ইরাকে আইসিস, মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড, লিবিয়া ও টিউনিশিয়ায় স্থিতিহীনতা: আরব বসন্ত যাবৎ গণতন্ত্র কোথায় সফল হয়েছে? সংসদীয় নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, বলেছেন আইপিইউ-এর বিদায়ী প্রধান আন্ডার্স জনসন৷
বিজ্ঞাপন
আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রসমাজ গণতন্ত্রের রাজনৈতিক বুনিয়াদ স্থাপনে সহায়তা করতে ব্যর্থ হয়েছে, বলে অভিযোগ করেছেন ইন্টারন্যাশনাল পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ)-এর বিগত ১৬ বছরের সভাপতি, যিনি আগামী মঙ্গলবার অবসর নিচ্ছেন৷
আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রসমাজ মুক্ত নির্বাচনের প্রস্তুতিতে কোটি কোটি ডলার ঢালে, কিন্তু নবনির্বাচিত সংসদগুলিকে কার্যকরি হওয়ায় সাহায্য করতে ভুলে যায় – ফরাসি এএফপি সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন জনসন৷
‘‘সংসদীয় নির্বাচনকে বাকি সব কিছু ভুলে গিয়ে সরকারের বৈধকরণের পন্থা হিসেবে দেখার একটা প্রবণতা আছে৷ কিন্তু সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলি হচ্ছে সেই সব স্থান, যেখানে সরকার কিভাবে চলছে অথবা চলছে না, সমাজের সব স্তরের, সব অংশের মানুষদের সে বিষয়ে মন্তব্য করার অধিকার থাকবে'', যোগ করেন জনসন৷
জনতার রোষ থেকে যার জন্ম
জনসনের বক্তব্য জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুনের কিছু সাম্প্রতিক মন্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়৷ বান গত সপ্তাহে জেনেভায় বলেছিলেন: ‘‘আরব বসন্তের সূচনা থেকে আমি সব নেতাদের জোর দিয়ে বলে আসছি যে, জনতার ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি তাঁদের মনোযোগ দেওয়া জরুরি৷ সমস্যার একটা বড় কারণ হলো, নির্বাচিত হওয়ার পর নেতারা সেটাকে স্বাভাবিক বলে মনে করেন৷ কিন্তু বৈধতা শুধু নির্বাচন থেকে আসে না, সুশাসন থেকেও আসে, আসে মানবাধিকার রক্ষা থেকে, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া থেকে৷''
জনসন চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন দাবি করেছেন৷ প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রগুলির উচিত সাহায্য করা, তবে নিয়মকানুন বেঁধে না দিয়ে৷ ‘‘রাজনীতি করার অন্য একটা পন্থা থাকা উচিত৷ এটা নিশ্চিত করা উচিত যে, নির্বাচনের পরদিনও রাজনীতি সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রক্রিয়া থাকবে, যে প্রক্রিয়াকে কাজ করতে দেওয়া হবে, যে প্রক্রিয়াকে সফল হতে সাহায্য করা হবে'', বলেছেন জনসন৷
নির্বাচন দেশে দেশে
রোববার জার্মানিতে সংসদ নির্বাচন৷ এই নির্বাচনকে সামনে রেখে চলুন দেখে নিই বিভিন্ন দেশে ভোটের চালচিত্র৷
ছবি: DW
বিশাল আয়োজন
ভারতের ২০০৯ সালের নির্বাচনে ৭১ কোটি ৪০ লাখ ভোটার ছিল৷ সবগুলো রাজ্যের ভোট শেষ হতে এক মাসের মতো সময় লেগেছিল৷ ভোট হয়েছিল পাঁচ ধাপে, তাতে কাজে লাগানো হয়েছিল ১৪ লাখ ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন৷ আর কোনো দেশে কখনো এত বিশাল আঙ্গিকের ভোট হয়নি৷ বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশে পরবর্তি নির্বাচনটি হবে ২০১৪ সালে৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
ব্যালটের রাজত্ব
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের নির্বাচনে এখনো ব্যালট পেপার ব্যবহার করা হয়৷ দল বা প্রার্থীদের জন্য নির্ধারিত প্রতীকের ছবি সম্বলিত কাগজে ‘সিল’ মারেন ভোটাররা৷ এই ছবিটি এ বছর হয়ে যাওয়া জিম্বাবোয়ের সাধারণ নির্বাচনের৷ সে সময় ভোটে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল৷ কিন্তু সে দেশের সাংবিধানিক আদালত নির্বাচনকে ‘বৈধ’ ঘোষণা করে৷ ফলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সপ্তমবারের মতো শপথ নেন রবার্ট মুগাবে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
টিপ সই
জাল ভোট রুখতে অনেক দেশে এখনো ভোট দেয়ার আগে ভোটারের আঙুলে এক ধরণের কালি লাগিয়ে দেয়া হয়৷ সিলভার নাইট্রেট মেশানো থাকায় এ কালির দাগ দু-তিন দিন অন্তত আঙুলের চামড়ায় থাকে, আর নখের সেই দাগ তো কখনো কখনো চার সপ্তাহের আগে মোছেই না৷ গত মে মাসে মালয়েশিয়ার ভোটাররাও এভাবে টিপ সই করেই ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মদ্যপান বারণ...
মেক্সিকোয় নির্বাচনের দিনে মদ্যপান করা নিষেধ৷ রাজ্য সরকার চাইলে অবশ্য এ আইন শিথিল করতে পারে৷ পর্যটকদের ভিড় থাকে এমন জায়গাতে অবশ্য এ নিয়মের কড়াকড়ি থাকে না৷
ছবি: Reuters
ভোট যখন মৃত্যুপরোয়ানা...
যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করার পর ইরাকে প্রথম নির্বাচন হয়েছে গত এপ্রিলে৷ একরকম প্রাণ হাতে নিয়েই ভোট দিয়েছেন ইরাকের জনগণ৷ নির্বাচনের আগে-পরে সন্ত্রাসী হামলায় মারা যায় ২০০ জন, যার মধ্যে ১৪ জন প্রার্থীও ছিলেন৷ নির্বাচনের দিনে কোনো সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি৷ তবে জনমনে আতঙ্ক ছিল বলে অর্ধেকেরও কম ভোটার তাদের নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন৷
ছবি: Reuters
বিশেষ দিন
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন হয় নভেম্বরের কোনো এক মঙ্গলবারে৷ এ নিয়ম চলছে ১৮৪৫ সাল থেকে৷ শীতের আগে এবং ফসল কাটা শেষ হবার পরে যাতে নির্বাচন হতে পারে সে কথা ভেবেই বছরের একাদশতম মাসকে বেছে নেয়া৷ সে আমলে দূরদূরান্তের শস্যখামার থেকে নিজেদের নির্বাচনি এলাকায় আসতে হতো ভোটারদের৷ সোমবার যাত্রা শুরু করে মঙ্গলবার ভোট কেন্দ্রে হাজির, হাটের বার বুধবারের আগেই ভোট দেয়া শেষ – যুক্তরাষ্ট্র এ নিয়ম এখনো বদলায়নি৷
ছবি: Getty Images
ব্যালট এবং বার্বিকিউ
অস্ট্রেলিয়ায় ভোট নেয়া হয় সসেজের দোকান, স্কুল এবং কমিউনিটি হলগুলোতে৷ ভোটারের কাছে ‘স্ন্যাকস’ বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করার হিড়িক পড়ে তখন৷ গত ৭ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনেও তা-ই হয়েছে৷ অস্ট্রেলিয়ায় ভোট দেয়া-না দেয়া কারো ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার নয়৷ বয়স ১৮-র বেশি হলে বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া ভোট দেয়া সবার জন্য বাধ্যতামূলক৷
ছবি: Tony Feder/Getty Images
ভোট শুধু অধিকার নয়
বিশ্বের অন্তত ২২টি দেশে ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক৷ তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নিয়মটা একটু শিথিল করা হয়৷ ব্রাজিলে ৭০-এর বেশি বয়সি এবং লেখাপড়া না জানা ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের জন্য ভোট দেয়া-না দেয়া তাঁদের ইচ্ছের ব্যাপার৷
ছবি: Antonio Scorza/AFP/GettyImages
প্রচারণা বন্ধ
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের অনেক দেশে ভোটের দিনে নির্বাচনি প্রচারাভিযান পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হয়৷ রাশিয়াতেও একই নিয়ম৷ সে দেশের সর্বশেষ নির্বাচনের আগে তাই পোস্টার, ব্যানার, হোর্ডিংও সরিয়ে ফেলতে হয়েছিল৷
ছবি: Reuters
ব্যাপক সাড়া
ইরানে গত জুনের নির্বাচনে ৭২ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন৷ ভোট কেন্দ্রগুলোতে এত ভিড় ছিল যে কোথাও কোথাও নির্ধারিত সময় শেষ হবার কয়েক ঘণ্টা পরও ভোট নিতে হয়েছে৷ ৫১ ভাগ ভোটারের রায় পেয়ে দেশের নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন হাসান রৌহানি৷
ছবি: DW
10 ছবি1 | 10
পানি না ছুঁয়ে মাছ ধরা যায় না
একটা সমস্যা হলো এই যে, এ ধরনের সংশ্লেষ অথবা সম্পৃক্ততাকে ‘অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার সমতুল' বলে গণ্য করা হতে পারে৷ তাছাড়া এভাবে ‘জড়িয়ে পড়ার' একটা খরচের দিকও আছে: বৈশ্বিক স্থায়িত্বের মূল্য ধরে দিতে হয়৷ এছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশগুলির সরকারবর্গ নিজের নিজের দেশের সংসদকে কতটা ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে দিতে চান, সেটাও একটা আলাদা প্রশ্ন৷
জনসনের মতে ইউরোপীয় সংসদের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ইউরোপ জুড়ে দক্ষিণপন্থি প্রবণতাও এক ধরনের অশনিসংকেত৷ ইউরোপের ভোটাররা যাবতীয় নির্বাচন সত্ত্বেও বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখছেন না: ক্রমেই আরো বেশি পেশাদারি রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে তাদের যোগসূত্রটা ক্রমেই আরো ক্ষীণ হয়ে আসছে, বলে ইউরোপের একাংশের ধারণা৷ ভোটাররা রাজনীতির গোটা প্রক্রিয়া সম্পর্কে কী ভাবেন, নেতাদের সেটা জানা নেই অথবা শুধুমাত্র আংশিকভাবে জানা আছে৷ সেই সঙ্গে রয়েছে লবিইস্টরা এবং ‘স্পিন' ডক্টররা৷
‘‘কিন্তু আমাদের আর কোনো স্পিন বাকি নেই৷ আজ অর্থই মোটামুটি সব কিছু শাসন করছে, অর্থাৎ টাকা, মোটা টাকা'', বলেছেন জনসন৷
‘‘২০০৮ সালের সংকট থেকে আমরা বাস্তবিক কোনো শিক্ষা পাইনি৷ সংকটের আগে কিংবা পরে, একটি উন্নততর বিশ্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্য থেকে আমরা আজও অনেক দূরে৷''