গণটিকায় ব্যাপক সাড়া মিললেও অনেকেই টিকা পাচ্ছেন না৷ কেউ কেউ দুই দিন লাইনে দাঁড়িয়েও টিকা পাননি৷ লম্বা লাইন থাকতেই টিকা শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ মারামারির খবরও পাওয়া যাচ্ছে৷ আর টিকা কেন্দ্রগুলোতো মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি৷
শনিবার গণটিকা কার্যক্রম শুরুর দিন ঢাকার কেরাণীগঞ্জে একটি কেন্দ্রের বাইরে টিকার জন্য অপেক্ষায় মানুষছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
বিজ্ঞাপন
ঢাকার ভাষানটেক এলাকায় টিকাকেন্দ্রে রোববার গণটিকার দ্বিতীয় দিনে দেখা গেছে বেজায় ভিড়৷ ৯ টায় টিকা দেয়া শুরু হলেও ভোর থেকেই লোকজন লাইনে দাঁড়ান৷ এই করোনার মধ্যেও লাইনে লোকজন ছিলেন ঠাসা৷ বিকাল ৩টা পর্যন্ত টিকা দেয়ার কথা থাকলেও দুপুর ১২ টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়৷ বৃষ্টির মধ্যে তখনো দীর্ঘ লাইন৷ সেখানে টিকা না পেয়ে অনেকই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন৷ তাদেরই একজন রহিমা বেগম জানান, ‘‘গতকাল (শনিবার) টিকা দিতে এসেছি টিকা পাই নাই৷ আজ (রবিবার) আবার কাজ ফেলে টিকা দিতে এসেছি আজও টিকা পাই নাই৷ এত টিকা কোথায় গেল? আমার টিকা কোথায়?’’
আরেকজন আব্দুর রহিমও প্রথম দিনে টিকা পাননি৷ রোববার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তিনি লাইনে টিকা দেয়ার কাছাকাছি পৌঁছে যান৷ তাই তাকে অনেকটাই আশ্বস্ত দেখা যায়৷ তিনি বলেন, ‘‘লাইনের একদম সামনে পৌঁছে গেছি৷ মনে হয় পাব৷ আল্লাহ ভরসা৷’’
‘দুইজন অজ্ঞান হয়ে গেছে’
This browser does not support the audio element.
আর মাজেদা বেগমের লাইনে ঢুকতেই হিমশিম খেতে হয়েছে সেই সকালে৷ লাইনে ঢুকতে পারলেও টিকা পাবেন কিনা নিশ্চিত নন৷ সবচেয়ে হতাশা দেখা গেছে শফিকুর রহমানের৷ একদম কাছে গিয়ে তার টিকা অল্পের জন্য ফসকে গেছে৷ তিনি জানান, ‘‘টিকা আছে ১০টি আমার সিরিয়াল ১১৷ পেলাম না৷’’ তিনি সোমবার আবার চেষ্টা করবেন বলে জানান৷
টিকা কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, প্রতিদিনের জন্য তাদের ৩০০ টিকা বরাদ্দ৷ এর বাইরে তারা দিতে পারেন না৷ কিন্তু বরাদ্দের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ মানুষ লাইনে দাঁড়াচ্ছেন৷ এদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাদের ও মেম্বার চেয়ারম্যানদের ‘শুভেচ্ছা স্লিপে’ কেউ কেউ ভিন্ন পথেও টিকা পাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে৷ ভোলাসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় ভ্যাকসিন নিয়ে হাতাহাতি ও উত্তেজনার খবর পাওয়া গেছে৷ ভোলায় স্বেচ্ছাসেবীরা হামলার শিকার হয়েছেন৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছিল ৭ আগস্ট দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন এলাকায়, ৮ ও ৯ আগস্ট ইউনিয়ন ও পৌরসভার বাদ পড়া ওয়ার্ডে এবং ৭ থেকে ৯ আগস্ট সিটি কর্পোরেশন এলাকায় টিকাদান কর্মসূচি চলবে৷ দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৮ ও ৯ আগস্ট এবং ১০ থেকে ১২ আগস্ট রেহিঙ্গা ক্যাম্পে ৫৫ বছর বয়সিদের টিকা দেয়া হবে৷ কিন্তু বাস্তবে এই শিডিউল মানা হচ্ছে না৷ প্রথম দিন যেসব কেন্দ্রে টিকা দেয়া হচ্ছে দ্বিতীয় দিনেও সেইসব কেন্দ্রে টিকা দেয়া হয়৷
গণটিকার কাজে চার হাজার ৬০০টি ইউনিয়ন, এক হাজার ৫৪টি পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশন এলাকার ৪৩৩টি ওয়ার্ডে ৩২ হাজার ৭০৬ জন টিকাদানকারী এবং ৪৮ হাজার ৪৫৯ জন স্বেচ্ছাসেবী নিয়োজত আছেন৷ তারা প্রতিটি কেন্দ্রে প্রতিদিন ৩০০ জনকে টিকা দিবেন৷ ফলে যারা টিকা দিতে আসছেন তাদের সবাইকে কোনোভাবেই টিকা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে গণ ও নিবন্ধিত মিলিয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৭ লাখ ৮৩ হাজার ১৭২ জন টিকা পেয়েছেন৷ আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘‘সবাইকে দেয়ার মতো টিকা সরকারের হাতে তো নাই৷ আর পাইপলাইনে যা আছে তা দিয়েও হবে না৷ সবাইকে টিকা দিতে হলে স্থানীয়ভাবে টিকা উৎপাদন করতে হবে৷ তবে এই গণটিকায় বোঝা গেল টিকা নিয়ে মানুষের ভয় কেটে গেছে, ব্যাপক উৎসাহ তৈরি হয়েছে৷ এটা একটা ভালো দিক৷ কিন্তু ব্যবস্থাপনার সংকট দেখা যাচেছ৷’’
ফরহাদ হোসেন
This browser does not support the audio element.
তিনি বলেন, ‘‘একটি কেন্দ্র গণটিকা কর্মসূচিতে যত টিকা দিতে পারবে প্রথম দিনই লাইনে যারা দাঁড়িয়েছেন তার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে স্লিপ দিতে পারত৷ তাহলে বাকিরা চলে যেতেন, অপেক্ষা করতে হত না৷ আর দ্বিতীয় দিনও টিকার জন্য এসে অযথা অপেক্ষা করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত না৷’’
এনিয়ে চেষ্টা করেও রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো শীর্ষ কর্মকর্তার বক্তব্য জানা যায়নি৷
বাংলাদেশে চলমান লকডাউন শেষ হচেছ ১০ আগস্ট৷ এরপর পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে সব কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন৷ রোববার তিনি বলেন, ‘‘আমরা পরিবহণ শ্রমিকসহ আরো বিভিন্ন সেক্টরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ আরো যাদের জনসম্পৃক্ত কাজে বাইরে আসতে হয় তাদের আগে টিকা দেয়া হচ্ছে৷ আর সবাইকে মাস্ক পরতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে৷’’
এদিকে করোনায় সংক্রমণের হার গত ২৪ ঘণ্টায় কিছুটা কমেছে৷ এই হার এখন ২৪.৫২ ভাগ বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে৷ এই সময়ে মারা গেছেন ২৪১ জন৷ আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ১০ হাজার ২৯৯ জন৷
প্রবাসীদের টিকাদান: ভোগান্তি, উধাও স্বাস্থ্যবিধি
কাজে যোগ দিতে এবং কোয়ারান্টিনের খরচ বাঁচাতে প্রবাসীদের টিকাদানের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ৷ এজন্য জনশক্তি কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-তে নিবন্ধন করে সুরক্ষা অ্যাপের মাধ্যমে টিকা নেওয়া সুযোগ রাখা হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঢাকায় টিকাকেন্দ্র সাতটি
প্রবাসী কর্মীদের টিকাদানের জন্য ঢাকায় সাতটি কেন্দ্র খোলা হয়েছে৷ কেন্দ্রগুলো হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল এবং শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিকাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে দ্বিতীয় তলার করিডোরে মানুষের ভিড়, নেই কোন সামাজিক দূরত্ব৷ প্রবাসীরা তীব্র গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে ক্লান্ত৷ অনেকের মুখে ছিল না মাস্ক৷ একজনকে প্রশ্ন করলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘টিকার ব্যবস্থা করেন আগে, মাস্কের কথা পরে জিগাইয়েন৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মাঝরাত থেকে সিরিয়াল
টিকা নিয়ে দশটার দিকে ফেরত যাচ্ছিলেন সৌদি আরবে গমনেচ্ছু চট্টগ্রামের বাসিন্দা ফয়সাল আহমেদ চৌধুরি৷ এতো দ্রুত কিভাবে টিকা পেলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ভাই, সিরিয়াল দিসি কালকে রাত ২টায়৷’’ কেন এতো আগে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘‘এতো মানুষ, ঐদিন সকালে এসে সিরিয়াল দিলে টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
এসএমএস ছাড়া টিকা নয়
নিবন্ধনের পর মোবাইলে আসা এসএএমএস ছাড়া কাউকে টিকা দেওয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ঢাকার একাধিক টিকাকেন্দ্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা৷ প্রবাসীদের ক্ষেত্রে যারা অনেকদিন আগে নিবন্ধন করেছেন কিন্তু এখনো এসএমএস পাননি, তাদের ক্ষেত্রে কী করা হবে জানতে চাইলে তারা বলেন, এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিবে৷ তাদের কিছু করার নেই৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা নিতে এসেছেন এমন একাধিক প্রবাসী অভিযোগ করেন, দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা জনপ্রতি ৫০০-১০০০ টাকা ঘুসের বিনিময়ে সিরিয়ালের বাইরের লোকজনকে টিকাকেন্দ্রে ঢুকতে দিচ্ছেন৷ অপরদিকে হাসপাতালটির সুপারভাইজার আব্দুল মান্নান বিশ্বাস বলেন, প্রবাসীরা নিয়ম মানছেন না, বিশৃঙ্খলা করছেন৷ সবাই আগে যেতে চাইছেন বিধায়ই এত বড় সিরিয়াল তৈরি হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ফেরত যাচ্ছেন অনেকে
সৌদি আরবে যাওয়ার ভিসা নিয়ে ১৭ আগস্টের বিমানের টিকেট কেটেছেন কুমিল্লার বাসিন্দা মোঃ সাব মিয়া৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে টিকা না নিয়েই তাকে ফেরত যেতে হয়৷ কারণ জানতে চাইলে টিকাকেন্দ্রের দায়িত্বরত মোঃ তৌহিদ জানালেন, ‘‘উনি ফাইজারের প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন সৌদি আরবে৷ যারা প্রবাসে প্রথম ডোজ নিয়েছেন, দেশে তাদের দ্বিতীয় ডোজের ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি৷ তাই ওনাকে বলেছি এক সপ্তাহ পরে আবার আসতে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কোন কেন্দ্রে কোন টিকা?
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিকাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল সেখানে প্রবাসীদের বায়োনটেক-ফাইজার, মডার্না ও সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হচ্ছে৷ অপরদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে দেওয়া হচ্ছে বায়োনটেক-ফাইজার, অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকা এবং সিনোফার্মের টিকা৷ টিকাদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রাপ্তি সাপেক্ষে বিভিন্ন কেন্দ্রে বিভিন্ন টিকা দেওয়া হচ্ছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
হাসপাতাল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল সেখানে দ্বিতীয় তলায় শুধু প্রবাসীদের টিকা দেওয়া হচ্ছে৷ তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রবাসীদের জন্য পৃথক কোন ব্যবস্থা নেই৷ সাধারণ মানুষদের সাথেই তাদের টিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নারী, বয়স্কদের সিরিয়ালের প্রয়োজন নেই
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিকাকেন্দ্রে পুরুষদের একাধিক লম্বা লাইন থাকলেও নারীদের কোন লাইন ছিল না৷ দায়িত্বরত একজন ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা গেল, যেহেতু নারী এবং বয়স্ক প্রবাসীদের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম, তাই তাদের জন্য আলাদা লাইন করা হয়নি৷ তারা সরাসরি টিকা দিয়ে চলে যেতে পারছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কেন্দ্রভেদে পরিস্থিতির ভিন্নতা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রবাসীদের টিকাকেন্দ্রে ভিড় ছিল তুলনামূলক কম৷ বড় পরিসরে খোলামেলা পরিবেশে সেখানে টিকাদান চলছে৷ বুথের সংখ্যাও অন্যদের চেয়ে বেশি৷ টিকা নিতে আসা প্রবাসীদেরকে সেচ্ছাসেবীরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন৷ উল্টো পরিস্থিতি দেখা গেছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে৷