গণপ্রহারের নেপথ্যে গভীর মনের অসুখ
২৭ জুলাই ২০১৯ছেলেধরা অথবা চোর, কোনো মানুষকে বাইরে থেকে দেখে তার সম্পর্কে এতটা অনুমান নিশ্চয়ই করা যায় না৷ সন্দেহ জাগতে পারে, তাকে পাকড়াও করে প্রশ্ন করা যেতে পারে৷ একটি এলাকায় কী উদ্দেশ্যে সেই ব্যক্তি এসেছে, তা জানতে চাইতে পারে স্থানীয় বাসিন্দারা৷ জবাবে সন্তুষ্ট না হলে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া যায়৷ কিন্তু, স্রেফ সন্দেহের বশে একটি মানুষকে তারই মতো একদল মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলছে৷ বাঁশ-লাঠি-রড দিয়ে মারধর করছে, তা তিনি মহিলা হোন বা প্রৌঢ়৷ মৃত্যু নিশ্চিত করতে পাথরের ঘায়ে থেঁতলে দেওয়া হচ্ছে মাথা৷
গণপ্রহারের শিকার ঢাকার তসলিমা বেগমের সঙ্গে তাই কোনো ফারাক নেই উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির নিহত যুবকের৷ পেশায় বহুরূপী এই যুবক নাগরাকাটার সুখানি বস্তি এলাকায় গিয়েছিলেন ভিখারি সেজে৷ নানা ছদ্মবেশ ধরাই তাঁর পেশা৷ তাঁকে দেখে এলাকার মানুষের ছেলেধরা বলে সন্দেহ হয়৷ তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন, ছেলে চুরি তাঁর উদ্দেশ্য নয়৷ তিনি বহুরূপী, সাজগোজ করে ভিক্ষে চাওয়া তাঁদের বংশানুক্রমিক পেশা৷ কিন্তু, উন্মত্ত জনতা অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের কথায় বিশ্বাস করেনি৷ তাঁকে পিটিয়ে, থেঁতলে খুন করেছে পুলিশের সামনেই৷ যদিও এই এলাকায় তিনি আগেও বহুরূপী সেজে এসেছেন৷ স্থানীয় কয়েকজন তাঁকে চিনতে পেরে আগ্রাসী মানুষদের বাধা দেন৷ কিন্তু, লাভ হয়নি৷ জনতাকে বাধা দিতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশও৷ একই ভাবে তসলিমাও তোছেলেধরা ছিলেন না, তবু তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে অমানুষদের প্রহারে৷
সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ঘটনা সামনে এসেছে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ধর্মীয় বিভেদমূলক৷ নিশানা করা হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের৷ ঝাড়খণ্ডে এক যুবককে গরু পাচারকারী সন্দেহে মারধর করা হয়েছে৷ তবে ধর্মের যোগ নেই, এমন ঘটনা ঘটছে নিয়মিত৷ অনেক ক্ষেত্রে গুরুতর আহত হচ্ছেন আক্রান্ত ব্যক্তি৷ চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ৷ অনেকে বেঁচে থাকলেও চিরকাল শারীরিক সমস্যা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন৷
একটি অসহায় মানুষকে দল বেধে প্রহার করার মানসিকতার মধ্যে অসুস্থতা আছে, তা বোঝাই যায়৷ মনস্তত্ত্ববিদরা কি বলছেন? কলকাতার বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সমীরচন্দ্র দাস বলেন, ‘‘কোনো একটা মানসিক অবস্থা দিয়ে গণপ্রহারের ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে না৷ একাধিক কারণ রয়েছে এর পিছনে৷ তাঁর মতে, মানুষের মধ্যে ধ্বংসাত্মক প্রবণতা নিহিত থাকে৷ থাকে হিংসাত্মক চরিত্রও৷ মানুষ যখন অবসাদ থেকে বেরোনোর পথ খোঁজে, তখন হিংসার আশ্রয় নেয়৷'' অর্থাৎ, নিজের গ্লানি দূর করতে অন্যের উপর আক্রোশ প্রকাশ করে৷
চলতি সপ্তাহে ভারতের ৪৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে লেখা চিঠিতে ধর্মপরিচয়ের জন্য উৎপীড়নের পাশাপাশি গণপিটুনি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন৷ শ্যাম বেনেগাল, আদুর গোপালকৃষ্ণন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, মণিরত্নম প্রমুখরা চিঠিতে লিখেছেন, মুসলিম, দলিত ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে গণপিটুনির ঘটনা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার৷ প্রধানমন্ত্রীকে তাঁদের প্রস্তাব, ‘আপনি সংসদে গণপিটুনিকে বিরোধিতা করেছেন ঠিকই৷ তবে সেটা যথেষ্ট নয়৷ এ ধরনের অপরাধকে জামিন-অযোগ্য করা উচিত৷'
বহু ক্ষেত্রে জনতা পুলিশ-প্রশাসনের উপর অনাস্থা থেকে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে অসহিষ্ণু মানুষ৷ তাই গণপ্রহার বন্ধে আইন কঠোর করা দরকার, এই ভাবনাকে অনেকে সমর্থন করছেন৷ কিন্তু, মানুষের মনের অসুখ সারবে কিভাবে? চিকিৎসক সমীরচন্দ্র দাসের বক্তব্য, ‘‘এক্ষেত্রে আত্মসংযম ও পরিচালনা বিশেষ জরুরি৷ যাঁরা নিজেদের আবেগ সফল ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তাঁদের মধ্যে হিংসার প্রকাশ কম দেখা যায়৷ ছোটবেলায় কে কেমন শিক্ষা পেয়েছে, তার উপর এটা অনেকটাই নির্ভর করে৷ জীবনে হতাশা দূর করা না গেলে হিংসা রোখা সম্ভব নয়৷''