খবরটা আশা জাগানিয়া৷ বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে৷ এক অর্থে এটাকে সমৃদ্ধির লক্ষণ বলে ধরেই নেওয়া যেতে পারে৷ কিন্তু বয়েস বাড়াটাই তো সব নয়! একইসঙ্গে এটাও কিন্তু ভাবতে হবে যে, প্রবীণদের কতটা সুখ, শান্তি আমরা দিতে পারছি৷
বিজ্ঞাপন
আমরা, বাংলাদেশিরা আবেগপ্রবণ৷ তাই আমাদের প্রবীণরা সম্পদ থাকা বা না থাক – সন্তানের, আপনজনের সান্নিধ্যে থাকতে তাঁরা পছন্দ করেন৷ শেষ বয়সে নিজ সন্তানের কাছ থেকে তাঁরা সেবা, সময় আশা করেন৷
সমস্যা হচ্ছে, বর্তমান যুব সমাজ সম্ভবত প্রবীণদের এই আবেগটুকু বুঝতে পারেন না৷ যৌথ পরিবারের ধারণাও ক্রমশ উঠে যাচ্ছে৷ তরুণ প্রজন্ম উন্নত জীবনের আশায় গ্রাম কিংবা মফস্বল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন শহরে৷ বাবা-মাকে রেখে যাচ্ছেন গ্রামে৷ তাই প্রবীণ বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা হয়ে যাচ্ছেন আরও অসহায়৷ শেষ বয়সে যে সময়টা তাঁদের শান্তিতে থাকা উচিত, সেই সময়টাও তাঁদের কাটছে দুশ্চিন্তায়, হতাশায়৷
অবশ্য যেসব প্রবীণ শহরে থাকেন, তাঁদের অবস্থা যে খুব ভালো তাও বলা কঠিন৷ কথা হচ্ছিল হেল্পএজ ইন্টারন্যাশনালের সেগুফতা শারমিনের সঙ্গে৷ প্রবীণদের অধিকার নিয়ে কাজ করা দাতব্য সংস্থাটির ‘অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স কোর্ডিনেটর' তিনি৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং হেল্পএজের এক জরিপের ভিত্তিতে তিনি জানান, শহরের বস্তিতে বসবাসরত প্রবীণদের মধ্যে ৫৪ শতাংশই পরিবারের মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন৷
গণমাধ্যমেও মাঝে মাঝে এ রকম খবর প্রকাশ হয়৷ সম্পদের দখল নিতে মাকে নির্যাতন করছেন সন্তান৷ অনেক সময় স্ত্রীর চাপে পিতা-মাতাকে দিয়ে আসছেন বৃদ্ধাশ্রমে৷ কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটি খবর শেয়ার করেছিলেন অনেক মানুষ৷ বৃদ্ধাশ্রমে থাকা এক মা তাঁর সন্তানের কাছে আকুতি জানিয়েছেন যে, মারা গেলে নাকের নাকফুলটি বিক্রি করে যাতে তাঁকে দাফন করা হয়৷ কতটা কষ্ট থেকে একজন মা এমন কথা বলতে পারেন, সেটা সহজেই বোঝা যায়৷
আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩' চালু করেছেন৷ এই আইনের আওতায় ভরণ-পোষণে ব্যর্থতার জন্য সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড হতে পারে, আর সেই অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে তিন মাস কারাভোগের সাজারও ব্যবস্থা রয়েছে৷ সেগুফতা শারমিন অবশ্য জানান, আইন হলেও বিষয়টি প্রচার কম হয়েছে৷ তাই অনেক মানুষ এটার কথা জানেনা৷ আর আইনটি প্রয়োগও হচ্ছে কম৷
সাগুফতা জানান, বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে৷ এই বেড়ে চলা মানুষদের সহায়তার জন্য যে প্রস্তুতির দরকার, তা নেই৷ তাছাড়া সবার জন্য সামাজিক ভাতাও নেই৷ সব মিলিয়ে তাই বাংলাদেশে ষাটোর্ধ ১১ দশমিক দুই মিলিয়ন মানুষ খুব যে ভালো আছেন সেটা বলার সময় এখনো আসেনি৷
তবে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা প্রবীণরা সবাই মন্দ আছেন, ব্যাপারটা তেমনও নয়৷ তবে দুশ্চিন্তা যাঁরা কষ্টে আছেন, তাঁদের নিয়ে৷ আমার মনে হয়, ভরণপোষণ আইনের পাশাপাশি এ বিষয়েও সচেতনতা বাড়াতে হবে৷ বর্তমান নবীন প্রজন্মকে নিজেদের ভবিষ্যতটাও যে ভাবতে হবে! নিজেদের বসাতে হবে বর্তমান প্রবীণদের জায়গায়৷ কারণ, একটা সময় আজকের তরুণরাও যে প্রবীণ হবেন, বৃদ্ধ হবেন৷ তাহলেই তাঁরা বুঝবেন যে নিজেদের দায়িত্ব পালন করাটা আসলে কতটা প্রয়োজনীয়৷
তাই সামাজিকভাবে প্রবীণদের সঙ্গে নবীনদের সম্পর্কটা আরো মজবুত করার উদ্যোগ নিতে হবে৷ আর প্রবীণদের আর্থিক দিকটাও যাতে ঠিক থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে৷ তাঁদের চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিৎ এবং সহজ করতে হবে৷ কাজ অনেক, তাই এগোতে হবে পরিকল্পনা করে৷
দীর্ঘজীবন লাভে বিশেষজ্ঞদের কিছু সহজ পরামর্শ
এই সুন্দর ভুবন ছেড়ে কে আর চলে যেতে চায়? দীর্ঘ জীবন যে সবারই কাম্য৷ তবে সেই জীবন কি সুস্থ, সুন্দর হবে? না অসুস্থ অবস্থায় শুধু বেঁচে থাকাটাকেই আপনি জীবন বলবেন? এ বিষয়েই বিশেষজ্ঞদের কিছু পরামর্শ থাকছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: imago/CHROMORANGE
দীর্ঘজীবী হওয়ার রহস্য কী?
জার্মানিতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে৷ এর পেছনে রয়েছে অনেক কারণ৷ তবে সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রা অবশ্যই একটা বড় কারণ৷ সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন বলতে ঠিক কী বোঝায়? শুধু খাওয়া-দাওয়া, ব্যায়াম, নাকি দীর্ঘজীবী হওয়ার রহস্য অন্য কিছু? বিশেষজ্ঞরা কী বলেন?
ছবি: Robert Kneschke - Fotolia.com
ম্যাজিক শব্দ – ‘অ্যান্টি এইজিং’
এই জাদু শব্দটির মধ্যে কী লুকিয়ে আছে? জার্মান বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘজীবী হতে তিনটি জিনিস প্রয়োজন৷ শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জন, হাঁটাচলা, অর্থাৎ সচল থাকা এবং ভালোবাসা৷ আর এ তিনটি বিষয়ই রয়েছে মানুষের নিজের হাতে, যা প্রকৃতিই তাদের দিয়েছে৷ তাই এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিলেই তারুণ্য ধরে রাখা সম্ভব৷
ছবি: Fotolia/K. Eppele
দীর্ঘজীবী হওয়ার রাজকীয় পন্থা
তারুণ্য ধরে রাখতে বা দীর্ঘজীবী হতে নিয়মিত উপোস করা বা রোজা রাখা – এর মানে কিন্তু না খেয়ে থাকা নয়৷ ‘‘সপ্তাহে দু’দিন রাতের খাবার বিকেল চারটায় এবং আরো দু’দিন সন্ধ্যা ৬টায় খেতে হবে৷ খালি পেটে বিছানায় যাওয়া এবং খাওয়ার সময় পেট ভরে না খাওয়া৷’’ বলেন প্রফেসর ডা. ইয়োহানেস হুবার৷
ছবি: dream79 - Fotolia.com
অনেক রোগের ঝুঁকি কমায়
ডা. হুবার আরো বলেন, রাতে কম খেলে ক্যানসার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার ঝুঁকি কমে৷ তাছাড়া রাতে দু-চার দিন পেট খালি থাকলে, অর্থাৎ কম খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা কমে এবং প্যানক্রিয়াসে ইনসুলিনের মাত্রা হ্রাস পায়৷ এছাড়া রাতে শরীরের বিভিন্ন অংশ বিশ্রাম করারও সুযোগ পায়৷
ছবি: Philips
মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে মস্তিষ্কের ব্যায়াম
মানসিকভাবে সুস্থ থাকাই তরুণ মস্তিষ্কের প্রমাণ৷ তাই ‘‘প্রতিদিন একটি করে কবিতা মুখস্থ করুন, পড়ুন আর ৫০ বছরের পর যে কোনো বাদ্যযন্ত্র বা বিদেশি ভাষা শেখা শুরু করুন৷’’ এগুলো ব্রেনের স্টেম সেলগুলো সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে৷ ফলে স্মৃতি শক্তির ট্রেনিং হয়, যা আলৎসহাইমার মতো অসুখের ঝুঁকি কমায়৷
ছবি: Nurunnahar Sattar
ভালোবাসা
মানসিক কষ্ট হৃদয় ভেঙে দেয়, সেকথা কে না জানে৷ সুস্থ শরীর এবং মনের জন্য ভালোবাসা অপরিহার্য৷ তাই ‘‘নিজে ভালোবাসুন এবং অন্যকে ভালোবাসার সুযোগ দিন৷ দাম্পত্যজীবন যেন সুখের ও মধুর হয়, সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দিন৷ কারণ তারুণ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে সুস্থ যৌনজীবনের ভূমিকা অনেক৷’’
শরীরের এবং মস্তিষ্কের জন্য প্রয়োজন সামুদ্রিক মাছ, শাক-সবজি, ফল, আঁশযুক্ত খাবার, বাদাম, বিশেষকরে কাঠ বাদাম ও আখরোট৷ পাশাপাশি গ্রিন টি ও যথেষ্ট পরিমাণে পানি পান করা উচিত৷ আর অতিরিক্ত মদ্যপান এবং ধূমপান থেকে দূরে থাকা৷ মোট কথা খাদ্যের পুষ্টিগুণ বা মানই আসল, খাবারের পরিমাণ নয়৷
ছবি: Fotolia/ExQuisine
ব্যায়াম
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বারবারা ফেবার্স লিপমান মনে করেন, তারুণ্য ধরে রাখতে হাঁটা-চলা বা ব্যায়ামের জুড়ি নেই৷ বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড়গুলো ক্ষয় হতে শুরু করে, কাজেই ছোটবেলা থেকেই নিয়মিত হাঁটা, সাইকেল চালানো বা হালকা ব্যায়াম করতে হবে, সপ্তাহে অন্তত তিনদিন ৪৫ মিনিট করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Arno Burgi
মনকে প্রফুল্ল রাখা
সুশৃঙ্খল জীবন, স্বাস্থ্যকর খাবার, ব্যায়ামের পাশাপাশি মনকে প্রফুল্ল রাখা এবং স্ট্রেস থেকে দূরে থাকা দরকার৷ যাঁর যা ভালো লাগে দিনে কিছুক্ষণের জন্য হলেও তা করুন৷ যেমন গান শোনা, বন্ধুকে ফোনা করা, গাছের পরিচর্যা বা কম্পিউটার গেম খেলা৷ এছাড়া শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে যথেষ্ট ঘুমেরও প্রয়োজন৷