গণঅসন্তোষ, গণবিক্ষোভ
২১ আগস্ট ২০১৮কানসাটের বিদ্যুৎ আন্দোলন এখনো বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি৷ ‘কানসাট আন্দোলন' নামে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওই আন্দোলন সারা দেশকে নাড়া দিয়েছিল৷ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুতের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয় এবং এপ্রিল মাসে আন্দোলনের সফল সমাপ্তি হয়৷ ওই আন্দোলেনে জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে ২০ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত এবং শতাধিক আহত হয়৷ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন গোলাম রব্বানি৷ একই সময়ে ঢাকার শনির আখড়ায় বিদ্যুতের দাবিতে রাস্তায় নেমে সহিংস বিক্ষোভ করেন নগরবাসী৷ আর বিক্ষোভের মুখে তখনকার স্থানীয় সংসদ সদস্য সালাহউদিন আহমেদ পালিয়ে যান৷ এই দু'টি আন্দোলনের সময়ই বিএনপি ছিল শাসন ক্ষমতায়৷ বিদ্যুৎ নিয়ে আন্দোলন পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব ফেলে৷
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুন্সিগঞ্জের আড়িয়াল বিলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় সাধারণ মানুষের আন্দোলন এবং গণঅসন্তোষের মুখে৷ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ গণঅসন্তোষের আরেকটি বড় উদাহরণ, যা গড়ে উঠেছিল যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে৷ সেই দাবি পূরণ হয়েছে৷
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় চলতি বছরের শুরুতে৷ কিন্তু তা চূড়ান্ত রূপ পায় মার্চ-এপ্রিলে৷ এই আন্দোলন ছাত্রদের হলেও নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ এতে সমর্থন জানিয়ছে৷ সরকার শেষ পর্যন্ত কোটা সংস্কারের দাবি মেনে নিলেও সংস্কারকে কোটা বাতিলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷ আর তাতে নতুন জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে৷ শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদে গ্রেপ্তার নির্যাতন অব্যঅহত আছে৷
সর্বশেষ ২৯ জুলাই ঢাকায় দু'জন স্কুল শিক্ষার্থীর বাস চাপায় নিহত হওয়ার ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা৷ আট দিনের এই আন্দোলন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে৷ এই আন্দোলনের শেষ দুই দিনে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘাত-সংঘর্ষ হয়৷ সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়৷ আন্দোলনের জেরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন ছাত্রকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়৷ শুধু তাই নয়, আন্দোলন চলাকালে পুলিশের সঙ্গে থেকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা ছাত্রদের ওপর হামলা চালায় বলেও অভিযোগ আছে৷ এখানেও সরকার ছাত্রদের নিরাপদ সড়কের ৯ দফা মেনে নিয়েছে বলে জানিয়েছে৷
বাংলাদেশে কখনো কখনো রাজনৈতিক আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত গণঅসন্তোষ বা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে, যার মধ্যে ৯০-এর অভ্যুত্থাণ অন্যতম৷ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নিলে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়৷ আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থাণ তো ইতিহাস৷ এর ফলে তখনকার পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে নিকট অতীতে বা সাম্প্রতিক সময়ে যে গণআন্দোলন এবং অসন্তোষের যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগ নেই৷ এই গণঅন্তোষের ঘটনা ঘটেছে যে কোনো একটি শ্রেণির মাধ্যমে৷ তাঁদের যেসব দাবি ছিল, সেগুলো ন্যায্য হওয়ায় তাতে সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল৷ এমনকি সরকারও ওইসব দাবি যৌক্তিক বলে স্বীকার করেছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেনেও নিয়েছে৷ তবে এইসব আন্দোলন থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো কানো রাজনৈতিক শক্তি সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করায় তা ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে বা প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা গেছে৷
বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনীতি এবং সরকারের ব্যর্থতার কারণেই এসব গণঅসন্তোষ বা গণরোষের সৃষ্টি হয়৷ কারণ, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ জমতে থাকে৷ তারা ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ হতে থাকে৷ আর কোনো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে তার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে৷ কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়কের দাবি যৌক্তিক দাবি৷ আর বাংলাদেশের মানুষ সড়ক দুর্ঘটনা ও সড়কে বিশৃঙ্খলা নিয়ে ক্ষুব্ধ অনেক দিন ধরেই৷ এই ক্ষোভের চরম প্রকাশ ঘটেছে ২৯ জুলাই সড়ক দুর্ঘচনায় দু'জন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর৷ শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এলেও তার সঙ্গে অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমেছেন৷ একই কথা প্রযোজ্য কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে৷ ২০০৬ সালে কানসাটের বিদ্যুৎ আন্দোলনকেও একইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়৷
বিশ্লেষকদের মতে, নাগরিকরা তাঁদের নানা চাওয়া-পাওয়া এবং না পাওয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ হন৷ তাঁরা এটা প্রকাশও করতে চান৷ এই প্রকাশের পথ রুদ্ধ হওয়াও গণঅন্তোষের আরেকটি কারণ৷ রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ হচ্ছে মানুষের ন্যায্য দাবি এবং চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আন্দোলন করা৷ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা৷ আর সরকারের উচিত নগারিকদের যৌক্তিক এবং ন্যায্য দাবিগুলো মেনে নেয়া বা পুরণ করা৷ দাবি তোলার আগেই সরকারকে অনেক সময় তা পুরণ করতে হয়৷ কিন্তু এই সাধারণ যৌক্তিক বিষয়গুলো যখন না হয়, তখন নাগরিকদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের হঠাৎ করেই বহিঃপ্রকাশ ঘটে কোনো একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে৷ সাধারণ চোখেএটাকে হঠাৎ মনে হলেও আসলে এগুলো হঠাৎ কোনো ঘটনা নয়৷ বাংলাদেশে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে মাঠে নামা প্রমাণ করে সড়কে হত্যা এবং বিশৃঙ্খলা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ কোন পর্যায়ে গিয়েছিল৷
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষের এইসব আন্দোলন এবং অসন্তোষের পিছনে যৌক্তিক কারণ আছে৷ আর সরকারও তা স্বীকার করে৷ কোটা সংস্কার বা স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে জনসমর্থন আছে৷ তাছাড়া এই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়৷ কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু খারাপ উপাদান ঢুকে যাওয়ায় পরের দিকে হয়তো আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা ছিল৷''
তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষ যখন তাঁদের সমস্যার কোনো প্রতিকার না পায়, তখন তাঁদের মধ্যে নানা ধরনের ক্ষোভ জমতে থাকে৷ কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে৷ সরকারের উচিত সবসময় এসব যৌক্তিক আন্দোলনকে ইতিবাচকভাবে নেয়া এবং একটি কমিশন গঠন করে যৌক্তিক দাবিগুলোকে মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারের উচিত নাগরিকরা কী চায়, নাগরিকদের কোথায় পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে আগে থেকেই সেসব সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নেয়া৷ তাহলে হয়তো এসব নগারিক ক্ষোভ, বিক্ষোভ এড়ানো সম্ভব৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার এই সামাজিক ক্ষোভ-বিক্ষোভকে ব্যাখ্যা করেন আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের ধারাকে আশ্রয় করে৷ তাঁর মতে, ‘‘রাজনৈতিক দল এবং সরকারকে দাবি জানাতে বা দাবি পূরণে এখন মানুষ নিজেরাই তৃতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে৷ এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিদেশেও হচ্ছে৷ ওয়াল স্ট্রিট মুভমমেন্ট তার বড় উদাহরন৷ আর এইসব আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষকে সংগঠিত করার বড় মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘সরকার ও রাজনৈকি দলগুলোর প্রতি এক ধরনের আস্থাহীনতার কারণেই মানুষ মাঠে নামছে৷ আর তাঁরা মাঠে নামছে বিভিন্ন ইস্যুতে৷ এটা কিন্তু সরকার পতনের কোনো আন্দোলন নয়৷ এটা সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করা অথবা চাপ সৃষ্টি করার জন্য করা হয়৷ সরকারের উচিত এটা বোঝা এবং সেভাবে কাজ করা৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, নতুন এই পরিস্থিতির সঙ্গে সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারছে না৷ তাদের কাছে এটা নতুন এবং তারা এর গতি-প্রকৃতিও ধরতে পারছে না৷ ফলে কেউ এই আন্দোলনকে ভয় পাচ্ছে৷ আবার কেউ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু কোনো পক্ষই ঠিকভাবে এইসব আন্দোলনকে পাঠ করতে পারছে না৷ এটা বুঝতে হবে৷ এবং মত প্রকাশের নতুন এই ধারা সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে৷''