গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র স্বৈরশাসকদের নেতৃত্বে পরিচালিত দেশের সমস্যা নয়৷ গণতন্ত্র আছে এমন দেশগুলোতেও এই স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ছে বলে মনে করেন ডিডাব্লিউর প্রধান সম্পাদক ইনেস পোল৷
বিজ্ঞাপন
মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার কোনো বিলাসী পণ্য নয়৷ গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র চলতে পারে না৷ সুতরাং এই স্বাধীনতা যে রক্ষা হয় তা দেশগুলোকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে৷ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত দেশের একটি অন্যতম স্তম্ভ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা৷ কারণ, এটি থাকলে মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তা পায়৷ মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকলেই কেবল দুর্নীতির খবর প্রকাশ করা যায়, সম্ভব হলে প্রতিরোধও করা যায়৷ এছাড়া রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা যায়, বাধাহীনভাবে তদন্ত চালানো যায় এবং গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা যায়৷
হিটলারের হিসাব
নাৎসি আমল থেকে আমরা জার্মানরা স্বাধীন সাংবাদিকতার গুরুত্ব কতখানি, তা বুঝতে পেরেছি৷ কারণ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার মাধ্যমেই আডল্ফ হিটলার তাঁরধারাবাহিক সহিংসতা শুরু করেছিলেন৷
টাইম ম্যাগাজিনের ‘পার্সন অফ দ্য ইয়ার’ সাংবাদিকরা
সত্য উন্মোচনে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য জামাল খাশগজিসহ চার সাংবাদিক ও দ্য ক্যাপিটাল গ্যাজেট অফ অ্যানাপোলিসকে ২০১৮ সালের বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব ঘোষণা করেছে টাইম ম্যাগাজিন৷ সহযোদ্ধা হিসেবে উঠে এসেছে বাংলাদেশের শহীদুল আলমের নামও৷
ছবি: Reuters/Time Magazine
জামাল খাশগজি
যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশগজি মধ্যপ্রাচ্য ও সৌদি আরবের রাজনীতি বিষয়ে ওয়াশিংটনে পোস্টে নিয়মিত কলাম লিখতেন৷ পাশাপাশি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের একজন কট্টর সমালোচক ছিলেন তিনি৷ অক্টোবরে ইস্তান্বুলেন সৌদি দূতাবাসে গেলে সেখানেই নিহত হন তিনি৷ তুরস্ক তাঁকে পরিকল্পিতভাবে খুন করার অভিযোগ করলেও, সৌদি আরব তা অস্বীকার করে আসছে৷
ছবি: Reuters/Time Magazine
ক্যাপিটাল গেজেট
যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড রাজ্যের পত্রিকা ক্যাপিটাল গেজেটকেও ‘পারসন অফ দ্য ইয়ারের’ স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে৷ জুন মাসে পত্রিকাটির অফিসে একটি বন্দুক হামলায় পাঁচ সাংবাদিক নিহত হন৷ কিন্তু তারপরও থেমে থাকেনি পত্রিকাটি৷ বরং এরপর থেকে আরো বেশি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় জোর দিয়েছে৷
ছবি: Reuters/Time Magazine
রয়টার্স সাংবাদিক
মিয়ানমারে সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে রয়টার্সের দুই সাংবাদিক কিয়াও সোয়ে উ এবং ওয়া লোনের৷ রোহিঙ্গা ইস্যুতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশে তাঁদের ওপর ক্ষিপ্ত হয় দেশটির সরকার৷ ১০ সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যার তথ্য উন্মোচনের দায়ে তাঁদের আটক করা হয়, অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য পাচারের৷ তারা এখন কারাবন্দি৷
ছবি: Reuters/Time Magazine
মারিয়া রেসা
ফিলিপাইন্সের ৫৫ বছর বয়সি নারী মারিয়া রেসা ব়্যাপলার নামে একটি অনলাইন নিউজ সাইটের প্রতিষ্ঠাতা৷ দেশটির প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র একজন কঠোর সমালোচক তিনি৷ এই ‘তথাকথিত যুদ্ধে’ ১২০০ মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানুয়ারিতে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ৷ সম্প্রতি ব়্যাপলারের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়েছে৷ এর ফলে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে তাঁর৷
ছবি: Reuters/Time Magazine
বাংলাদেশের শহীদুল আলম
বাংলাদেশের শহীদুল আলমের কথাও উঠে এসেছে টাইমের ঘোষণায়৷ এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করায় ‘মিথ্যা’ এবং ‘উসকানিমূলক’ মন্তব্য করার অভিযোগ এনে তাঁকে ১০০ দিনের বেশি সময় কারারুদ্ধ করে রাখার কথা বলা হয়েছে ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
5 ছবি1 | 5
নাৎসি আমল আমাদের কী শিখিয়েছে? প্রথমত, সাংবাদিকদের উপর নির্যাতনের খবর প্রকাশ থেকে আমরাকখনো বিরত থাকতে পারি না, গ্রেপ্তার হওয়া আমাদের সহকর্মীদের মুক্তির দাবি থেকে সরে আসতে পারি না এবং যাঁরা ক্ষমতায় আছেন তাঁদের বাকস্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা করা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করতে হবে৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও রোমানিয়ায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে৷ সেখানে গণমাধ্যমবিরোধী আইন করা হচ্ছে, বিরোধী মতের সমর্থক বিচারকদের ছাঁটাই করা হচ্ছে আর বিরুদ্ধ মতের অধিকারীদের মুখ বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর এমন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কী করা যায়, ইইউ-কে তা ভাবতে হবে৷
চলতি বছর বিশ্বের ১৩ জন ব্লগার ও সিটিজেন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে৷ গতবছরের তুলনায় সংখ্যাটি প্রায় দ্বিগুন৷ হত্যার শিকার হওয়া এই ব্যক্তিরা অনেকক্ষেত্রে তাঁদের দেশের স্বাধীন তথ্য পাওয়ার কয়েকটি সূত্রের একটি ছিলেন৷
ট্রাম্প ও গণমাধ্যম
সহিংস হামলাই সাংবাদিকদের জন্য একমাত্র হুমকি নয়৷ ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুটিনের মতো রাজনীতিকরা জানেন, সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যতা৷ তাই তাঁরা এই বিষয়টিতে আঘাতের চেষ্টা করেন৷ ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন গণমাধ্যমকে ‘ভুয়া খবর' বলে ডাকেন তখন সেটি শুধুমাত্র তাঁর মিথ্যাকে ঢাকার চেষ্টার চেয়েও বেশি কিছু৷ গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতাকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির মুখে ফেলার একটি অংশ এটি৷
সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে এবং কোনো খবরের বিষয়ে অনুসন্ধান চালানোর ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হতে হবে৷ এছাড়া সহকর্মীদের বেশি বেশি প্রশ্ন করতে হবে, আর ভুল হলে তা চেপে না রেখে স্বীকার করে নিতে হবে৷
ইনেস পোল/জেডএইচ
সাংবাদিকদের সঙ্গে ট্রাম্পের লড়াই
মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং সিএনএন সাংবাদিক জিম একোস্টার মধ্যকার সাম্প্রতিক বাদানুবাদ সারাবিশ্বে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে৷ তবে এবারই প্রথম সাংবাদিকদের আক্রমণ করেননি ট্রাম্প৷ অতীতেও ঘটেছে বহুবার৷
ছবি: Reuters/K. Lamarque
সাংবাদিকদের আক্রমণ ট্রাম্পের অভ্যাস
মধ্যবর্তী নির্বাচন পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে সিএনএন হোয়াইট হাউস রিপোর্টার জিম একোস্টাকে আক্রমণ করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ একোস্টা প্রেসিডেন্টের কাছে একটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে ট্রাম্প বলেন, ‘‘আপনার মতো একজনকে কাজ করার সুযোগ দেয়ায় সিএনএন-এর লজ্জিত হওয়া উচিত৷ আপনি একজন রুঢ় এবং ভয়ানক মানুষ৷’’ সেই বাদানুবাদের পর একোস্টার ‘প্রেস পাস’ স্থগিত করে হোয়াইট হাউস৷
ছবি: Reuters/J. Ernst
‘আমি জানি আপনি ভাবছেন না, আপনি কখনোই ভাবেন না’
চলতি অক্টোবরে হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে এবিসি সাংবাদিক সিসিলিয়া ভেগা সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখন ভেগার কোনো প্রশ্ন আছে কিনা জানতে চেয়ে মন্তব্য করেন, ‘‘আমি তাঁকে বেছে নেয়ায় তিনি বিস্মিত৷ মনে হচ্ছে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছেন৷’’ জবাবে ভেগা বলেন যে তিনি আসলে বিস্মিত নন৷ তখন ট্রাম্প বলেন, ‘‘এটা ঠিক আছে৷ আমি জানি আপনি ভাবছেন না৷ আপনি কখনোই ভাবেন না৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/L. Bevilaqua
টুইটারে নামধরে অভিযোগ
গত বছরের জুনে এমএসএনবিসি উপস্থাপক মিকা ব্রেজেজিন্সকির ওপর ক্ষিপ্ত হন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ তখন তিনি টুইটারে সেই সাংবাদিককে ‘কম বুদ্ধিসম্পন্ন পাগল মিকা’ হিসেবে আখ্যা দেন এবং দাবি করেন যে, ফ্লোরিডায় ট্রাম্পের রিসর্ট ভ্রমণ করার সময় সেই সাংবাদিকের চেহারার বলিরেখা দূর করার সার্জারির জায়গা থেকে ভয়াবহভাবে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Senne
কিছু সাংবাদিক বছরের পর বছর আক্রান্ত
চলতি বছরের মার্চে পেনসিলভানিয়াতে এক প্রচারণা চলাকালে এনবিসি উপস্থাপক চাক টডের উপর নিজের রাগ ঝাড়েন ট্রাম্প৷ টডের ‘মিট দ্য প্রেস’ শো সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ট্রাম্প সাংবাদিককে ‘ঘুমচোখা টড’ হিসেবে বর্ণনা করেন৷ এ সময় তিনি তাঁকে গালমন্দও করেন৷ অতীতেও টডকে নিয়ে এরকম মন্তব্য করেছেন নানা কারণে সমালোচিত এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/K. Frey
টুইটার: ট্রাম্পের প্রিয় আক্রমণের স্থান
সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ চালাতে প্রায়শই টুইটারকে বেছে নেন ট্রাম্প৷ গত বছরের জুলাইয়ে তিনি একটি ভিডিও টুইট করেন৷ সেখানে তাঁকে সিএনএন-এর লোগো দিয়ে মুখ ঢাকা এক ব্যক্তিকে মারতে দেখা যায়৷ গত ডিসেম্বরে এক ভুল টুইট করার দায়ে ওয়াশিংটন পোস্ট সাংবাদিক ডেভ উইগেলকে চাকুরিচ্যুত করার দাবি জানান তিনি৷ আর মাঝেমাঝেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘ফেক নিউজ’ আখ্যা দিয়ে টুইট করতে দেখা যায় তাঁকে৷