বাংলাদেশ প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প নিয়ে এগোতে চাইলেও, ভারতের অনীহার কারণে তা আটকে আছে৷ অথচ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় পানি স্বল্পতা কমবে, কমবে লবণাক্ততাও৷
বিজ্ঞাপন
ইমামুল হক
১৯৯০-এর দশকে গঙ্গা বাঁধ প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার৷ বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে পদ্মা নামে পরিচিত গঙ্গা নদী দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পানির একটি বড় উৎস৷ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের অংশ হিসেবে পানির স্বল্পতা আর লবণাক্ততা অঞ্চলটির জন্য অন্যতম সমস্যায় পরিণত হয়েছে৷ সে কারণেই এ বাঁধ প্রকল্পটিকে প্রাধান্য দিচ্ছে বাংলাদেশ৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা দিন দিন বাড়ছে৷ তাই প্রস্তাবিত বাঁধ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বিভিন্ন নদীপথ দিয়ে পানি ছাড়া যাবে, যাতে কমবে লবণাক্ততার মাত্রা৷ তবে ভারতের সহায়তা ছাড়া এ বাঁধ নির্মাণ সম্ভব নয় বলে আগেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন তাঁরা৷
বাংলাদেশের তরফে এরইমধ্যে রাজবাড়ির পাংশা এলাকায় ২.১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে প্রস্তাবিত বাঁধটির নকশা প্রস্তুত করা হয়েছে৷ সম্ভাব্যতা পরীক্ষাও সম্পন্ন হয়েছে ইতিমধ্যে৷ তারপরও ভারতের সায় না পাওয়ায় থমকে আছে প্রকল্পটি৷
ব্রহ্মপুত্র নদের দ্বীপটি হারিয়ে যাচ্ছে
ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যে একটি দ্বীপ মাজুলী৷ ভারতের আসাম রাজ্যের এই দ্বীপটি বিশ্বের অন্যতম বড় ‘নদী-দ্বীপ’৷ কিন্তু এটা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে৷
ছবি: DW/B. Das
বিশ্বের অন্যতম বড় নদী-দ্বীপ
ভারতের আসাম রাজ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝে অবস্থিত মাজুলী বিশ্বের অন্যতম বড় ‘নদী-দ্বীপ’৷ কিন্তু ভূমিক্ষয়ের কারণে মাজুলীর আয়তন দিন দিন ছোট হয়ে আসছে৷
ছবি: DW/B. Das
সমৃদ্ধ সংস্কৃতি
মাজুলী দ্বীপটি নিও-বৈষ্ণব সংস্কৃতি সমৃদ্ধ৷ সেখানে এই সম্প্রদায়ের অনেকগুলো আশ্রম রয়েছে৷ প্রায় এক লক্ষ ৭০ হাজার মানুষের বাস এই নদী-দ্বীপটিতে৷
ছবি: DW/B. Das
ছোট হয়ে আসছে মাজুলী
মাজুলী দ্বীপটির আকার একসময় ছিল প্রায় সাড়ে ১২শ’ বর্গকিলোমিটার৷ কিন্তু দিন যত যাচ্ছে দ্বীপের আকার তত কমছে৷ বর্তমানে এটি তার আগের আয়তনের এক-তৃতীয়াংশ হয়ে গেছে৷
সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল৷ কিন্তু ১৯৫০ সালের ভূমিকম্পটি সব পাল্টে দিয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা৷ সেই সময়ের ৮.৯ মাত্রার ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ায় দ্বীপটির চারপাশের ভূমি ক্ষয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: DW/B. Das
বছর বছর বন্যা
প্রায় প্রতি বর্ষা মরসুমেই মাজুলীতে বন্যা হয়৷ এতে বহু প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতি হয়ে থাকে৷ ফলে সেখানকার অনেক বাসিন্দাই এখন মূল ভূখণ্ডে পাড়ি জমাচ্ছেন৷
ছবি: DW/B. Das
নিষ্ক্রিয় সরকার
মাজুলীর স্থানীয় বাসিন্দারা অনেক দিন ধরে বাঁধ নির্মাণের দাবি জানালেও সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না৷ এছাড়া দ্বীপটির বাসিন্দাদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়েও সরকার ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: DW/B. Das
7 ছবি1 | 7
জানা গেছে, ২০১৫ সালের শুরুতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি চিঠি পাঠায় দিল্লি৷ সেখানে বলা হয়, ঢাকা থেকে পাঠানো প্রকল্প সংক্রান্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করেছেন ভারতীয় কারিগরি বিশেষজ্ঞরা৷ তাঁদের আশঙ্কা, বাঁধটি নির্মিত হলে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ভারতের এলাকাগুলোতে বন্যা দেখা দিতে পারে৷
তাই বাঁধটি নির্মিত হলে ভারতীয় ভূখণ্ডে পানির উচ্চতা বাড়বে না – এমন নিশ্চয়তা চেয়ে ঢাকাকে পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা পরীক্ষার প্রতিবেদন এবং বৈজ্ঞানিক নকশা পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়৷ গত বছরের এপ্রিল মাসে ভারতে সব কাগজপত্র পাঠানো হলেও, এখনও পর্যন্ত দেশটি এ ব্যাপারে সাড়া দিচ্ছে না বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ৷
গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সাত বছর সময় লাগবে আর তার জন্য বরাদ্দ লাগবে ৪০০ কোটি ডলার৷ বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রীর দাবি, গঙ্গা নদীর ওপর নির্ভরশীল এলাকাগুলোতে কৃষি ও মৎস উৎপাদন এবং ১১৩ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে পাঁচ বছরের মধ্যে বাঁধ নির্মাণের খরচ উঠে আসবে৷ বাঁধটি নির্মাণের ব্যাপারে অর্থায়নের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীনা প্রতিষ্ঠান হাইড্রো চায়না কর্পোরেশন৷
এছাড়া গঙ্গা বাঁধের মাধ্যমে ১৬৫ কিলোমিটার এলাকা পানি সংরক্ষণাগার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে৷ তাতে থাকবে ২৯০ কোটি ঘন লিটার পানি ধারণের ক্ষমতা৷ বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রীর দাবি, ১২৩টি আঞ্চলিক নদীর মাধ্যমে ২৬টি জেলায় এ পানি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে৷ আর সারা বছর ধরেই ব্যবহার করা যাবে সংরক্ষণাগারের পানি৷
বুড়িগঙ্গা রক্ষায় উদ্যোগ আছে, সাফল্য নেই
যে নদীর তীরে বাংলাদেশের রাজধানীর অবস্থান, সেই নদীর অবস্থা ক্রমশ নাজুক থেকে নাজুকতর হচ্ছে৷ বিষাক্ত আবর্জনা মিশে ইতোমধ্যে নদীর পানি ধারণ করেছে কৃষ্ণবর্ণ, নদী পরিণত হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়ে৷ এই নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিবর্ণ বুড়িগঙ্গা
যে বুড়িগঙ্গা এককালে ঢাকার রূপ বাড়িয়েছে, সেই বুড়িগঙ্গা আজ বড় বিবর্ণ৷ ঢাকা শহরের চাপ আর নিতে পাচ্ছে না এই নদী৷ রাজধানীর অধিকাংশ আবর্জনা গিয়ে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়৷ ফলে নদীর পানি ধারণ করেছে কৃষ্ণবর্ণ৷ তবুও অত্যাচার থেমে নেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আবর্জনার ভাগাড়
বুড়িগঙ্গা এখন কার্যত আবর্জনার ভাগাড়৷ প্রতিদিন ঠিক কি পরিমাণ ময়লা, আবর্জনা বুড়িগঙ্গায় ফেলা হয় তার একেবারে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব নয়৷ তবে পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার গৃহস্থালী ও কল-কারখানার সাত হাজার টনেরও বেশি বর্জ্যের ৬৩ ভাগ বিভিন্নভাবে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ে৷
ছবি: AP
হাজারিবাগের আবর্জনার গন্তব্য বুড়িগঙ্গা
হাজারিবাগে অবস্থিত দু’শোর বেশি চামড়া কারখানা থেকে প্রতিদিন গড়ে ২২ হাজার ঘন লিটার দূষিত আবর্জনা বের হয়৷ এই আবর্জনায় হেক্সাভ্যালেন্ট ক্রোমিয়াম রয়েছে, যার কারণে ক্যানসার হতে পারে৷ অথচ এই সব বর্জ্যই বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে মেশে৷
ছবি: Blacksmith Institute
বার বার সময় নিচ্ছেন মালিকরা
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা-র সমন্বয়কারী ইকবাল হাবিব সম্প্রতি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ২০০৩ সালে হাইকোর্ট হাজারিবাগের চামড়া কারখানাগুলো সরিয়ে নিতে বলেছেন৷ এরপর সরকার এবং ট্যানারি মালিকরা মিলে অন্তত ১০ বার সময় নিয়েছে৷ এতে প্রমাণিত হয়, সরকার বা ট্যানারি মালিক কেউই এ ব্যাপারে আন্তরিক নয়৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
ময়লা জলে কাপড় ধোয়া
বিষাক্ত বর্জ্য, তেল আর রাসায়নিক পদার্থ মিলে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে৷ তারপরও এই পানি ব্যবহার করা হচ্ছে ধোঁয়ামোছার কাজে৷ ছবিতে বুড়িগঙ্গার ময়লা জলে কাপড় পরিষ্কার করেছেন এক ধোপা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শীর্ণ বুড়িগঙ্গা
দখলের কারণেও শীর্ণ হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা৷ এই নদীর ৪ হাজার দখলদারকে ২০১০ সালের শুরুর দিকেই চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসন৷ তবে চিহ্নিত হলেও অবৈধ দখলদারদের উদ্ধার অভিযান আজও গতি পায়নি৷
ছবি: dapd
গতি পাচ্ছে না পর্যটন
দূষিত পানি এবং দুর্গন্ধের কারণে বুড়িগঙ্গা নদী ভ্রমণ থেকেও বিরত থাকছেন পর্যটকরা৷ ফলে এখাত থেকে অর্থ উপার্জনের উপায় থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না৷ পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতাও বুড়িগঙ্গার মাঝিদের উপার্জনের উপর প্রভাব ফেলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চল্লিশ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বুড়িগঙ্গার পানিতে এখন লেড ও ক্যাডমিয়ামসহ ৬ ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আছে৷ তা শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, আশেপাশের ৫৬ কিলোমিটার নদীকে দূষিত করছে৷ আর এই দূষিত পানির কারণে ৪০ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
8 ছবি1 | 8
বাংলাদেশের পানি এবং আন্তর্জাতিক নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী মো. ইমামুল হক ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এই প্রকল্পে ভারতের অনীহা দেখানোর কোনো কারণ নেই৷ দরকার নেই তাদের সায় নেয়ারও৷ ভারত ফারক্কা বাধ নির্মাণের সময় কারুর সায় নেয়নি৷ তাছাড়া বাংলাদেশে গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারতের কোনো ক্ষতি হবে – এই ধারণা অমূলক৷ কারণ গঙ্গার বাংলাদেশ অংশ গঙ্গার ভাটিতে৷ আমরা যে পানি পাই, তাই রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বহুমুখি ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে৷''
প্রকৌশলী ইমামুল হক বলেন, ‘‘গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের প্রকল্প৷ এই প্রকল্পে ভারতের সায় নেয়ার নামে একটি মহল ভারতকে উসকে দিচ্ছে৷''
তবে তাঁর কথায়, ‘‘পাংশায় এই ব্যারেজ না করে কুষ্টিয়ার গড়াই নদীতে করলে বাংলাদেশ আরো লাভবান হবে৷ জিকে প্রকল্পে পানি দেয়া যাবে৷ আর দেশের দক্ষিম-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে সুন্দরবন লবণাক্ততা থেকে রক্ষা পাবে৷ সুরক্ষা দেওয়া যাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও বনজ সম্পদেরও৷''
প্রিয় পাঠক, গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারতকে কি আন্তরিক মনে হয়? নীচে আপনার মতামত জানান৷