ্ছেন৷ কিন্তু উর্বর জমি কমে যাওয়ায় অঞ্চলটিতে জমি নিয়ে উত্তেজনাও দেখা দিয়েছে৷ অন্য বিভিন্ন মহাদেশেও অত্যধিক গরমে নদীর জল শুকিয়ে যাওয়া এবং মাছ মরে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Photo/R. F. Bukaty
ইউরোপেও তাপদাহ
২০১৮ সালের গ্রীষ্মে তাপদাহ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, খরস্রোতা রাইন নদীর জল শুকিয়ে খালের আকার ধারণ করে৷ তাপমাত্রা একসময় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও ছাড়িয়ে যায়৷ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মালামাল পরিবহনে রাইন নদীর ওপর নির্ভর করে৷ কিন্তু এক পর্যায়ে প্রশস্ত এ নদী এতটাই অগভীর হয়ে পড়ে যে, কেবল একটি লেন চলাচলের জন্য চালু রাখা সম্ভব হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gambarini
গলে যাচ্ছে হিমবাহ
পানীয় জলের নির্ভরযোগ্য উৎসগুলোও হুমকির মুখে৷ বিভিন্ন পর্বতমালায় জমে থাকা হিমবাহকে জলের আধার মনে করা হয়৷ শীতকালে প্রচুর জল বরফ আকারে জমিয়ে রাখে হিমবাহগুলো৷ গ্রীষ্মকালে সে বরফ গলেই বিভিন্ন নদীতে জল যায়৷ হিমবাহগুলো অন্তত ২০০ কোটি মানুষের জল সরবরাহ করে৷ কিন্তু এরই মধ্যে বিভিন্ন হিমবাহে বরফ কমতে শুরু করেছে৷ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এ শতাব্দীর শেষের দিকে হিমালয়ের তিন ভাগের এক ভাগ বরফ একেবারে গলে যাবে৷
ছবি: DW/Catherine Davison
হিমালয় ও দক্ষিণ এশিয়া
সিন্ধু অববাহিকার কৃষকেরা বিভিন্ন শস্য চাষের জন্য হিমালয়ের বরফ গলা পানির ওপর নির্ভর করেন৷ পুরো অঞ্চলটি সুপেয় জল ছাড়াও সেচ, মাছ ও পরিবহনের জন্য অনেকাংশেই নির্ভর করে সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ওপর৷ এই তিন অববাহিকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্তত ১৩ কোটি কৃষক ও ৯০ কোটি বাসিন্দার জলের জোগান দেয়৷
ছবি: Imago/Aurora
দাবানল
ছবিতে দেখানো অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের মতো সম্প্রতি অনেক ভয়াবহ দাবানল দেখেছে বিশ্ব৷ জলবায়ু পরিবর্তনের আরেক দিক এটি৷ দাবানল নদীও ক্ষতি করছে৷ অস্ট্রেলিয়ার দাবানলে গাছ পুড়ে ছাই পড়ছে মারে-ডার্লিং অববাহিকার নদীতে৷ এর ফলে নদীর জল দূষিত হচ্ছে৷ এতে কেবল নদীর জলের ওপর নির্ভরশীল ২৬ লাখ মানুষ নয়, অনেক প্রজাতির প্রাণীও পড়েছে হুমকির মুখে৷
ছবি: Reuters/Maxar Technologies
শ্যাওলা এবং ডেড জোন
কেবল দাবানলের ছাইই যে নদীর ক্ষতি করে, এমনও না৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অতিবৃষ্টির ফলে নানা কারখানার বর্জ্য আরো দ্রুত নদী হয়ে সাগরে গিয়ে পড়ছে৷ এর ফলে নিউ ইয়র্ক উপকূলের মতো বিশাল এলাকা জুড়ে শ্যাওলা জন্মে সেখানকার জীববৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলছে৷ কোনো কোনো স্থানে অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ডেড জোনের সৃষ্টি হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/NASA
বৃষ্টি বেশি মানেই সুখবর নয়
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া মিসিসিপি নদীতে নাইট্রোজেন দূষণ একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে৷ অতিবৃষ্টির ফলে আরো বেশি বর্জ্য ও নাইট্রোজেন জমা হচ্ছে নদীর জলে৷ একই সঙ্গে বন্যা ও সংখ্যায় ক্রমশ বাড়তে থাকা হারিকেনও ফেলছে প্রভাব৷